বুদ্ধিবৃত্তিক ঠগবাজিতে উন্মত্ত আমাদের পাঠক

মিনহাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : মে ৩১, ২০২৩

বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক বিবর্তন নিয়ে বুদ্ধিমহলে নানা রকমের বাকবিতণ্ডা, বিতর্ক-কুতর্কের প্রহসন চালু আছে অনেকদিন যাবত। এই বিতর্কের অবসান হবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আর নেহাৎ একাডেমিক (স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়) কোনো বাধ্যবাধকতা যেহেতু নেই, সুতরাং এটাকে একটা নন-একাডেমিক বিতর্কের ভেতরেই থাকতে হবো বৈকি।

বাঙালি মুসলমানের বাঙালি মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রকাশের বয়স নেহাৎ কম-বেশি কিনা জানি না, তবে বাঙালি মুসলমান পাঠক সমাজের বয়স কম নয়। অন্তত স্বাধীনতা হিসাব করলেও পঞ্চাশ বছর তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স তার চেয়েও বেশি। কিন্তু এই বাঙালি মুসলমান পাঠক অদ্ভুত কিছু ব্যাধিতে আক্রান্ত যে বিষয়টি বুদ্ধিমহলের কারোর নজরে পড়েছে কিনা জানি না।

বইপুস্তক ও ইন্টেলেকচুয়ালিজম নিয়ে এর এক বিস্ময়কর ভণ্ডামি আছে। যেমন তার গভীর অভিযোগ যে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কেন বই লিখলেন না, সৈয়দ মুজতবা আলী আরো কিছু দিয়ে যেতে পারতেন (ঠিক কি দিয়ে যেতে পারতেন এটা সে বলতে পারবে না), রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের নিয়ে লিখেননি, বঙ্কিম কেন তার সেই কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে মুসলমানদের জায়গা দেননি, সাবলটার্ন স্টাডিজের ইতিহাসবেত্তারা কেন বাংলায় বই লেখেননি, অর্মত্য সেন কেন তার আত্মজীবনী বাংলায় লিখলেন না, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য ইতিহাসবিগণ কেন ইংরেজিতে বই লেখেন, মার্ক্সের টেক্সট কেন বাংলায় অনুবাদিত হয়নি জার্মান থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নিজেও এই রোগে আক্রান্ত ছিলাম এক সময়।

মজার বিষয় হলো, বাঙালি মুসলমানের অমুক এটা করলেন না, তমুক সেটা করতে পারতেন, অমুক এটা করে ঠিক করেননি, তমুকের এটা করা উচিত ছিল এই সমস্ত ঠুনকো আহাজারি ও আক্রোশের পুরোটাই আসলে ভণ্ডামি। কারণ বাঙালি তো বই-ই পড়ে না। সে বাপের জন্মেও জার্মান দর্শন পড়বে না, দাদার জন্মেও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কিতাব পড়বে না, জীবন থাকতে সে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, হরপ্রসাদ, নীরদচন্দ্র, ক্ষিতিমোহন, প্রমথ চৌধুরী, সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ, নির্মলকুমার, বিনয় ঘোষের প্রবন্ধ পড়বে না, অস্তিত্ব থাকতে তার পক্ষে যদুনাথ, রণজিৎ গুহ, ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, তপন চৌধুরী, বিপানচন্দ্র, সুবোধকুমার, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, সুমিত সরকার, সুগত বসু, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, রফিউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, আয়েশা জালালদের ইতিহাসের পুস্তক ছুঁয়ে দেখা সম্ভব না, বিশ্বাস-নিশ্বাস থাকতেও সে কোনোদিনও পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, সাহিত্যসমালোচক, কালচারাল ক্রিটিক, ইতিহাসবিদদের কিতাবের কাছে ঘেঁষবে না অথচ সে ক্রন্দন করে আব্দুর রাজ্জাক কেন বই লিখলেন না, মুজতবা আলী কেন আরো কিছু দিয়ে গেলেন না! কী আশ্চর্যজনক প্রবঞ্চনা!

কে কি করলেন না, কে কি দিয়ে যেতে পারতেন, কার কি করা উচিত ছিল এসব অর্থহীন বাজে গরীবি প্রলাপ না করে কে কি করেছে, কে কি লিখেছে, কে কতটা করলো তা পড়া, বোঝা এবং ব্যাখ্যা করাটা কি সত্যিকারের বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

আরেকটি বিশেষ ধরনের ব্যাধি প্রতীয়মান এবং যেটা মহৌষধ সম্ভবত এই দুনিয়ায় পাওয়া দায়। তা হলো বাঙালি মুসলমান পাঠক মাত্রই সে শোনা কথা প্রচার করে। অর্থাৎ সে কখনই গ্রীক দর্শন সবিস্তারে পড়েনি কিন্তু অভাবনীয়ভাবে সে আপনাকে দেদারসে বলে যাবে এরিস্টটল অমুক, প্লেটো তমুক, পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরা তো অমুক, মার্ক্স তো ওটা বোঝেনি, পাশ্চাত্যের অর্থশাস্ত্র ভোগবাদী, সমাজতন্ত্র তো অমুক, পুঁজিতন্ত্র তো তমুক। অথচ সে কিন্তু এগুলো তার নিজের পাঠ থেকে বলছে না, সে সম্পূর্ণই শোনা কথা ও তার কনফার্মেশন বায়াসনেসের জায়গা থেকে বলছে।

তাকে বলতে শোনা যায়, সালটার্নরা তো এরকম করেছে। কিন্তু সে বাপের জন্মেও এলেমেন্টারি আসপেক্টস অব পিজেন্ট মুভমেন্ট কিংবা অ্যা রুল অব ফর প্রপার্টি বেঙ্গল ধরেও দেখেনি। অথবা সে কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্ত, প্রিমিজ, সেটার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণতি এবং অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি সম্বন্ধে জানে না। অথচ তাকে দেখা যাবে অনায়সে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য ঝাড়তে। এমনকি রিচার্ড ইটনের গবেষণা নিয়ে সে লাফালাফি করছে অথচ আপনি আজকেই একটু ক্রিটিকালি স্যাম্পল সার্ভে করুন পাঠক মহলে, দেখবেন ইটনের এই বই বুঝে পাঠক আপনার পেতে টর্চ লাইট ব্যবহার করতে হবে।

এডওয়ার্ড সাইদকে নিয়ে তো এদের প্রচুর ফ্যাসিনেশন, সেইম ভাবে সার্ভে করুন দেখবেন ঐ অরিয়েন্টালিজম পড়েছে এমন লোক পাবেন না। কারণ যে মানুষ অরিয়েন্টালিজম পড়ে বোঝার সামর্থ্য রাখে (ইংরেজিটা, অনুবাদ নয়) সে আর যাহোক ‘অমুকে সেটা কেন করলেন, তমুকের সেটা করা উচিত ছিল’ এই তত্ত্বের প্রচারকারী হওয়া থেকে নিজত বিরত রাখতেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, এই তত্ত্ব চর্চাকারীর সংখ্যাও বাঙালি মুসলমান পাঠক মহলে শতকার নব্বই ভাগের বেশি। সে কিন্তু কখনই সৈয়দ মুজতবা আলীর ১১ খণ্ড পড়েনি বা পড়বে না। কিন্তু সে নির্দ্বিধায় বলে যাবে, মুজতবা আলী আরো কিছু দিতে পারতেন।

সে কিন্তু আব্দুর রাজ্জাকের পিএইচডি থিসিসটা পড়েনি বা পড়বেও না। অথচ সে দিব্যি বলেই যাচ্ছে, তিনি কেন বই লিখলেন না। এক ভয়ংকর রকমের বুদ্ধিবৃত্তিক ঠগবাজিতে উন্মত্ত আমাদের এখানকার পাঠক মহল। যখন বড় ব্যাধি আসে তখন তার সাথে সাথে কিছু সাপ্লেমেন্টারিও থাকে। এখানকার লোকেদের কিছু সাপ্লিমেন্টারি রোগ আছে। একটা হলো অনুবাদ সংক্রান্ত। ‘এটার অনুবাদ নাই কেন, ওটার অনুবাদ নাই কেন।’ কথা হলো যেগুলোর অনুবাদ আছে আপনি কি সেগুলো পড়েন? আপনি তো ভাইবোন বই-ই পড়েন না! আপনি কেন অনুবাদ নিয়ে লাফালাফি করছেন?

একটা সময় মনে করতাম, অনুবাদ আমাদের মতো দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। ধীরে ধীরে ভুল ভাঙলো। প্রথমত, ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ হওয়ার দরকার নাই। কারণ এগুলোর অনুবাদ হলে এখানকার লোকেরা জীবনেও ইংরেজিতে বই পড়তে চাবে না, এবং ইংরেজিতে বই পড়তে পারাটা যে এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার একটি, সেটা এখানকার লোকেদের হাসিল হবে না। দ্বিতীয়ত, ইংরেজি ব্যতীত অন্যান্য যে ভাষা আছে অর্থাৎ ফরাসি, জার্মান, রুশ এসব বইয়ের সরাসরি বাংলার তুলনায় ইংরেজি অনুবাদ পড়া বেহুদা। কারণ আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিক অনুবাদ হয় না। সবই ব্যক্তিগত অনুবাদ হয় এবং এই অনুবাদগুলো যে ভালো, প্রাঞ্জল এবং সঠিক সেটা নির্ণয় করা ও নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা এখানে তৈরি হয়নি।

ক্লাসিকাল রুশ সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ যেগুলো হয়েছে সেগুলো অবশ্য পড়া যায়। কারণ সেগুলো ঐতিহাসিকভাবেই যে ভালো সেটার নিশ্চয়তা প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি ও সামাজিক পরিসরে স্বীকৃত। এর পাশাপাশি কিছু ভালো অনুবাদ হয়েছে সরাসরি সেই ভাষা থেকেই যেগুলোর স্বীকৃতি স্বয়ং ওই ভাষার লেখকই দিয়েছেন সেগুলো পড়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বিখ্যাত জার্মান উপন্যাসিক গ্যুন্টার গ্রাসের উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করেছেন দেবব্রত চক্রবর্তী, যেই অনুবাদ গ্রাস নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তৃতীয়ত এবং বিশেষ দ্রষ্টব্য এই যে, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ ও ঐতিহাসিক কিতাবাদির অনুবাদ হয়েও কোনো লাভ নাই। কারণ এগুলো বাঙালি মুসলমান পাঠক পড়বে না৷ তার তোরজোর ঐ পর্যন্ত ই যে সে `পড়তে চায়` কিন্তু তার পক্ষে সম্ভব না পাঁচশো পৃষ্ঠার একটা রাজনৈতিক দর্শনের বই পড়া।

তার পক্ষে সম্ভব নয় অর্থনীতির মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে ৭০০ পৃষ্ঠার পুস্তক বুঝে পড়া, সেটা হোক অনুবাদ কিংবা ইংরেজি তে৷ যে অঞ্চলের লোকেরা বইপুস্তক ই পড়েনা বইমেলায়, ১৮ কোটি মানুষের দেশে বই মেলায় বই বিক্রি হয় ৫০ কোটি টাকার সেখানে যখন এরকম ফালতু প্রলাপ দেখি তখন গা জ্বলে যায়। বাংলাদেশের যারা উদীয়মান ও প্রমিজিং লেখক, পাঠক এবং অনুবাদক আছেন তারা সাবধানে থাকেন এবং মনে রাখবেন যে আপনার লেখা বই তা যতো ভালোই হোক না, আপনার অনুবাদ করা যতোই ভালো বই হোক না, এখানকার লোকজন এটা পড়বে না। কোনো লাভ নেই। এখানকার লোকজনদের পাঠ গুলিয়ে খাইয়ে দেওয়ার পরও এরা খাবে না, বমি করে দেবে। কারণ ঐ পাকস্থলীই এদের নাই। এখানকার লোকজনের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ভণ্ডামি থেকে সাবধান।

এরা মুজতবা আলীকে বানাইছে রম্যরচয়িতা, আব্দুর রাজ্জাক কে বই না লেখার জন্য তার মরার পরেও অনুযোগ অভিযোগ করছে এবং করতেই আছে, অর্মত্য সেন বাংলায় লিখলেন না কেনো সেটা নিয়ে এদের আহাজারি। ভাই মানুষের কি ঠ্যাকা পড়ছে নাকি আপনি যা চান সেভাবে করবে? একটা দেশে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নাই, নাই কোনো সাহিত্য সমালোচনার প্লাটফর্ম, না আছে বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চর কোনো সুযোগ, না আছে বই-পুস্তকের উপর আলোচনা এবং পড়ার চর্চা, সেই দেশের বামুনেরা কতোবড় বামুন হয়েছেন যে তারা আবার অনুযোগ করে বলেন অমুক সেটা করে নাই, তমুক সেটা করে নাই।

মোদ্দাকথা, এখানকার লোকেরা বই পড়েনা, বই পড়া ও জ্ঞান উৎপাদন করা এদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে ইহজন্মেও ছিল না। না থাকুক সেটা সমস্যা না। এমনকি বই এরা কেন পড়েনা, কেনো এরা তত্ত্বচর্চা করেনা সেটাও বাদ। কিন্তু কথা হলো যে জিনিস এরা করেনা সেই জিনিসে যখন এরা আলগা মাতব্বরী ফলায় তখনই সেটা লোমহর্ষক ভণ্ডামিতে রূপ নেয়। এই ভণ্ডামি থেকে সাবধান কারণ এই ভণ্ডামির একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে।