বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ও সৌর বিদ্যুৎ বিতর্ক

মাহবুব সুমন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭

জাইকার ৪৫ বিশেষজ্ঞ ৬ বছর কাজ করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা দিয়েছেন। এ মহাপরিকল্পনার এনার্জি মিক্সে দেখানো আছে, ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌলিক শক্তির উৎস ৩৫ ভাগ কয়লা, ৩৫ ভাগ আমদানিকৃত এলএনজি ও দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস, ১০ ভাগ পারমাণবিক শক্তি, ৫ ভাগ তেল এবং ১৫ ভাগ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত থেকে আমদানি অথবা নবায়নযোগ্য শক্তি। এনার্জি মিক্স হিসেবে পাঁচ রকমের আলাদা উৎস নিঃসন্দেহে চমকপ্রদক হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। কারণ ২০৪১ সাল নাগাত বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে মূলত আমদানি করা শক্তি দিয়ে। যা আমাদের ক্রয় ক্ষমতা কমাবে, আমরা রফতানি পণ্যের উৎপাদন খরচে বিভিন্ন দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাব। জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সর্বপরি পরিবেশ ধ্বংস, মানুষের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক, মানসিক ও স্নায়ুবিক রোগের কারণ হওয়া, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস, পানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া এবং খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আমদানিকৃত জ্বালানির অর্থনৈতিক, জ্বালানি নিরাপত্তা জনিত এবং পরিবেশগত ঝুঁকির কথা বললে জ্বালানি উপদেষ্টা, বিভিন্ন মহলসহ সরকারের পক্ষ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের উদাহরণ দেয়া হয়। বলা হয়, এ দুই দেশের নিজস্ব কোন প্রাকৃতিক জ্বালানি নেই। তবু তারা অর্থনৈতিকভাবে দারুণ সমৃদ্ধ। বস্তুত জাপান ও কোরিয়ার সাথে আমাদের এ তুলনা অর্থহীন। কারণ দুটি দেশই প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে আমদানি করা জ্বালানি দিয়েও তারা প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ অন্যসকল রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের প্রযুক্তি, জ্বালানি, প্রযুক্তিবিদ ও পরামর্শকসহ সবকিছুই আমদানি করা। একারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের যে ছবি পিএসএমপি ২০১৬ তে দেখানো হয়েছে, তা বেশ ধূসর।
পক্ষান্তরে বিকল্প বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০১৭ তে যে এনার্জি মিক্স প্রস্তাব করা হয়েছে তার প্রায় ৯৫ ভাগ দেশীয় উৎস থেকে আহরিত। যার ৩৭ ভাগ দেশের বর্তমান গ্যাস মজুত, ইউএসজিএস ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টোরেটের যাচাই করা  অনাবিষ্কৃত ৯৫ ভাগ সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক গ্যাস এবং গভীর সমুদ্রের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও গভীর সমুদ্রে আমাদের কী পরিমাণ গ্যাস সম্পদ আছে, তা নিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। এরপরও আমাদের বাংলা অববাহিকার দুই পাশে আরাকান ও মহানদী অববাহিকায় বিপুল পরিমাণ গ্যাসের আবিষ্কার প্রমাণ করে, এখানেও গ্যাস সম্পদ আছে। তবে যেহেতু বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে কোনও ধরনের গ্যাস এসেসমেন্ট হয়নি, সেহেতু গভীর সমুদ্রের গ্যাস নিয়ে নিশিচভাবে কিছু বলা বা তা কোনও হিসাবে যুক্ত করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ mmcfd গ্যাসের উৎপাদন ঘাটতি আছে। এ অবস্থা দেখা দিয়েছে মূলত ২০০৪ সালের পর থেকে গ্যাস সম্পদ উন্নয়নে সরকারের তেমন কোনও পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে। এ অবস্থায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হঠাৎ বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা নাও যেতে পারে। সে দিকটিতে লক্ষ্য রেখে বিকল্প বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় আপদকালীন সংকট মোকাবিলায় (আগামী দশ বছর) প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির পক্ষে মত দেয়া হয়েছে। কারণ দেশীয় গ্যাসের বর্তমান রিজার্ভ এবং অনাবিষ্কৃত সকল গ্যাস উন্নয়ন সাধন করে জাতীয় গ্রিডে নিয়ে আসতে সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ বছর। এই দশ বছর আমদানি করা গ্যাস দিয়ে চলতে চলতে নিজস্ব গ্যাস ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে আমদানি করা এ গ্যাস উচ্চ মূল্যের এলএনজি নয়। মিয়ানমার ও ভারত থেকে সম্পর্ক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে তা দেশের মুল গ্রিডে যুক্ত করা যেতে পারে।    
বিকল্প প্রস্তাবে সবচেয়ে বেশি (শতকরা ৫৫ ভাগ) শক্তির উৎস সৌর, বায়ু ও বর্জ্য। যেখানে শতকরা ৪২ ভাগই আসছে সৌরশক্তি থেকে। সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার এ প্রস্তাব এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত। বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ বিষয়ে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ কিছু নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। ১০-১২ বছরে দেশীয় এনজিওসহ অন্যান্য বাস্তবায়নকারী সংস্থার সরবরাহ করা সোলার হোম সিস্টেম ও রুফটপ সোলারে উচ্চ মূল্য, নিম্নমানের প্যনেল, বাতি, ব্যাটারি সরবরাহ, বিক্রয়োত্তর সেবা কম দেয়া ও ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের সাথে বেশ কিছু অপ-প্রচার থেকে এসব নেতিবাচক ধারণার উদ্ভব। যেমন: ১। সৌর বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি, কথাটি সত্য নয়। ৫ বছর আগেও সৌর বিদ্যুতের দাম বেশি ছিল। ৫ বছরে সৌর বিদ্যুতের দাম এত কমে গেছে যে, তা এখন বাজার অর্থনীতির নিয়মেই অন্য উৎসগুলোর সাথে লড়াই করে টিকে আছে। বিনিয়োগকারীদের কাছে শুধু মাত্র দামের কারণে সৌর বিদ্যুৎ এখন অন্য সকল উৎসের চেয়ে বেশি লোভনীয়। ভারত, জার্মানি, চীন, দুবাই, আমেরিকার সাম্প্রতিক সোলার বিডগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, সৌরশক্তি ব্যবহার করে ২.৫০ থেকে ৩ সেন্ট অর্থাৎ ২ টাকা থেকে ২.৪০ টাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। যেখানে উন্নত মানের ব্যাটারি যুক্ত করলে দাম পড়ে সর্বোচ্চ ৪.৫ থেকে ৫ সেন্ট। অর্থাৎ ৩.৬০ টাকা থেকে ৪ টাকা। অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাই পত্রিকাসহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বলেছেন, ২ থেকে ৩ সেন্ট দামের বিষয়টা সত্য নয়। এর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। বস্তুত এর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার নাই। জমি ও প্রযুক্তির খরচ যুক্ত করে, কোনো ধরনের ভর্তুকি ছাড়াই (যা প্রচলিত কয়লা, গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দেয়া হয়) সৌর বিদ্যুতের এই বর্তমান দাম। বিনিয়োগকারীরা তাদের মার্জিন রেখেই এত কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারছে। ফলে কোনো বিনিয়োগকারী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে না। প্রচার অনুযায়ী বিষয়টি এমন নয় যে, বিনিয়োগকারী নিজের গাঁটের পয়সায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জনসেবা করছে। ফলে মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই সৌর বিদ্যুৎ বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, কয়লা, গ্যাস, তেল, পারমানবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৬ থেকে ১২ টাকা।
২। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জমি অনেক বেশি লাগে, এটিও সত্য নয়। সৌর বিদ্যুৎ দুইভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। ইউটিলিটি সিস্টেম এবং ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম। ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেমে (যেখানে বিদ্যুৎ খরচ সেখানেই উৎপাদন) সৌর বিদ্যুৎ করা হলে তা ছাদ সহ জলাভুমি, কৃষি জমিতে স্পেস শেয়ারিং টেকনোলজিতে বাস্তবায়িত হয় এবং সৌর বিদ্যুতের জন্য আলাদা জমি দিতেই হয় না। ফলে ডিস্ট্রিবিউটেড সৌর বিদ্যুৎ আসলে কোনো জমিই নিচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে জার্মানির কথা বলা যায়। যেখানে ৪২ হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুতের ৩১ হাজার মেগাওয়াটই ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেমে বাড়ির ছাদে করা। একই ঘটনা আমেরিকা ও ইংল্যান্ডেও ঘটছে। আবারস্থায়ীভাবে বরাদ্দকৃতজমি ব্যবহার করে ইউটিলিটি স্কেলের সৌর বিদ্যুৎ (এক জায়গায় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে তা গ্রিডের মাধ্যমে দূরবর্তী গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া) কেন্দ্রকরা হলে, দেশের ১ থেকে ১.৫ শতাংশ অকৃষি, অনাবাদী জমি ব্যবহার করে ২০৪১ শুধু নয়,২০৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত আমাদের চাহিদার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কৃষি বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে এটুকু পতিত, অনাবাদি জমি আমাদের আছে। যা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে`র রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরির করা জিওস্পাশাল স্টাডি ,NREL (National Renewable Energy Laboratory, USA)এবং IEEFA (Institute of Energy Economics and Financial Analysis )`র করা গবেষণায়উঠে এসেছে। ফলে সমস্যা সমাধানে ডিস্ট্রিবিউটেড এবং ইউটিলিটি দুটি ব্যবস্থাই আমাদের হাতে রইলো। বাস্তবায়নের সময় এর যেকোনো একটি কিংবা উভয়ের সমন্বয়ে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।  
৩। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় মানের সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তিনেই। বিশিষ্ট একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞের মতে, বিকল্প প্রস্তাবে যে হাই এফশিয়েন্ট সোলার প্যানেলের কথা বলা হয়েছে, তা দুনিয়ার কোথাও নেই। বিভিন্ন কোম্পানির হাই এফিশিয়েন্সির সোলার প্যানেলের দাবি বিশ্বাসযোগ্য না। আসলে চীন, জাপান, আমেরিকার অন্তত এক ডজন কোম্পানি বর্তমানে হাই এফিশিয়েন্সির সোলার প্যানেল তৈরি করছে। চাইলে যে কেউ সেগুলো খোলা বাজার থেকে ক্রয় করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সঠিক এফিশিয়েন্সি না পাওয়া গেলে মিথ্যাচারের জন্য যে কেউ আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। এধরনের পরীক্ষা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় অনেকবার হয়েছে। দেখা গেছে সেসব পরীক্ষার ফলাফল কোম্পানি উল্লেখিত এফিশিয়েন্সির সাথে মিলে যায়।
৪। দিনে মাত্র ৪.৫ ঘন্টা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, বাবি সারাদিন কিভাবে চলবে মানুষ?
সারাদিন সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে চলার অর্থ হলো, ১০০ ভাগ বিদ্যুতের যোগান সৌরশক্তি থেকে আসা। বিকল্প প্রস্তাবে সৌরশক্তি থেকে ১০০ ভাগ তো দূরের কথা, ৫০ ভাগের প্রস্তাবও দেয়া হয়নি। বিকল্প প্রস্তাবে ২০২১ সালে ৫ ভাগ দিয়ে শুরু করে ২০৩১ এ ২৭ ভাগ এবং ২০৪১ এ সৌর শক্তি থেকে ৪২ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যা অত্যন্ত রক্ষণশীল হিসাব এবং বাস্তব সম্মত। সুতরাং সৌরশক্তির আলোচনায় তর্কে জিতার জন্য `সারাদিনে`র উল্লেখ করাটা এ মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। তবে কথা হলো, ২০৪১ এর পর আমরা চাইলে ১০০ বিদ্যুৎই নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদন করতে পারবো। যার বেশিরভাগই আসবে সৌরশক্তি থেকে। এনার্জির চাহিদা এবং বাজারে পর্যাপ্ত প্রযুক্তির নিরিখে বলা যায় ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ এখনই সৌরশক্তি থেকে উৎপাদন করা সম্ভব। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমাদের দেশের কোনও কোনও জায়গায় বছরের নির্দিষ্ট মাসে দিনের ৮ ঘণ্টা কার্যকর সূর্যের আলো থাকে। কখনো ৬, ৫ এমনকি ৪ ঘণ্টাও থাকে। নির্ভর করছে জায়গাটা কোথায়, সময়টা বছরের কখন, এই দুইয়ের ওপর। সারা বছরে সারা দেশের গড় কার্যকর সূর্যের আলো পড়ার সময় হলো ৪.৫ ঘণ্টা। ২০৪১ সাল পর্যন্ত ডিমান্ড কার্ভ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দিনের মধ্যখানের সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। ঠিক ওই সময়টায়ই যেহেতু সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সেহেতু আমরা চাইলে এই ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বিদ্যুৎই সৌরশক্তি থেকে উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু পরিকল্পনাটি অধিক নির্ভরশীল (Reliable) করার জন্য এখনই ৩০ ভাগের প্রস্তাব না করে বায়ু ও বর্জ্য বিদ্যুৎকে সাথে রেখে সৌর বিদ্যুৎ ৫ ভাগ থেকে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, এই ২৫/৩০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে আনতে কোনো ব্যাটারির প্রয়োজন নেই। কারণ এখানে দিনে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিনেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাটারি লাগবে তখন যখন আমরা দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা রাতে ব্যবহারের জন্য সঞ্চয় করবো। সেই সময়টি ২০৩০ এর পর।
যেকোনও সময়ই গ্রাহক যদি ৪.৫ ঘণ্টার বাইরে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চলতে চায়, তবে তাকে ব্যাটারি ব্যবহার করতে হবে। কম দূষণ করে এবং ১০ বছর টিকে থাকে, এরকম ভালো মানের ব্যাটারির দাম বর্তমানে কিলোওয়াট আওয়ার প্রতি ১৪০ ডলার। বিশেষজ্ঞের মতে, ২০২২ নাগাত তা ৮০ ডলার বা ৬৪০০ টাকায় চলে আসবে। দেশের বাজারে এখনই ব্যাটারির দাম কিলোওয়াট আওয়ার প্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। সেই ব্যাটারি আবার এক /দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয়ে যায়, পরিবেশ দূষণ করে এবং ক্রেতাকে আবারো ৮-১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। ফলে ২০৩১ এর পর ব্যাটারি পরিকল্পনায় উন্নত মানের পরিবেশবান্ধব ব্যাটারির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যার প্রযুক্তি আছে এবং যা পণ্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে সুলভ। যদি প্রয়োজন হয় ভবিষ্যতে আমরা নিশ্চিতভাবে কম দামে শক্তিশালি, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি পাব।
৫। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যের আলো অনেক কম, এটিও ঠিক নয়। জার্মানির সাথে তুলনা করলে বিষয়টির সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া সম্ভব। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন এক অবস্থানে আছে, যেখানে জার্মানির চেয়ে কমপক্ষে দেড় গুণের বেশি সৌরশক্তি আসে। জার্মানির সর্বোচ্চ সৌরশক্তি আসে স্টুটগার্টে ৩২৫০ ওয়াট/ বর্গ মিটার/ দিন। অথচ বাংলাদেশের সর্বনিম্ন সৌরশক্তি আসে সিলেটে যা প্রায় ৪৮০০ ওয়াট/ বর্গ মিটার/ দিন। এ দুটি সংখ্যাই বলে দিচ্ছে আমরা সৌরশক্তিতে কি পরিমাণ এগিয়ে আছি। এত কম সৌরশক্তি নিয়ে জার্মানি এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করেছে। যেখান থেকে তারা বছরে প্রায় ৪০ টেরাওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সমান পরিমাণ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে স্থাপন করা হলে বছরে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৭০ টেরাওয়াট আওয়ারের বেশী। ফলে সূর্যের আলো কম বলে যে কথাটি উঠেছে তার ভিত্তি নেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২০১৫-১৬ রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশের ১০০ ভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা ৫৫ থকে ৬০ টেরাওয়াট আওয়ারের মতো। একারণে ওপরে বলা হয়েছে, আমরা যদি চাই তবে এখনই বেশিরভাগ বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে সংগ্রহ করতে পারি। এজন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা, সহায়ক নীতিমালা প্রনয়ন, আর্থিক প্রণোদনা, ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, দুর্নীতি দমন এবং মান নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী করা।