বৈতরণী হকের কলাম ‘আমি পথপ্রদর্শক হতে পারি, আর কিছু না’

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২৩

আমি তখন ক্লাস সিক্স কী সেভেনে পড়ি। শারীরিক শিক্ষা বইয়ে একটি চ্যাপ্টার ছিল মেয়েদের কিশোরী বয়সের প্রথম ধাক্কা রজঃস্রাব নিয়ে। কিভাবে কেমন করে সামলাতে হবে এসব বিষয়ে আলোচনা ছিল চ্যাপ্টারটিতে। যে স্কুলে আমি পড়েছি ওটা মেয়েদের স্কুল। তারপরও আপা মানে ম্যাডাম বলেছিল, পড়ে নিও। উনি আর পড়াননি। ব্যাপারটাকে উনি গুরুত্ব দেননি নাকি সহজ হয়ে আমাদের পড়াতে পারবেন কীনা, সে চিন্তা থেকে পড়াননি, তা আমার অজানা।

 

স্কুলে মাথায় তেল দিয়ে দুই বেণি করা, হাতের নখ ছোট রাখা, প্রসাধনী মাখা তো দূর, কালো হেয়ার ব্যন্ড ছাড়া চুল না বাঁধা এমন হাজারো নিয়মের মধ্যে দিয়ে আমরা কলেজের গণ্ডি পার হয়েছিলাম। আমি এখন যে দেশে থাকি সেখানকার নিয়ম পুরো উল্টো। এক ভাবি এখানে ডাক্তার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেদিন বললেন একটা নিয়মের কথা। ১৩ বছরের মেয়ে যদি এসে ডাক্তারের কাছে জন্মবিরতিকরণ ওষুধ চায় ডাক্তার তাকে দিতে বাধ্য আর সেটা অবশ্যই মেয়ের পরিবারকে জানানো যাবে না।

 

হাইস্কুলে মেয়েরা সেজে যায় আর তাদের সাজতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আরও শুনলাম তাদের জন্য স্কুলে স্মোকিং জোনও থাকে। আচার ও রীতি-নীতিতে তফাত থাকবে, সেটা নিয়ে আর কি বলার আছে। সমস্যা হয়ে যায় আমাদের যারা দেশ থেকে একটা চিন্তাধারা নিয়ে আসি। ১৫ মাসের মেয়ে বড় হয়ে কি করবে সে চিন্তায় আমার মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা চলে আসে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা একটা দোটানায় পড়ে যায়। বাসায় এক নিয়ম, স্কুলে আরেক। স্বভাবতই তাদের বাসার নিয়ম ভালো লাগার কথা না।

 

আমি ২০১২ সালে যে এলাকায় থাকতাম সেটা একটা খুব ছোট শহর। বাসে করে ৪৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে ট্রেন স্টেশনে যেতাম। তারপর ট্রেনে যেতাম লন্ডনে সপ্তাহে তিনদিন। কারণ লন্ডনে ছিল আমার ইউনিভার্সিটি। পাশের এলাকা থেকে একটি মেয়ে সিলেটি বংশোদ্ভূত (কথা শুনে বুঝেছি) হিজাব পরে বাসে উঠতো। বাসটা ট্রেন স্টেশনের কাছে আসতেই হিজাব খুলে উগ্র মেকাপ মেরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতো। আমার সাথে প্রায় দিন তার দেখা হতো, কোনও দিন কথা হয়নি।

 

সে আমার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করতো। সন্ধ্যার সময় দেখতাম, বাস তার বাসার কাছে আসার আগেই সব মেকাপ মুছে হিজাবটা মাথায় দিতো। এমন দোটানায় বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে মুসলিম দেশের বংশোদ্ভূত বাচ্চারা বড় হয়।

 

এমনও শুনেছি, দেশে নিয়ে গিয়েছে ষোল বছরের অবাধ্য মেয়েকে ঠিক করার জন্য। সেই মেয়ে লুকিয়ে তার স্কুলে ফোন দেয়াতে দুইদিনের মধ্যে তার মা আর আত্মীয়দের বাংলাদেশে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। সুনামগঞ্জের ঘটনা সম্ভবত। মা-বাবা কত চেষ্টাই না করে। বাসায় এসে হুজুর পড়ানো ব্যয়বহুল বলে দূরে নিয়ে যায় মসজিদে পড়ানোর জন্য, জোর করে ১৯ ঘণ্ট রোজা রাখায়, ব্ল্যাকমেইল করে পর্দা করতে বাধ্য করে।

 

মানলাম, কমিউনিটির মানুষরা খুব প্রশংসা করছে তাদের উদ্যোগ দেখে। কিন্তু যাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এত চেষ্টা, সেই আল্লাহ তো অন্তর্যামী। উনি তো জানছেন বান্দার মনের ইচ্ছাটা কি। আবার এমনও মেয়ে দেখেছি যার মা পর্দা করে না অথচ মেয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে মাথায় কাপড় দিচ্ছে।

 

আমি বলি কি, আমরা আমাদের মতো চলি। আর তাদেরকেও বলবো, আামাদের মতো করে চলতে। তবে জোড় করে নয়। সুস্থ বিবেকবান মানুষ তার কাছে যেটা সঠিক মনে হবে তাকে সেটা করতে দেয়াই উচিত। আমি প্র্যাকটিসিং মুসলিম আমার মেয়েক আমি সেটা শিখাবো। তার ভালো লাগলে সে সেটা গ্রহণ করবে। দোটানার এসব যুদ্ধে শারীরিক মানসিক কষ্ট আমাদের বেশি হয়, তা তো লক্ষ্য করছি। বান্দাকে আল্লাহ কোন পথে নেবে, সেটা উনার সিদ্ধান্ত। আমি বড়জোড় সামান্য একজন পথপ্রদর্শক হতে পারি, আর তো কিছু না!