বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’
প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২১
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক বুদ্ধদেব বসুর আজ মৃত্যুদিন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার লেখা ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
এসো, ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থের ভাবনা,
এরপর কী হবে, এরপর,
ফেলে দাও ভবিষ্যতের ভয়, আর অতীতের জন্য মনস্তাপ।
আজ পৃথিবী মুছে গেছে, তোমার সব অভ্যস্থ নির্ভর
ভাঙলো একে-একে;—রইলো হিম নিঃসঙ্গতা, আর অন্ধকার নিস্তাপ
রাত্রি — এসো, প্রস্তুত হও।
বাইরে বরফের রাত্রি। ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক
গালের মাংস ছিড়ে নেয়, চাঁদটাকে কাগজের মতো টুকরো করে
ছিটিয়ে দেয় কুয়াশার মধ্যে, উপড়ে আনে আকাশ, হিংসুক
হাত ছড়িয়ে দেয় হিম; শাদা, নরম, নাচের মতো অক্ষরে
পৃথিবীতে মৃত্যুর ছবি এঁকে যায়।
তাহলে ডুবলো তোমার পৃথিবী, হারিয়ে গেলো চিরদিনের অভিজ্ঞান;
ফুল নেই, পাখি ডাকে না, নাম ধরে ভরা গলায় ডাকে না কেউ;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ,
আর বাইরে উত্তরের শীত, অন্ধকার, মেরু-হাওয়ায় ঢেউয়ের পর ঢেউ।
এই তো সময়;—সংহত হও।
সংহত হও, নিবিড় হও; অতীত এখনো ফুরিয়ে যায়নি ভুলো না,
যে-অতীত অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তারই নাম ভবিষ্যৎ;
যাবে, হবে, ফিরে পাবে। মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা
কেবল চার বেঁধে রাখতে, লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু তোমার পথ
চলে গেছে অনেক দূরে, দিগন্তে।
সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো
মনে পড়ে তোমার,
যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে,
যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল,
সাবধানের ভার,
হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে
পুরোনোকে চিনতেপারো, নতুন করে।
এসো, আস্তে পা ফ্যালো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসো তোমার শূন্য ঘরে;
তুমি ভরে তুলবে, তাই শূন্যতা। তুমি আনবে উষ্ণতা, তাই শীত।
এসো, ভুলে যাও তোমার টাকার ভাবনা, বাঁচার ভাবনা, হাজার ভাবনা—
আর এর পরে
তোমার দিকে এগিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ, পিছন থেকে ধ’রে ফেলবে অতীত।
এসো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও আজ রাত্রে।
তা-ই চাও তুমি, তারই জন্য তোমার বুভুক্ষা, এই মৃত্যুর হাতেই
মুহূর্তের পর মুহূর্তের ছলনা হবে ছিন্ন;
যেমন তোমার চোখের সামনে পৃথিবী মরে গেলো আজ —ফুল নেই,
সব সবুজ নিবে গেছে, চারদিকে শুধু কঠিন শাদা স্তব্ধতার চিহ্ন—
তেমনি তোমাকে ডুবতে হবে, তোমাকেও।
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে।
ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?
লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?
তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার,
দুলতে হয় মৃত্যু আর নবজন্মের বিরামহীন দোলায়
সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে।
অন্ধকারকেই মৃত্যু নাম দিয়েছি আমরা। বীজ মরে যায়,
যখন অদৃশ্য হয় মাটির তলায় সংগোপন গূঢ় গহ্বরে;
শীত এলে ম’রে যায় পৃথিবী, ঝ’রে যায় পাতা, নেয় বিদায়
ঘাস, ফুল, ঘাস-ফড়িং; নেকড়ে আসে বেরিয়ে; কালো, কালো
নিষ্ঠুর কবরে
হারিয়ে যায় প্রাণ—ধবধবে তুষারের তলায়।
তেমনি তুমি; — তোমারও রোদ মরে গেলো, ঘন হয়ে ঘিরলো কুয়াশা,
তোমার আলোর পৃথিবী ছেড়ে তুমি নেমে এলে পাতালে,
তোমার রঙিন সাজ ছিঁড়ে গেলো, মুছে গেলো নাম, ভুলে গেলে
তোমার ভাষা,
যত চোখ তোমাকে চিনেছিলো একদিন, সেই সব উৎবের মতো
চোখের আড়ালে
তুমি মিলিয়ে গেলে— অন্ধকার থেকে অন্ধকারে।
কিন্তু মাটির বুক চিরে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে একদিন,
আবার দেখা দেয়, অন্য নামে, নতুন জন্মে, রাশি রাশি ফসলের ঐশ্বর্যে;
আর এই শীত — তুমি তো জানো প্রত্যেক ফোঁটা বরফের সঙ্গে
তারও শুধু জ’মে উঠছে ঋণ,
সব শোধ ক’রে দিতে হবে ; প্রচ্ছন্ন প্রাণ অবিচল ধৈর্যে
জেগে আছে দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রি।
শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ ক’রে যাচ্ছে গোপনে-গোপনে,
সৃষ্টি ক’রে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ
অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে
স্পন্দন – যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্জ্বল, আশ্চর্য সবুজ
বসন্তের প্রথম চুম্বনে।
আর তাই এই মৃত্যু তোমার প্রতীক্ষা — তোমাকে তার যোগ্য হ’তে হবে,
ভুলতে হবে সাবধানের দীনতা, হাজার ভাবনার জঞ্জাল;
সন্দেহ কোরো না, প্রতিবাদ কোরো না; নিহিত হও এই কঠিন হিম ধবধবে
আস্তরণের অন্তঃপুরে, বীজের মতো— যেখানে অপেক্ষা ক’রে আছে
তোমার চিরকাল।
উৎসর্জন করো, সমর্পণ করো নিজেকে।
নিবিড় হ’লো রাত্রি, পাত্লা চাঁদ ছিঁড়ে গেলো, নেকড়ের মতো অন্ধকার,
দলে-দলে ডাইনি বেরোলো হাওয়ায়, আততায়ীর ছুরির মতো শীত।
এরই মধ্যে তোমার যজ্ঞ; উত্সর্গ হবে প্রাণ, আগুন জ্বালবে আত্মার,
ভস্ম হবে যাকে ভেবেছো তোমার ভবিষ্যৎ, আর যাকে জেনেছো তোমার অতীত।
পবিত্র হও, প্রতীক্ষা করো।
ঐ শোনো, ঘন্টা বাজে গির্জেতে; এদের উৎসবের ক্ষণ আসন্ন।
ঈশ্বরের একজাত, একমাত্র পুত্রের জন্মের স্মরণে;—
কিন্তু তুমি— তোমার শরীর ভিন্ন মাটিতে তৈরি, অন্য
গান বাজে তোমার রক্তে, অন্য এক আশ্বাসের উচ্চারণে
ধ্বনিত তোমার ইতিহাসের আকাশ।
তুমি জেনেছো, মানুষমাত্রেই অমৃতের পুত্র— শুধু একজন নয়, প্রত্যেকে,
তুমি বলেছো, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতে,
তুমি শুনেছো, জন্মের পর জন্মান্তর আবর্তের মতো এঁকে বেঁকে
অমৃতের দিকে নিয়ে যায়; — আর এই জীবন, সেও তার সময়ের
সীমায়, মাংসের গণ্ডিতে
বন্দী হয়ে থাকবে না।
তাই তো জানো তুমি— বার বার মরতে হয় মানুষকে, নতুন করে
জন্ম নেবার জন্য
শুধু জন্ম-জন্মান্তর নয়, একই জন্মে তার এই মৃত্যু আর পুনরুত্থান
শুধু একজনের নয়, সকল মানুষের —হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অরণ্য
লুকিয়ে রেখেছে চিরকাল এই বুভুক্ষা— তারই জন্য সব কান্না,
সব কান্না-ভরা গান,
বুকে বুক রেখে তৃপ্তিহীন প্রেমিক।
তৃপ্তিহীন বিরহে তুমি জ্বলছো— জ্বলতে দাও, পুড়ে যাক যা-কিছু
তোমার পুরোনো,
ডিমের খোলশের মতো ফেটে যাক তোমার পৃথিবী, বেরিয়ে আসুক
অন্য এক জগৎ
এই পাতাল বেয়ে নেমে যাও আরো, আরো অন্ধকারে; যখন সব
হারাবে, কোনো
চিহ্ন আর থাকবে না, তখনই তোমাকে ধ’রে ফেলবে অতীত, এগিয়ে আসবে
তোমার দিকে ভবিষ্যৎ—
সব নতুন— নতুন হ’য়ে।
সময় হ’লো, বাইরে অনাকার অন্ধকার, প্রেতের চীত্কারের মতো হাওয়া;
অচেনা দেশ, অস্থায়ী ঘর, শূন্য ঘরে নিঃসম্বল প্রাণ;
আজ আর কিছু নেই তোমার— শুধু একফোঁটা রক্তে-লীন সংগোপন
ঝাপসা পথ-চাওয়া
এই ব্যাপ্ত কুয়াশার মধ্যে ক্ষীণ, ক্ষণিক, লুকিয়ে-থাকা তারার মতো
কম্পমান।
প্রস্তুত হও, প্রতীক্ষা করো তোমার মৃত্যুর জন্য।
যে- মৃত্যুকে ভেদ করে লুপ্ত বীজ ফিরে আসে নির্ভুল,
রাশি-রাশি শস্যের উত্সাহে, ফসলের আশ্চর্য সফলতায়,
যে-মৃত্যুকে দীর্ণ ক’রে বরফের কবর ফেটে ফুল
জ্ব’লে ওঠে সবুজের উল্লাসে, বসন্তের অমর ক্ষমতায়—
সেই মৃত্যুর— নবজন্মের প্রতীক্ষা করো।
মৃত্যুর নাম অন্ধকার ; কিন্তু মাতৃগর্ভ — তাও অন্ধকার, ভুলো না
তাই কাল অবগুন্ঠিত, যা হ’য়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন;
এসো, শান্ত হও ; এই হিম রাত্রে, যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও
আলো নেই,
তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য
প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।