প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বিশ্বব্যাপী কভিড ১৯ মোকাবেলায় মুসলমানদের তিন আবিষ্কার

ইয়াহিয়া হাতিম

প্রকাশিত : এপ্রিল ২০, ২০২০

বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে রেখেছে উচ্চ হুঁশিয়ারিতে। বিশ্বব্যাপী ১.২ মিলিয়ন বা ১২ লাখ মানুষের আক্রান্তের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রায় এক লক্ষ ৬৪ হাজারের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং যদি এই তিনটি আবিষ্কার— সাবান, অ্যালকোহোল সঙ্গরোধ না হতো, তাহলে মৃত্যুর পরিমাণ হতো আরো অনেক বেশি।

কভিড ১৯ এর বিস্তার সীমিতকরণে ও আবিষ্কারগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কার্যকারিতার উন্নয়নে মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

অ্যান্টিব্যাকটোরিয়াল সাবান
আপনার হাতে ভাইরাসটি থাকতে পারে, তাই সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে— সুপারিশটি প্রথম পাঠ করা হয় বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার ওয়েবসাইটে। অভিজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়মিত  সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার গুরুত্বের উপর জোর দেয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী কভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সাবানকে মানুষের ত্রাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৮০০ অব্দে প্রাচীন ব্যাবিলনে সাবানের মতো কিছু একটার নজির পাওয়া যায়। আজকে আমরা যাকে গোসলের সাবান হিসেবে জানি, তা সর্বপ্রথম উদ্ভুত হয় মধ্যপ্রাচ্যে, দশম শতাব্দীতে, যেটাকে সাধারণত ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। পারস্যের চিকিৎসক, রসায়নবিদ এবং দার্শনিক আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাযি (৮৫৪-৯২৫), পশ্চিমে যিনি রাজেস অথবা রাজিস নামে পরিচিত, সাবান তৈরির বিভিন্ন প্রণালি বর্ণনা করেন।

সাবানের এই প্রস্তুতপ্রণালি অন্যান্য মুসলিম দেশে ও ইউরোপে প্রধান সাবান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে সিরিয়াকে জায়গা করে দেয়। তেরো শতকের কাছাকাছি সময়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন— ফেজ, নাবলুস, দামেস্ক ও আলেপোতে সাবান উৎপাদনের বিস্তার ঘটে।

সংক্রমক শক্তিনাশক হিসেবে অ্যালকোহল
মানবজাতি দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহলকে অনুভূতিনাশক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ঐতিহাসিকদের মতে, অ্যালকোহল আবিষ্কার, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়া খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে সিন্ধু সভ্যতার সময়ে শুরু হয়। যাই হোক, বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা যেন ইসলামের সেই সোনালি যুগে ফিরে গিয়েছে। তারা আজ অ্যালকোহলকে সংক্রমক শক্তিনাশক হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিখ্যাত চিকিৎসক এবং দার্শনিক আল রাযী কর্তৃক রচিত `আল হাওয়ী` একটি চিকিৎসা বিশ্বকোষ, যা পরবর্তীতে `দ্য কমপ্রেহেনসিভ বুক অন মেডিসিন` নামে অনূদিত হয়। সার্জারির আগে-পরে এবং সার্জারির সময়ে জখমের স্থানে অ্যালকোহলকে জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার্য বলে তিনি প্রমাণ করেছেন এ বইয়ে। ৮০৫ সালে বাদশা হারুন-অর-রশিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের একটি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো অ্যালকোহলকে সংক্রমক শক্তিনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন থেকে এর চর্চা ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ সফলতা লাভ করে। ফলস্বরূপ সার্জারি রোগীদের সেরে ওঠার হার বাড়তে থাকে।

সংক্রমক শক্তিনাশক হিসেবে অ্যালকোহলের ব্যবহার যখন সফল হয়, ইউরোপীয় ভাষা তখন এর নামকরণ করার জন্যে আরবি ভাষা থেকে শব্দ ধার নেয়। এ পদার্থের আরবি শদ হচ্ছে `আল কুহুল`। আল কুহুল শব্দের মানে হচ্ছে `সারনির্যাস`, যা অ্যালকোহলের `ডিসটিলেশন মেথড` বা পাতন প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। বর্তমানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অ্যালকোহলের চাহিদা পৌঁছে গিয়েছে এক অভূতপূর্ব অবস্থানে। করোনা ভাইরাস থেকে হাত নিরাপদ রাখতে অ্যালকোহল নির্ভর জীবাণুনাশক জেল এখন জরুরি পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংক্রমকতা রোধ করতে কোয়ারেন্টাইন
মার্চ মাস শেষে, বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি কোনও না কোনওভাবে পৃথকীকরণের অধীনে ছিল। নোভেল করোন ভাইরাসকে আটকাতে বিশ্বব্যাপী অনেকগুলি সরকার বড় আকারের লকডাউন আইন করেছে। বিচ্ছিন্নতার কয়েকটি ঐতিহাসিক রেকর্ড রয়েছে যা আজকের পৃথকীকরণের ধারণার মতো। রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কোয়ারানটাইন ব্যবহারের জন্য প্রথম যুক্তি দেন পারস্যের মুসলিম পলিম্যাথ ইবনে সিনা (980-1037), যিনি আভিসিনা নামে পরিচিত। তাঁর পাঁচ খণ্ডের চিকিৎসা বিশ্বকোষ ‘দ্য ক্যানন অব মেডিসিন’ গ্রন্থে।

ইবনে সিনা প্রথম ব্যক্তি যিনি সংক্রমণ এড়ানোর জন্যে চল্লিশ দিনের স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারি বিচ্ছিন্নতার (স্যানিটারি আইসোলেশন) কোনও পদ্ধতি নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি পদ্ধতিটিকে ‘আল-আরবা’ইনিয়্যা’ (চল্লিশ) নামে অভিহিত করেছিলেন, যা প্রাচীন ভিনিশিয়ান ভাষায় আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা হয়েছিল ‘কোয়ার্টেনা’ শব্দে। কুষ্ঠরোগ একটি সংক্রমক ব্যাধি যা ত্বকের ক্ষতকে বিকৃত করে তোলে। এর বিস্তার রোধ করার জন্য ইসলামি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে কোয়ারানটাইনের বাধ্যতামূলক অনুশীলন ছিল।

১৪ ও ১৫ শতাব্দীতে ব্ল্যাক ডেথ প্লেগের সময় এবং পরে ইউরোপে কোয়ারান্টাইন আরও প্রচলিত হয়ে ওঠে। বিশেষত ভেনিসের মতো ট্রান্সকন্টিনেন্টাল ব্যবসায়ীদের মিলনস্থলগুলিতে। যাত্রী এবং ক্রু উপকূলে পৌঁছার আগে সমস্ত জাহাজকে বিচ্ছিন্ন করার দরকার হতো এবং কোয়ান্টেনা শব্দটি নির্দেশ করতো এই চল্লিশ দিনের সময়কালকে। মহামারির বিস্তাররোধে পদ্ধতিটির সাফল্যের কারণে আজ অবধি কোয়ারান্টাইন শব্দটি টিকে আছে। চূড়ান্ত সময় চল্লিশ দিন না হওয়া সত্ত্বেও কোয়ারানটাইন এখন সমস্ত ধরনের স্যানিটারি বিচ্ছিন্নকরণকে নির্দেশ করে।

অনুবাদক: নাহিদ হোসেন, দ্বীন মোহাম্মদ শেখ ও মেহেবুবা আফরোজ ঐশী

উৎস:  ইংরেজি লেখাটি https://www.moroccoworldnews থেকে নেয়া