বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ
পর্ব ১১
মলয় রায়চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯
ছয়.
জীবনানন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর যদি উল্লেখ করি তবে দেখা যাবে তা সম্পূর্ণ কবিকল্পিত, তা অবলোকিত বাস্তব নয়, যা আমরা বিনয় মজুমদারে পাই। তাছাড়া জীবনানন্দ বলছেন ‘থাকে শুধু অন্ধকার’ যা সারাজীবন দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করার পরও বিনয় মজুমদারকে বলতে শোনা যায় না। ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে (১৯৮৭) বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি এরকম থাকেন কী করে? রহস্যটা কী? সর্বদাই এমন আনন্দে?” জবাবে বিনয় বলেছিলেন, “আমি সারাক্ষণ আনন্দে থাকি এটা সত্য কথা। তার জন্য আগে থাকতে ব্যবস্থা করে রাখতে হয়।” পক্ষান্তরে জীবনানন্দ লিখেছিলেন:
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
পাশাপাশি পড়ে দেখা যাক বিনয় মজুমদারের অবলোকিত বাস্তবের কবিতা, বিশেষ করে যেগুলো জনপ্রিয়। বিনয় প্রয়োগ করছেন যা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত, যা যুক্তিপূর্ণ, এমন ছবি:
একটি উজ্জ্বল মাছ
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেল— এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায় তবু
এমন সময়ে তুমি হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি… তুমি…
কিংবা দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্হ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যপ্ত বনস্থলি
দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।
আর যদি নাই আসো
আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচরী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো নাই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি, কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে
নিজের চুলের মুগ্ধ ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনি আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফূট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে
জীবনানন্দ দাশের ‘রাত্রি’ (সাতটি তারার তিমির) কবিতাটি এবার পড়ে দেখি। দেখবো যে, জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে পর্যবেক্ষণ করে কবিতাটি লিখেছেন; বিনয় মজুমদারের অবলোকন পদ্ধতির (act of observing, viewing, noticing from personal experience) সঙ্গে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির (act of seeing or looking at and act of ruminating historical events) পার্থক্য আছে। বিনয় নিজের কবিতার খাতায় মার্জিনে যে নোটগুলো নিতেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লেখার সময়ে, সেগুলো প্রধানত ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো, যখন কিনা জীবনানন্দ অন্য খাতায় নোট নিয়ে রাখতেন বাক্যের, শব্দবন্ধের, চিত্রকল্পের, যেগুলোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের তুলনায় বাইরের জগতের বিষয়বস্তু বা ঘটনা এবং পৃথিবীর লুপ্ত সভ্যতাগুলোর স্মৃতিচারণ বেশি। জীবনানন্দের ‘পর্যবেক্ষণ’ আর বিনয়ের ‘অবলোকন’ এর সূক্ষ্ম তফাত। ‘রাত্রি’ কবিতাটি:
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;
অথবা সে হাইড্র্যাণ্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে;
একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে
অস্থির পেট্রল ঝেড়ে— সতত সতর্ক থেকে তবু
কেউ যেন ভয়াবহভাবে প’ড়ে গেছে জলে।
তিনটি রিকশ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে
মায়াবীর মতো জাদুবলে।
আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে— হঠকারিতায়
মাইল মাইল পথ হেঁটে— দেয়ালের পাশে
দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে— টেরিটিবাজারে;
চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে।
মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে।
কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর গুঞ্জনের সঙ্গে মিশে গিয়ে
ধনুকের ছিলা রাখে টান।
টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে।
টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা।
শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে।
রাজ্য জয় করে গেছে অমর আত্তিলা।
নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী;
পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান—
আর কাকে সোনা, তেল, কাগজের খনি।
ফিরিঙ্গি যুবক ক’টি চলে যায় ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার করে
বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।
নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব— অতিবৈতনিক
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।
শার্ল বদল্যারের মতন জীবনানন্দও একজন পথচর ছিলেন, নিশাচরও, এবং তাঁর ‘পথ হাঁটা’ কবিতাটি পড়লে তা স্পষ্ট হবে:
কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি, অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে
সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।
কেউ ভুল করে না কো— ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।
একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত— তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর দেখেছি কি? একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়— চুরুট নীরবে জ্বলে— বাতাসে অনেক ধুলো খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই— গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতরে
কেন যেন; আজো আমি জানি না কো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
বিনয় মজুমদার পথচর ছিলেন না, নিশাচর তো নয়ই। মাঝবয়সে আসঙ্গ-উন্মুখ বিনয় যৌনপল্লীতে (যাকে তিনি বলেছেন তাঁর ‘বৃন্দাবন’) হয়তো রাধার কাছেও, তিনি যেতেন ‘বিশাল দুপুরবেলায়’, ‘প্রকাশ্য দিনের বেলা’। ‘বাল্মীকির কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে, তার মানে তখন তাঁর বয়স ৪২। তার আগে ১৯৬৬ সালে তিনি লিখেছেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ নামে আদিরসাত্মক কবিতাটি, তখন তাঁর বয়স ৩২, যে বয়সে পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবি সোনাগাছি যাওয়া আরম্ভ করেন। আমি তাঁদের সেই পাড়ায় দেখেছি বলে জানি। আমার হাংরি মামলার উকিলের বাড়ি ছিল ঠিক অবিনাশ কবিরাজ লেনের উল্টোদিকে, এবং উকিলের জানালা দিয়ে সবই দেখা যেত।
কল্পনা নয়, বাস্তব জীবন থেকেই বিনয় তুলে এনেছেন তাঁর কবিতা ও গল্পের রসদ। ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের গ্রামে চায়ের ঠেকে আড্ডা দিতে দিতে যা চোখে পড়ত, সেগুলোই উঠে আসত বিনয় মজুমদারের কবিতায় এবং গদ্যকাহিনিতে। এই পর্বে বিনয় তাঁর দিনপঞ্জীর কাব্যায়ন করতেন: “দিনপঞ্জী লিখে লিখে এতটা বয়স হলো/দিনপঞ্জী মানুষের নিকটতম লেখা।” যৌনপল্লীতে রাধার কাছে দিনের বেলায় যাবার স্বীকৃতি রয়েছে তাঁর ‘চাঁদের গুহার দিকে’ কবিতায়:
চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে
দাঁড়িয়ে রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায়
চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুলো ছোটো করে ছাঁটা।
ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ।
গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
বাহিরে পেটের দিকে। চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
অমনি চাঁদকে বলি, ‘তেল লাগাবে না আজ’, শুনে চাঁদ বলে
‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা করো’ বলে সে অয়েলক্লথ নিয়ে
পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নিচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল
নিকটে তাকের দিকে, একটি বোতল থেকে বাম হাতে তেল নিয়ে এল
এসে তেল মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপে ধরে।
যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল।
চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
এক হাতে ঘসে ঘসে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল।
বিনয়ের দৃষ্টিপথে ব্যবিলন, বিম্বিসার, অশোক, মালয় সাগর, আত্তিলা, বিদিশা, শ্রাবস্তী, দারুচিনি দ্বীপ, লিবিয়ার জঙ্গল ইত্যাদি পড়ে না। বিনয়ের কাছে গ্রামের তুচ্ছ জিনিস আর সামান্য চাষি বা দোকানিও গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সকলের নাম জানেন, চেনেন। বিনয় লিখেছেন: “সকল কিছুর মানে আছে, মানে থাকে, মানে নেই এরকম কিছু/স্বাভাবিক প্রকৃতিতে কখনো সম্ভব নয়, সৃষ্টি হলে মানে হয়ে যায়।” ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ বইটিতে তাঁর গ্রামের মানুষজনদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্র পাই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চম্পাহাটি গ্রামে জমিজমা কিনে বেশ কয়েক বছর ছিলেন, অথচ তাঁর গল্পগুলোয় সেই আন্তরিকতা পাওয়া যায় না যা বিনয়ের ছোটগল্পের চরিত্রদের সঙ্গে বিনয়ের কথাবার্তায় পাওয়া যায়। শ্যামল একটি সাহিত্যিক দূরত্ব গড়ে চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করেছেন। জীবনানন্দ সম্পর্কে বিনয় মজুমদারের শ্রদ্ধা ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনের সঙ্গে এই প্রশ্নোত্তরে ফুটে ওঠে:
প্রশ্ন: আপনার মতে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি?
বিনয়: জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। (বিনয় আবৃত্তি করেন)
বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়— সে যে আরূঢ় ভণিতা;
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
বসে আছে সিংহাসনে— কবি নয়— অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই— চোখে তার অক্ষম পিচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে— আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিল— হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি।
প্রশ্ন: হাঙর মানে?
বিনয়: হাঙর মানে মনস্তত্ববিদগণ, হাঙর মানে ডাক্তারগণ, হাঙর মানে পুলিশগণ, হাঙর মানে মন্ত্রীগণ, হাঙর মানে পুরোহিতগণ। এই হাঙরদের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বেরিয়ে যাবার যোগাড়। বহু কবি মারা গিয়েছেন এদের দুর্ব্যবহারের জন্য। ভেবে দ্যাখো, আমরা পাঁচ দশকে যারা কবিতা লিখতাম তাদের মধ্যে বর্তমানে কজন টিকে আছে? জনা দশেক। তাও নয়। হাঙরেরা দিয়েছে বাকিগুলোকে শেষ করে। ফলে ভয়ে ভয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন একটু জ্বলাতন কম আছে। তবে মরে গেলেই মুক্তি পাব। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ভাসে ভাসে।
এখানে মনে করিয়ে দিই যে, বিনয় যাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েছেন, বা যারা তাঁকে অসীমের দিকে যাত্রায় বাধা দিয়েছেন, তাদের বলছেন হাঙর, মনস্তত্ববিদরা, ডাক্তাররা, পুলিশরা, এমনকি গায়ত্রীর পরিবার যে পুরোহিতের পরিবার ছিল, সেই পরিবারকেও। সময় ও বয়সের সঙ্গে কিশোরী গায়ত্রী ক্রমশ আবছা হয়ে বিনয়ের কাছে হয়ে উঠেছেন বিমূর্ত ঈশ্বরী। ২০০৩ সালে প্রৌঢ়া গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার, কবিতাটি থেকে অনুমান হয় যে, সেই কিশোরী গায়ত্রী যে তাঁকে আকর্ষণ করেছিল, সে তার স্মৃতিতে আর নেই, চাকা আর ফেরেনি:
আমরা দুজনে মিলে
আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনও আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খ্রিস্টান হয়েছ।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করা ছাটা,
ছবিতে দেখেছি আমি, দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কী জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।
(হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ)
২০১৩ সালে কলকাতায় যে লিটেরারি ফেস্টিভাল হয়েছিল, সেখানে বাংলা কবিতা আলোচনাকালে বিনয়ের কবিতাকে গায়ত্রী চিহ্ণিত করেছিলেন ‘জ্ঞানতত্ত্বের মহাকাব্য’ এবং ‘এপিসটেমলোজিকাল এপিক’ হিসাবে। গায়ত্রী পরবর্তীকালে লিখেছিলেন ‘ক্যান দি সাবলটার্ন স্পিক’; আমি বলব এর উত্তর তো বিনয় মজুমদার, যিনি সাবলটার্ন বর্ণের বলে কবিতা রচনা সত্ত্বেও জীবদ্দশায় সেরকম গুরুত্ব পাননি, যেমন পেয়েছেন তাঁর সমসাময়িক উচ্চবর্ণের কবিরা। বিনয় যে বহুবার মানসিক চিকিৎসালয়ে ছিলেন এবং তাঁকে অনেকে পাগল মনে করে, তা তাঁর চেতনায় ক্ষতের মতন থেকে গিয়েছিল। অন্যের অস্বাভাবিক আচরণকে কেন পাগলামি বলে হবে না তা তিনি লক্ষ্য করেছেন এবং লিখেছেন। ‘কয়েকটি কবিতা’র পাঁচ সংখ্যক কবিতায় কলকাতা কফি হাউসে দুটি যুবতীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে এই রচনাটি লিখেছিলেন বিনয়:
আমাদের কফি হাউসে
অন্তত দেড়শো জন লোকের সামনে বসে
একজন যুবতী একজন যুবকের হাতে হাত বোলায়
আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনায়— ‘তুমি কেমন করে
গান করো হে গুণী…’
যুবতীটি সবার সামনেই যুবকটির হাতে বহুক্ষণ যাবৎ
হাত বোলায় আর বোলায় আর বলে—’আপনি আমার
দাদার মতো।’
এবং যুবতীর বোন আরেক যুবতী কফি হাউসের
টেবিলের নীচে যুবকটির পা দুই পা দিয়ে
জড়িয়ে ধরে সবার সামনেই, কফি
হাউস ভর্তি লোকের সামনেই। এ করে প্রত্যহ।
অর্থাৎ পাঠকগণ আমার মতে সব মেয়েই একটি
‘মানসিক হাসপাতাল’
(ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য, জানুয়ারি ২০০৭) চলবে