বিশ বছর আগের পাঠ্যবই পুনর্বহাল করা হোক

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯

আজ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের জন্মদিন। এই ভদ্রলোককে আমার বিশেষভাবে মনে রাখার কারণ হচ্ছে, তার ‘কুটির’ কবিতাটি। স্কুলে কোন শ্রেণিতে এটি পাঠ্য ছিল, আজ আর মনে নেই। তবে মনে আছে কবিতার কথাগুলো। প্রতিটা বাক্য যেন এক একটা ছবি। যা পড়তে পড়তে আমার শিশুমন দুলে উঠতো আনন্দে। চলুন, পড়ে দেখা যাক কয়েকটি বাক্য:

ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারাবেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু`পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।

কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে `রুনু ঝুনু` হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।

আজকের সময়ে এসে এসব পুরনো, সেকেলে। আর তাই বাতিল। আমরা এখন উত্তরাধুনিক। বিজ্ঞাপনের ভাষায়, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভালোই লাগে।’ তো, এগিয়ে যাওয়া দেশের পাঠ্যবইও এগিয়ে থাকা। কি আছে এখনকার স্কুলের বাংলা বইগুলোতে? হে সচেতন পাঠক, নিজেই খুলে দেখুন। যদি আপনার মস্তিষ্কে ঘিলু থাকে, তবেই বুঝবেন, লেখা নির্বাচনে কী সূক্ষ্ম রাজনীতি রয়েছে।

শিশুর মানসগঠনে এখনকার পাঠ্যবইগুলোতে তেমন কোনো কনটেন্ট নেই। যা আছে, তা শিশুমনে কোনো রেখাপাত করে না। এরপরও শিশু তা পড়তে বাধ্য হয়। কারণ, স্কুলের পড়া করে না গেলে শ্রেণিকক্ষে ম্যাডামের প্যাদানি খেতে হবে। শুধু বাংলা নয়, ইংরেজি ও গণিতের অবস্থা আরো জটিল এবং বিভ্রান্তিকর।

দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বই থেকে একটু উদাহরণ টানা যাক। পুরো বইটির পরিকল্পনা খুবই খামখেয়ালি। বিশিষ্ট ছাগল ছাড়া এ ধরনের পাঠ্যক্রম তৈরি করা কোনো শিক্ষিত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্যি আজকাল শিক্ষিতের সংজ্ঞাও বদলে গেছে। যে যত ছাগল, সে তত শিক্ষিত। এ বইয়ের একটি ছড়া পড়ে নেয়া যাক:

Head and shoulders
knees and toes.
Head and shoulders
knees and toes.

তো, হে মোহতারাম পাঠক, যে শিশুটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, তার বয়স কত বলে আপনার ধারণা? তার পক্ষে কি shoulders এর মতো দীর্ঘ শব্দ পড়া সম্ভব? রোসো, আরো আছে। শিশুদের জ্যামিতির জ্ঞান দেয়া হচ্ছে। কীভাবে? পড়ানো হচ্ছে, square, circle, triangle, rectangle. কী হে পাঠক, বোকাচোদা হয়ে গেলেন নাকি? এখনই নয়, আর একটু ধৈর্য ধরুন।

যে বয়সে শিশুর পরিচয় হওয়ার কথা রঙের বাংলা নামের সঙ্গে, সে বয়সে তাকে রঙের বিভিন্ন ইংরেজি নাম শেখানো হচ্ছে। ৩৩ নম্বর পৃষ্ঠা খুলে দেখুন। অথচ একই শ্রেণির বাংলা বইতে রঙের বাংলা নামগুলো দেয়া হয়নি। বুঝুন ঠেলা, এত চোদন ওইটুকু বাচ্চা ক্যামনে নেবে?

My name`s Lucky.
I like you!
I am round!
Colour me blue.

খেয়াল করে দেখুন, is শব্দকে জুড়ে দেয়া হয়েছে name এর সঙ্গে। অথচ ইংরেজি ব্যাকরণের এই সূত্র বোঝার ক্ষমতা শিশুটির নেই। আবার, কেন জুড়ে দেয়া হয়েছে, তাও ব্যাখ্যা করা হয়নি। এরকম নানা বিভ্রান্তিতে ভরা আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলো। পাঠক, আপনি কি আরও উদাহরণ পেতে চান? সিস্টেম কাহাকে বলে জানেন তো হে পাঠক? তবে দিই একটা সিস্টেমের নমুনা। আজ দেখলাম, ফেসবুকে একটা খবর বেশ চাউর হয়ে ফিরছে।

 

মৌসুমী মৌ নামের একজন এখন দেশের সেরা লেখক! জানা গেছে, মাত্র এক মাসের মধ্যে তার বই ৪৩ মুদ্রণ হয়েছে। কীভাবে? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি মঞ্জুর কাদিরের বিশেষ নির্দেশে যুগ্ম সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে মৌসুমী মৌর চারটি গল্প-ছড়ার বই সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি স্কুলে চারটি বইয়ের দুই সেট করে বই দেয়া হয়েছে। যার মূল্য রাখা হয়েছে ১,৫৭০ টাকা। কোনো কমিশন ছাড়াই গায়ের মূল্যে বইগুলো উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। যেখানে রবীন্দ্র-নজরুলের বইও ২৫% ছাড়ে বিক্রি করা হয়, সেখানে ওই লেখিকার বই বিক্রি হচ্ছে গায়ের মূল্যে! ঘটনা সত্যি কী মিথ্যে, তা এখনো নিশ্চিত নই। তবে দেখেশুনে বলতেই হয়, মারহাবা, আহা সিস্টেমের কী জাদু!

 

সম্মানিত পাঠক, আমার আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। অবশ্যি এতক্ষণই বা কেন লিখলাম, তাও বুঝতেছি না। এসব লিখে কিছুই হবে না। কিছু হয়ও না। শুধু শুধু সময়ের অপচয় হলো। এ সময়টুকু আমি ঘুমোলে পারতাম।

মোহতারাম, স্মরণ করুন আজ থেকে পনেরো কিম্বা বিশ বছর আগের স্কুলপাঠ্য বইগুলোর কনটেন্ট। শিক্ষার উৎস হিসেবে সেসব কী চমৎকারই না ছিল। অথচ সেকেলে বলে সেসব আমরা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে আধুনিক কারিকুলাম তৈরি করেছি। আর এ জাতি এতই বোকাচোদা যে, বুঝতেই পারছে না, তাদের সন্তানদের ‘বিশিষ্ট গাধা’ বানানোই এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। কিন্তু এতসব কথাটথা কেন আমি লিখছি? বিশেষ কোনো মহল যদি আমার এসব কথাটথা ‘গালি’ হিসেবে নেন, তাহলে তো আমার খবর আছে! তবে কোনো ব্যক্তি কিম্বা মহলকে ক্ষেপিয়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলছি। যে সিস্টেম মানুষ থেকে আমাদেরকে যন্ত্র বানিয়ে ফেলছে। আর তাই, তাহেরী হুজুরের মতো আমার বিনীত উচ্চারণ, ‘আমি কি কাউকে গালি দিয়েছি?’

সত্যি বলতে কি, এখন আর কিছুই লিখতে আমার ভালো লাগে না। একেবারে কিছুই না। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় (প্রচলিত ধর্ম প্রকৃত ধর্ম নয়) এবং রাজনৈতিক— প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে সিস্টেম চালু হয়ে গেছে, তা রোধ করার কেউ নেই। মহান কোনো সংস্কারক আর আবির্ভূত হবেন না। যারা এখনো আশাবাদী, আল্লাহ তাদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। নচিকেতার একটি গান আছে, একসময়ে খুব শুনতাম, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে।’

না হে বুজুর্গ, জগৎ-সংসারের সিস্টেম নামক এই ঝড় আর থামবে না। বরং এই ঝড়েই পৃথিবী নামক গ্রহটি ধ্বংস হয়ে যাবে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন জাতি গুয়ামারা খাইতে থাকুক। আর কেউ কেউ আশা-ভরসা নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকুক। আমিন। ছুম্মা আমিন।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

লেখকের মতামতের জন্য ছাড়পত্র কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়