বৈতরণী হকের গদ্য ‘সুফি সংস্কৃতির কিছু কথা’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
কবে কোথায় কিভাবে সুফিবাদের উদ্ভব হয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়নি। তবে ঐতিহাসিকেরা ধারণা করেন যে, হযরত মুহাম্মদের (স.) ইন্তেকালের পরপরই কয়েকশো বছর ধরে সুফিবাদের বিকাশ ঘটে। আরবি শব্দ `সুফ` থেকে সুফি কথাটা এসেছে। এর অর্থ পশম। আগের দিনে আরবের দেশগুলোতে লোকজন পশমের কাপড় পরতো। আবার কেউ কেউ বলেন, সুফা বলতে পবিত্রতা আর শুদ্ধতা বুঝায়। এর থেকে সুফি কথার উদ্ভব।
নবী করিম (স.) আল্লাহকে ভয় করার সাথে সাথে আল্লাহর প্রেমে মশগুল ছিলেন। হেরা পর্বতের গুহায় উনি আল্লাহর সান্নিধ্য প্রাপ্তির আশায় ধ্যান করতেন। আল্লাহর প্রতি বান্দার অন্তরাত্মার ভালোবাসার মতো পবিত্র কোনও অনুভূতি এই জগতে নেই। পবিত্র এ অনুভূতি থেকেই সুফিবাদের জন্ম বলে অনেক সুফিবাদী মনে করেন। সুফিবাদের মূল কথা হলো, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর সৃষ্টির জন্য ভালোবাসা।
সুফিবাদ থেকে সুফি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সুফি সাহিত্যিক হিসেবে প্রথমেই আসে জালালুদ্দিন রুমির নাম। আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য আর প্রেমের তীব্রতা ফুটে উঠেছে তার সাহিত্যকর্মে। তার কবিতা শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও সাধারণ মানুষদেরকেও প্রভাবিত করেছে। রুমির লেখা কবিতা নব্বইয়ের দশকে খুব বিখ্যাত ছিল আমেরিকাতে। অনেকেই সেগুলোকে তাদের জীবনদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বর্তমানে তুরস্কে কনিয়া বলে এক জায়গায় রুমির অনুসারীরা বাস করে। তারা বিশেষভাবে আল্লাহর ইবাদাত করেন। sema বা sama নামক এক অনুষ্ঠানে তারা সংগীত আর বিশেষ নৃত্যের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে। এ পদ্ধতির নাম whirling dervishes/mevlevi dervishes। আসলে সংগীত বলতে গেলে ভুল বলা হয়, সুফিবাদে একে বলে জিকর। whirling dervish হলো ঘূর্ণন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুফিরা জিকর করে। তাদের মতে, সৌরজগৎ, এমনকি বিশ্ব ক্রমাগত ঘুরছে। আর তাই আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যেতে পারে এই ঘূর্ণনের মাধ্যমেই। এই প্রার্থনার চারটি ধাপ আছে। এগুলো হলো, towards God, with God, in God। সর্বশেষ ধাপে তারা বলে যে, তাদের সাধনা একটি চলমান প্রবাহ শুরু হবে। শেষ হবে, আবার শুরু হবে। whirling dervish এখন শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে গিয়েছে সারা বিশ্বে। বিভিন্ন দেশে এই আধ্যাত্মিক সাধনা হয়ে গিয়েছে নৃত্যের এক বিশেষ মাধ্যম।
বিশ্বের একেক দেশে সুফিবাদ পালন করা হয় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে মিশ্রণ করে। তবে মূল কথা হলো, আল্লাহর প্রতি প্রেম। মরক্কো থেকে সিরিয়া, সেনেগাল থেকে তিউনিশিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা সবখানেই সুফিবাদে বিশ্বাসী মানুষের সন্ধান মেলে। এইসব দেশে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে আর শারীরিক কিছু অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তারা জিকর করে থাকে। মরক্কোতে জিলালা বলে একটি পুরানো এবং বিখ্যাত দল আছে, যারা সুফিবাদে বিশ্বাসী আর দলগতভাবে সংগীত সাধনা করে এবং সংগীতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করে।
এবার আসা যাক দক্ষিণ এশিয়াতে। সুফিবাদের আক্ষরিক বিকাশ ঘটে পাক-ভারত উপমহাদেশে মুঘলদের হাত ধরে। মুঘল সম্রাট আকবর সুফি ঘরানার মানুষ ছিলেন। তার দরবারে বুলবুল-ই-হিন্দ খ্যাত সুফিসাধক তানসেন ছিলেন একজন সভাসদ। এখনকার ভারত আর পাকিস্তানে সুফিবাদে বিশ্বাসী মানুষের অভাব নাই। বিশেষ করে মাজার সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে সুফিবাদ। ভারতের বিখ্যাত সুফি ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। তার যোগ্য অনুসারী ছিলেন, আমীর খসরু। আমীর খসরু হলেন কাওয়ালি গানের জনক। উনি উত্তর ভারতের ক্লাসিক্যাল গানের একজন প্রবর্তকও ছিলেন। কাওয়ালি হলো পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে সুফি সংস্কৃতির জন্য একটি অবদান। আর এই সুফি গানকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন পাকিস্তানি গায়ক নুসরত ফতেহ আলী খান তার কণ্ঠের জাদু ঢেলে। সেই ধারাবাহিকতায় আছেন রাহাত ফতেহ আলী খান, আবিদা পারভীন। কাওয়ালি গানের বিশেষত্ব হলো, আল্লাহ আর তার প্রিয় রাসূলের পর আল্লাহর প্রেরিত মহামানবদের নিয়ে গান গাওয়া হয়। বা তাদের ভাষায় জিকর করা হয়। সবথেকে বেশি এই ধারায় চতুর্থ খলীফা, রাসুলের (স.) জামাতা আল্লাহর সিংহ উপাধি প্রাপ্ত হযরত আলীর (রা.) জন্য সাধনা করতে দেখা যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, সুফি সংস্কৃতি দ্বারা শিয়া মুসলিমরা প্রভাবিত, যার বহির্প্রকাশ ঘটে মহররমের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে। এছাড়া বাংলাদেশে সুফিবাদের তেমন বিকাশ ঘটেনি। সঠিক জানার অভাবে সুফিবাদ আটকে গিয়েছে মাজারের ওরসেই। সেখানে ওরসে জিকর করা হয় ঠিক, তবে কতটুকু সুফি মনোভাব থেকে তা বলা মুশকিল। মাজারগুলোতে নেশা করে অশালীন পরিবেশ সৃষ্টি করে এক শ্রেণির ভণ্ড ফকিররা। তারা সুফিবাদ কী, তা জানেই-ই না। বিভিন্ন গবেষক আর চিন্তাবিদদের মতে, অনেক সুফি সাধকরাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সুফিবাদ প্রচার করেছেন। যার ফল বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতি। ইতিহাস সঠিক সংরক্ষণের অভাবে তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? মূলধারার মুসলিমরা বলে, সুফি দর্শন ইসলাম বহির্ভূত চিন্তা। যেখানে ইহুদি আর খ্রিস্টনদের আচারের প্রভাব বেশি। আর গান, কবিতা, বাদ্যযন্ত্র সব ইসলাম পরিপন্থী। এই মতাদর্শ পালনের জন্য সুফিবাদীদের কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। তুরস্কের অভ্যুত্থানের পর কামাল আতাতুর্কের আদেশে বন্দি করে জেলে পাঠানো হতো সুফিবাদীদের। এরপরও তারা তাদের সাধনা ছাড়েনি। ২০০৮ সালে mevlevi dervishes পেয়েছে UNESCO থেকে উপহার স্বরূপ স্বীকৃতি। যার নাম The masterpiece of the oral and intangible heritage of humanity।
যুগ যুগ ধরে সুফিবাদ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে। মুসলিম স্কলারদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও কাজ করে যাচ্ছে সুফিবাদ নিয়ে। সুফিবাদের আধ্যাত্মিক সাধনা মুসলিম-অমুসলিমদের করেছে অনুপ্রাণিত নিজেকে বুঝতে, সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মিক সম্পর্ক আবিষ্কার করতে। উপরওয়ালাকে ভয় না পেয়ে ভালোবাসার মাঝেই আছে চরম প্রশান্তি আর সেটাই যুগে যুগে হয়েছে সুফিবাদের মূলমন্ত্র। তবে সঠিকভাবে সুফিবাদ আমরা জানি না বলেই সমাজে অসংগতি ঘটছে। ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সুফিবাদের নামে মাজার সংস্কৃতি হয়ে উঠছে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। মৃত ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে মূর্খ ভক্তরা এসব মাজারে এসে হুমড়ি খায়। শুধু অশিক্ষিতরা নয়, শিক্ষিতরাও এই জালে আটকে যাচ্ছে। তাহলে আর বুঝতে বাকি থাকে না, আমাদের শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে। মৃত ব্যক্তিরা কি আসলেই কোনও ক্ষমতা রাখে মানুষকে সাহায্য করার? রাখে না। কোরআনে আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃতদের শোনাতে পারবে না।’
অতিমানব হিসেবে আমরা তাদের সম্মান দিতে পারি, এর বাইরে আরকিছু তাদের কাছ থেকে আমরা আশা করতে পারি না। এটা বোকামি। অথচ ধর্মান্ধ জনগণকে নানাভাবে প্ররোচিত করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মাজার-ব্যবসায়ীরা। এমনি করেই বিতর্কিত হচ্ছে সুফিবাদ। আসল সুফিবাদ থেকে সরে গিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে এই আধ্যাত্মিক সাধনাকে। সুফিবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যুক্তি তর্ক আছে, তবে এটা অনস্বীকার্য যে, ইসলামি সাহিত্য, শিল্পকলা, আবিষ্কার যা অর্জন তার বেশিরভাগ এসেছে সুফিবাদীদের হাত ধরে। সমৃদ্ধশালী ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সুফিবাদে বিশ্বাসীদের ঘিরেই।