অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

বিপুল জামানের পাঁচটি খুদে গল্প

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০

আদর

বাবু তুমি কেমন আছো?
ভালো।
তোমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করে কে?
সফুরা বুয়া।
আম্মু আদর করে না?
হ্যাঁ।
অনেক, না অল্প?
অনেক।
আব্বু, আব্বু আদর করে না?
করে।
অল্প, না অনেক?
অনেক।
বেশি আদর কে করে?
সফুরা বুয়া।

শেষবার

সূর্য ওঠার আগেই এই গ্রামের মানুষেরা উঠে পড়ে। ভোর থাকতে থাকতেই তারা মাঠে রওনা হয়। বৌঝিরা হাঁড়ি পাতিল মাজতে পুকুরঘাটে যায়। হাঁস-মুরগির ঘরের দরজা খোলে অবশ্যই আরেকটু দেরিতে। ভোরের আলো ফুটলে। যাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে, নারী-পুরুষ কাজে যাবে, তারা গরম ভাত রান্না করে আগে। যাদের সে ঝামেলা নেই তারা পান্তা করে রাখে। সকালে সেটাই মাঠে পাঠিয়ে দেয়। মাঠে যারা কাজ করে তারা কাজের সময় গরম ভাত খেতে পছন্দ করে না।

এই কর্মচাঞ্চল্যকর দিনে প্রায় চুপি চুপি একজন বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। বাস এলেই উঠে পড়ার চেষ্টা করে। মোটামুটি চাউর হয়ে গেছে ভিটেমাটি সব বেঁচে দিয়েছে আলিমরা। শালার নামে কিনেছে চেয়ারম্যান নিজেই। আলিম যাওয়ার আগে শেষবার ভিটের চারদিকে তাকিয়েছিল। কোনও স্মৃতির সন্ধানে? না, কোনও স্মৃতি নেই। কিভাবে থাকবে? বাপে ফকিরি নেয়ার পরে গ্রামের লোকেরা তাদের একঘরে করেছিল। আলিমের বয়স যখন মাত্র আট আর ওর ছোট ভাইবোনের মধ্যে মেঝ ঝিনুকের বয়স যখন চার, তখন এই এলাকা ছাড়তে আলিমরা বাধ্য হয়।

ঝিনুক তখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল মনে হয় সদ্য। আলিমও পড়ত প্রাইমারিতে। এই গ্রামের লোকেরা তাদের না খাওয়ায় রেখেছিল। ঘরের খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল। কোথাও কিছু কিনতে না পেরে ওরা দেড় দিন না খেয়ে ছিল ওরা। মামার আসতে সময় লেগে ছিল আরো একদিন। সবাই না খাওয়া। শুধু ছয়মাস বয়সী ছোট ভাইটার বুকের দুধ খেতে পেত। আল্লাহ ওই মাসুম বাচ্চার খাদ্য বন্ধ করেননি। বড় হয়ে আলিম এসেছে কয়েকবার। এবার এলো চিরজীবনের জন্য হিসাব শেষ করতে।

নামমাত্র দামে চেয়ারম্যানের কাছে বেচে দিল নিজেদের ভিটেমাটি। অন্য কেউ কেনার নামও মুখে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে চেয়ারম্যানের কাছে বেচে দিয়েছে। তাতে আলিমের দুঃখ নেই। আলিমরা মামার দেশে ভালোই আছে। আলিম দোকান দিয়েছে। বোনের বিয়ে দিয়েছে ভালো ঘরে। ছোট ভাইটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মা এখনও চলাফেরা করতে পারে। একমাত্র মা-ই এ বাড়ির জন্য দুঃখ করে। মাকে মানিয়ে এবার আলিম সে বাড়িও বিক্রি করে দরিয়ারামপুর থেকে নিজেদের পাঠ চুকিয়ে ফেলল। ওই যে বাস আসছে। ওই বাসে উঠে পড়লেই আলিম চিরদিনের জন্য চলে যেতে পারবে এখান থেকে।

আরে আলিম না? আমি সজল। প্রাইমারিতে একসাথে পড়তাম। পুকুরঘাটের পাশে বাড়ি।
আপনার ভুল হচ্ছে। আমি আপনার আলিম না।
বাসটা এসে দাঁড়িয়েছে স্ট্যান্ডে, তাতে উঠে পড়ার জন্য পা বাড়ায় আলিম।

কবুল

একবার বললেন, দুইবার বললেন তারপর কাজী সাহেব আবার বললেন। দীর্ঘবাক্য। পাত্রের ঠিকানা ঠিকুজি, তারপর প্রশ্ন, এই বিবাহে আপনার সম্মতি আছে? সম্মতি থাকলে বলুন, কবুল।

কিন্তু তিনবারেও বলে উঠতে পারলো না সে। এদিক ওদিক চেয়ে বলল, ছোট ভাইয়া কই? ডাকো। এদিকটা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে। কাজীকে তারা পথ দেখিয়ে এনেছে। কিন্তু আর কাউকে আসতে দেয়নি। মেয়ের ভাইকে হেসে বলেছে, মায়া কাটাও এবার ছোট সাহেব, বোন এখন পরের ঘরে যাচ্ছে।

মেয়ের ভাইকে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। ঘরের বাইরে দরজায় হেলাল দিয়ে কান্না সামলাচ্ছে। তাকে আনা হলো বোনের কাছে। কাজী সাহেব আবার শুরু করলেন, শরাফতগঞ্জ নিবাসী মো. আব্দুল আওয়াল সাহেবের পুত্র... মেয়ে তবু কিছু বলে না। বিয়ের ভারি পোশাকের নিচে হাতটা একটু নড়ে উঠলো। বোন ধরেছে ভাইয়ের হাত। ভাই বলল, দুনিয়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও মনে রেখো একটা দরজা সবসময় তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। তুমি কখনও একা নও।

কনে তখন হেসে বলল, ভাইয়া তুমি এমনিতে আমাকে তুই করে বলো। কিন্তু সিরিয়াস হয়ে গেলে তুমি করে বলো কেন? পাশ থেকে মামা বলে উঠলেন, তোদের ভাইবোনের কথাবার্তা শেষ হলে এবার কাজটা হয়ে যাক, নাকি?

বোনের দুহাত ভাই ধরে বলল, পছন্দ তোরই, খোঁজ খবর করে আমরাও রাজিই, এখন তুই বল, রাজি? সমগ্র পৃথিবীর লজ্জা আর আড়ষ্টতা ভর করলো কনের উপর, ভাইয়ের ধরা হাত আর ঘোমটা ঢাকা মুখ একটু নড়ে উঠলো, হু!

শূন্যস্থান পূরণ

সকাল হলেই মা আমাদের বসার ঘরটা হৈ চৈতে ভরে ওঠে। এমনিতে আমি, মা আর আমার বোন মিলেই আমাদের সংসার। কিন্তু সকাল হলে পাশের বাসার পিচ্চি এসে জোটে। যেদিন ও আসে না সেদিন মা গিয়ে ডেকে আনে। একটু বেলা করে ঘুমানো আমার অভ্যাস। কিন্তু সেটা এদের আমোদের ঠ্যালায় হওয়ার যো নেই। না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দেখি খুব আহ্লাদ হচ্ছে। মা হিমেলের সামনে খাবার নিয়ে খাওয়ানোর আলাপ চালাচ্ছেন।

হিমেল সোনা, তুমি কি খাবে? চা-বিস্কিট খাবে, নাকি ডিম পাউরুটি খাবে?
পাউরুটি খাব না। ডিম খেয়ে চা-বিস্কিট খাব।
না। ডিমের সাথে পাউরুটিও খেতে হয়। পাউরুটি না খেলে ডিম পাবে না।
আমি কিছুই খাব না।
কিছু না খেলে শক্তি হবে না। সকালে নাস্তা করতে হয়।
তাহলে আমি ডিম খাব আর চা খাব।
না পাউরুটি খেতে হয়।
অনন্তকাল এই কথপোকথন চলবে বলে আমি কথার মাঝে বলি, খাওয়া দাওয়া কী?
মা না তাকিয়েই বলল, যা খাওয়ার তা টেবিলেই আছে? জিজ্ঞেস করছো কেন?
ঝাড়ি খেয়ে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ও যা খেতে চাচ্ছে না সেটাতে জোর করছো কেন
তোর কাজে আমি কিছু বলি? আমার কাজে নাক গলাস কেন?
আবহাওয়া ভালো মনে হলো না বলে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। হিমেল পাশের বাসার হুমায়ূনের ছেলে। হুমায়ূন বয়সে আমার ছোট। দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে। মেয়েটার বয়স আরো কম। আর হুট করে বাচ্চাও নিয়েছে। এখন বাচ্চা সংসার সব মিলিয়ে একদম লেজে গোবরে অবস্থা। মার খুব ভক্ত। মাও খুব স্নেহ করেন মেয়েটাকে। যখনই হিমেল জ্বালাতন করে ওর মা বলে যাও দেখতো দাদু কি করছে? হিমেল চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে আমাদের বাড়ি।

দাদু, দাদু তুমি কি করছো?
উলু বলে তুলু (তুলো) উড়চ্চি?
আমি উড়োবো।
আয় উড়ো।
মা হিমেলকে লেপের ভিতরে টেনে নেন। তারপরে দুটি বিপরীত বয়সী শিশু তাদের আলাপের পরিসর অনুচ্চ কণ্ঠে কোথা থেকে কোথা নিয়ে যায়, তা আর শোনা হয় না আমার।

এর জন্য এটা, ওর জন্য ওটা করে মায়ের দিন দিব্যি কেটে যায়। কোনও তরিতরকারির খোঁসা, ভাতের ফ্যান, ফলের খোঁসা কিছুই জড়ো করতে মায়ের দ্বিধা নেই। কেন? না, মেজ বৌয়ের গরুর জন্যে? পাশের বাড়ির ভাবি একটা ভাঁড় রেখে গেছে। আমাদের বাড়ির তরিতরকারি, আর ফ্যান ট্যানের জন্যে। এক দুদিন পর পর নিয়ে গিয়ে গরুর নান্দায় ঢেলে দেয়। সেটা নিয়েও মায়ের বাড়াবাড়ি। কলা খেয়ে খোঁসাটা একটু দূরে ফেললাম যেখানে কেউ যায় না, ফলে পড়বেও না কেউ। মা পরে সেটা দেখে কুড়িয়ে আনতে গেল। মেজ বৌয়ের ভাঁড়ে ফেলবে।

আমি বললাম, থাক ওটা, পরের গরুর জন্যে এত করা কেন?
মায়ের উত্তর, নিজের থাকলে নিজেরটার জন্য করতাম। নিজের নেই বলে পরের জন্যি করি।

অবিমৃষ্যকারী

আমাদের বাড়িটাতে একদম রোদ আসে না। দক্ষিণ দিকে বড় একটা বাঁশঝাড়। শীতকালে তাই রোদের খোঁজে এদিকে ওদিকে লেগে থাকে আমাদের ছুটোছুটি। উত্তরদিকে দিনের কিছু সময়ের জন্য রোদ আসে। সেই এক্টুকু রোদ নিয়ে আমাদের নানান রকমের পরিকল্পনা। বাবার পেঁপে খাওয়ার ঝোঁক ছিল। পেঁপে হার্টের জন্য ভালো। পেঁপে ছায়ায় হয় না। বাবা বেঁচে থাকতে উত্তর দিকের রোদের জায়গায় পেঁপে গাছ লাগানো ছিল। বাবা নেই। মা সেখানে পরিমিত অর্থাৎ দু’একটা কলাগাছ লাগান। কলার একখাইনে একমাসের তরকারি হয়। ছোটবোনের সামনে পরীক্ষা। এই হাড়কাঁপানো শীতে রাতে পড়া কঠিন। তাই সে দিনের বেলা পড়ে। কলাগাছের পাশে যেখানে পাকা গোয়াল ঘর ছিল সেখানে এখন শুধু পাকা মেঝেটাই আছে। ও দিনের বেলা চেয়ার নিয়ে বা পাটি পেতে পড়ে। পৌষের শুরুতে রোদ তেমন আসছিল না। যা আসতো তাও কলাগাছের কয়েকটা পাতা পথ আগলে দাঁড়াতো। বোন একটু অনুযোগ জানাতেই হেসোর একটানে কেটে দিয়েছিলাম একটা পাতা। সমস্যার সমাধান না হওয়ায় আরেক দিন আরেকটা। বোন পড়তে লাগলো নির্বিঘ্নে। ভাবলাম সমস্যার সমাধান হলো।

দিন পনের পরে দেখি বোন ঘরে পড়ছে। আমি বললাম, কি হলো বাইরে পড়বে না, রোদে?
বেশি রোদ। একদম গা পুড়ে যায়।
আমি বারান্দা থেকেই পাতা হারিয়ে একদিক টেকো হয়ে যাওয়া কলাগাছটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কুণ্ঠিত চিত্তে।