বুদ্ধদেব বসুর ৩ কবিতা
প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২০
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক বুদ্ধদেব বসুর আজ ১১২তম জন্মদিন। ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা তিনটে কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা বলেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।
কেন না কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।
কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বোলো না ‘সুন্দর’, বোলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের- শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।
আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস ব’য়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হ’তেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধ’রে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-
সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব
সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।
আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।
তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।
নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলোনি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা:
আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।
এই শীতে
আমি যদি ম’রে যেতে পারতুম
এই শীতে,
গাছ যেমন ম’রে যায়,
সাপ যেমন ম’রে থাকে
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে।
শীতের শেষে গাছ নতুন হ’য়ে ওঠে,
শিকড় থেকে উর্ধ্বে বেয়ে ওঠে তরুণ প্রাণরস,
ফুটে ওঠে চিক্কণ সবুজ পাতায়-পাতায়
আর অজস্র উদ্ধত ফুলে।
আর সাপ ঝরিয়ে দেয় তার খোলশ,
তার নতুন চামড়া শঙ্খের মতো কাজ-করা;
তার জিহ্বা ছুটে বেরিয়ে আসে আগুনের শিখার মতো,
যে-আগুন ভয় জানে না।
কেননা তারা ম’রে থাকে
সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে,
কেননা তারা মরতে জানে।
যদি আমিও ম’রে থাকতে পারতুম—
যদি পারতুম একেবারে শূন্য হ’য়ে যেতে,
ডুবে যেতে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে—
তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে ম’রে যেতে হ’তো না
এই বাঁচার চেষ্টায়,
খুশি হবার, খুশি করার,
ভালো লেখার, ভালোবাসার চেষ্টায়।
শিরোনামহীন
ওগো চপল-নয়না সুন্দরী
তোলো মোর পানে তব দুই আঁখি,
মম শিয়রের কাছে গুঞ্জরি’
গাও সকল অগীত সঙ্গীতে
মোর দেহমন রও ঢাকি
তব স্বপন-আবেশ-হিল্লোলে,
চির- নিত্য-নূতন ভঙ্গীতে
ঢেউ তোলো মোর প্রাণ-সিন্ধুতে,
সুখে উচ্ছসিয়া ওঠে কল্লোলে
ছোটে দুই তট দেশ লঙ্ঘিয়া,
চাহে গ্রাসিতে পূর্ণ ইন্দুকে
মহা আকাশের দ্যায় রঙ্গিয়া
ওগো মোর পিপাসিত যৌবনে
কর শান্ত একটি চুম্বনে।