খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার

খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার

বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়

পর্ব ৮

খায়রুল এ. চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৮, ২০২২

এক সন্ধ্যায় সৌন্দর্যের নগর থেকে এসে নামলাম জ্বীনের নগরে। নয়াদিল্লির ভেতর আছে আরো সাতটি মৃত নগর। এখন যে দিল্লি আমরা দেখি এটি অষ্টম দিল্লি। শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৫০ সালের দিকে পাণ্ডবদের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে। তারপর দিল্লির বাতি আর নেভেনি কখনো, বরং বহু বর্ণে বর্ণিল হয়েছে তার ইতিহাস। বলা হয়, একটা জনপদ গড়ে উঠতে তিনটা জিনিসের প্রয়োজন— বাদশাহ্, বাদল আর দরিয়া। এর সবই ছিল দিল্লির। আর সেজন্যই হিমালয়ের দক্ষিণের এই সমতল ভূমিতে রাজত্ব করতে মধ্য এশিয়ার তুর্কি, পারসি, মোগল, মোঙ্গল আর মেসিডোনিয়ার আলেকজেন্ডারসহ হালের পর্তূগাল, ফরাসি আর বৃটিশরাও ইতিহাসের বিভিন্ন কালে তাদের পায়ের চিহ্ন রেখে গেছে এখানে।

স্থানীয় কাশ্মিরী, পাঞ্জাবি, রাজপুত, মারাঠা— আর্য আর অনার্যের মেলবন্ধন হয়েছে এখানে। হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ধর্মের সাথে মধ্য এশিয়া থেকে এসে মিশেছে ইসলাম। সাড়ে তিন হাজার বছরের দিল্লির জনপদের ইতিহাস যেমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ভূবনবিখ্যাত রাজন্যের কীর্তিতে দীপ্তিমান, তেমনি এখানেই জন্ম হয়েছে উর্দূ ভাষার, সৃষ্টি হয়েছে মির্জা গালিব,  আমির খসরু, মীর ত্বকির কালজয়ী অমর উর্দূ গজল, কবিতা, শায়ের। হাজার বছর ধরে দিল্লি একটা বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক মিলনকেন্দ্র হিসাবে কাজ করছে। ভারতের সব অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা থাকলেও এদেশের সবাই নিজের মাতৃভাষার মতোই হিন্দি ভাষাটাও জানে। ভিন দেশ-ধর্মের লোকের যোগাযোগের মাধ্যম হিন্দি।

আঞ্চলিক ভাষাগুলো শাসকদের সাথে নিয়ে আসা চুগতাই, তুর্কি, ফারসি আর উপনিবেশিক কালের ইউরোপিয় ভাষা থেকে অনেক শব্দ নিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করেছে। মানুষ আর ভাষার এই অপূর্ব মিলন পৃথিবীর অন্যত্র বিরল। নয়া দিল্লির ভেতরে ছড়ানো মৃত সাত প্রাচীন নগর একে যেমন রহস্যময় করেছে তেমনি ইতিহাস, ভাষা ও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছেও এটি হয়ে আছে এক জীবন্ত জাদুঘর।

প্রথম দিন দেখা হলো হুমায়ুনের সমাধি কমপ্লেক্স। এখান থেকেই ভারতে মোগলদের শুরু, এখানেই সমাপ্তি তাদের। মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন বাবর করলেও দিল্লির চেয়ে আগ্রা বেশি পছন্দ ছিল তার। তিনি নিজে কোনো কিছু নির্মাণও করেননি তার স্বল্পকালে, থেকেছেন ইব্রাহিম লোদির আগ্রা দূর্গেই। শেষ শয্যা হয়েছে তার কাবুলে। কিন্তু হুমায়ুন তার দিনপানাহ (বিশ্বাসীর আশ্রয়) গড়ে তুলেছিলেন দিল্লিতেই। শেষ মোগল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ্ উন্মত্ত ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা নেই জানার পর লাল কিল্লা ছেড়ে পরিবার পরিজনসহ অসহায় আশ্রয় নেন এখানেই। আঠারোশো ৫৭ সালের নির্মম সেই পরাজিত দিনগুলোয় এখানেই রচিত হয়েছে মোগলদের করুণ অন্তিম অধ্যায়।

দারা শিকোহসহ মোগল বংশের শতাধিক রাজন্যবর্গের কবর রয়েছে এখানে। তাই এটিকে শেষ মোগল গণবিছানাও dormitory বলা হয়। মোগলরাই প্রথম ভারতে বাগান-কবরের প্রচলন করেন। বিশাল বাগানঘেরা সমাধি কমপ্লেক্সটিতে এলে মনে প্রশান্তি আসে। অনিত্য জীবনের ভাবনা উঁকি দেয় মনে।

পাশেই হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (১২৩৮-১৩২৫) দরগাহ। মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের শিষ্য নিজামউদ্দিন ভারতবর্ষে চিশতিয়া তরিকার প্রধান সুফি সাধক। দিল্লি বহু দূর কথাটি তার প্রসঙ্গেই জনশ্রুতি হয়ে আছে। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ১৩২০ সালে যখন দিল্লির দ্বিতীয় নগর তুঘলকাবাদ নির্মাণ করছিলেন একই সময় নিজামউদ্দিনও তার দরবার সংলগ্ন জায়গায় একটি কূপ খনন করছিলেন। সুলতান চায়নি শ্রমিকরা নিজামউদ্দিনের জন্য কাজ করুক। তবুও শ্রমিকেরা রাতে কাজ শুরু করলে সুলতান দিল্লিতে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধের আদেশ দিল যাতে শ্রমিকরা রাতে কাজ না করতে পারে। এদিকে বাংলার বিদ্রোহ দমন করে গিয়াসউদ্দিনের দিল্লি ফেরার সময় হলে তিনি নিজামউদ্দিনের ওপর চড়াও হতে পারেন, এ ভয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন তখন নিজামউদ্দিন বলেছিলেন, দিল্লি বহু দূর।

গিয়াসউদ্দিন দিল্লির উপকণ্ঠে এলে অভ্যর্থনা তোরণ ভেঙে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, নিজাম উদ্দিন অভিশাপ দিয়েছিলেন এই তুঘলকাবাদ হয় মরু হবে, না হয় যাযাবরদের আস্তানা হবে। তুঘলকাবাদের অস্তিত্ব আজ আর টিকে নেই। ভারতের মহান সুফি সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়া ভারতবাসীকে সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান ও সহজ জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। ভালোবাসা আর দয়া— এ ছিল নিজাম উদ্দিনের মূল কথা। দুঃখি, ক্ষুধার্ত, ন্যায় বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন সব সময়। এখানে এলে দেখা মেলে কত অসহায় মুখ, কত শত মানুষ তার দুঃখ, বেদনা আর বিচারের আশায় ফরিয়াদ নিয়ে ছুটে এসেছেন নিজামউদ্দিনের দরগায়। তার সমাধির পাশেই শেষ শয্যায় শায়িত আছেন সুফি গায়ক, কবি আমির খসরু আর শাজাহান কন্যা জাহানারা বেগম।

তারপর গেলাম লাল কিল্লার পাশে জামে মসজিদে। সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন মার্বেল পাথরের বিশাল এই লাল মসজিদটি। আঠারশো ৫৭ সালে বাহাদুর শাহের পরাজয়ের পর অনেক মর্মান্তিক ইতিহাসের স্বাক্ষি এ মসজিদটি। প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দেখতে আসলেও নিদারুন অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে মসজিদটি এখন, দেখে মনে হলো বোধহয় এখানে এখন আর নামাজ পড়া হয় না। অনেক জায়গায় মেরামতের কাজ চলছে দেখা গেল। মসজিদে ঢোকার রাস্তাগুলো গুলিস্তানের মতো হকারদের দখলে। পরিবেশ ভীষণ অপরিচ্ছন্ন। বোঝা যায়, জায়গাটি এখন অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে আছে।

তারপর দেখা হলো পাশের চাঁদনী চক। লাল কিল্লা, জামে মসজিদ, চাঁদনী চক এগুলো সবই কাছাকাছি। চাঁদনী চক নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শাহজানের প্রিয় কন্যা জাহানারা বেগম। একটা লেকের দুই পাশে বানানো হয়েছিল এ রাজকীয় বিকিকিনির হাট। মোগল নির্মাণের আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ এ মার্কেট এখন তার জোলুস হারিয়েছে। সেই লেক ভরাট করে ইংরেজরা এখানে সড়ক বানিয়েছে। দোকানের কাছ দিয়ে যাবার সময় দোকানদাররা টানাটানি করে। বিদেশি দেখলে চিনে ফেলে তাদের অভ্যস্ত অব্যর্থ চোখ। আমদেরকেও সবাই এটাওটা বোঝাচ্ছিলো, যদিও শুধু দেখতেই এসেছি আমরা, কিনতে নয়। একজন শিখ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন আমাদের পাশ দিয়ে। চুপিচুপি আমাদের সাবধান করে দিলেন— এরা এজেন্ট, খদ্দের এনে কমিশন পায়। এদের কথা শুনো না, কিছু কিনতে হলে তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নাও। তাকে ধন্যবাদ দিলাম।

দিল্লির সাতটি কিংবদন্তি নগরেরে প্রথমটির নাম লালকোট। রাজা অনঙ্গপাল তোমার এটি নির্মাণ করেছিলেন ১০৫২ সালে। এগার শ ৯২ সালে গজনির সুলতান মোহাম্মদ ঘোরি এটি জয় করে তার এক সময়ের ক্রিতদাস কুতুব উদ্দিন আইবেককে এর শাসক নিয়োগ করেন। কালক্রমে দিল্লিতে অনেক বিখ্যাত নগর গড়ে উঠে বিস্মৃতির অতলে হারিয়েও গেছে। সিরি, তুঘলকাবাদ, জাহানপানাহ, ফিরোজাবাদ, দিনপানাহ ও শাহজাহানাবাদে এক সময় মানুষ  বাস করেছে এবং পরিত্যক্তও হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের ৬৬৪ বছরের ভারত শাসনের ইতিহাসে কখনোই গুরুত্ব হ্রাস পায় নি  লাল কোটের কুতুব কমপ্লেক্সের। কুতুব উদ্দিনের কুতুব মিনার এখন দিল্লির লোগো এবং ভারতের রাজধানী এখন এ পরিচয়েই পরিচিত। এই লালকোটেই সমান্য ক্রিতদাস থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন কুতুব উদ্দিন আইবেক, ইলতুতমিশ এবং বলবন। মানুষের অদম্য আকাঙ্খা, ক্লান্তিহীন জীবন সংগ্রাম আর অদম্য কর্মশক্তি এবং শেষ পর্যন্ত সালতানাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফল উত্থানের নীরব স্বাক্ষি এই লাল কোট।

এই সেই লাল কোট যেখানে সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে এসে ভারতের প্রথম নারী সুলতান হিসাবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন সুলতানা রাজিয়া। সেই মধ্যযুগে পর্দা প্রথাকে অস্বীকার করে জনসমক্ষে উপস্থিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে জন্য লাল কোট নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবেও পরিচিত।

কুতুব মিনারের পর দেখা হল হাউজ খাস। দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গাটা খুব জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এখানেই আছে পুরনো দিল্লির আরেক মৃত শহর ‘সিরি’! উর্দূতে হাউজ মানে ট্যাংক আর খাস মানে রাজকীয়, অর্থাৎ রাজকীয় জলাধার। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি এখানে গড়ে তুলেছিলেন তার সিরি নগর। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন একটা জলাধার আছে এখানে। ভারতের প্রথম মাদ্রাসা ছিল এ নগরে। এখানে সমাধি আছে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ও আলাউদ্দিন খিলজির।

এ যাত্রায় সবশেষ দেখা হলো জ্বীনের শহর ও কোটলা ফিরোজ শাহ্। বিখ্যাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম ফিরোজ শাহ্ কোটলার পাশেই অবস্থান দিল্লির পঞ্চম নগর কোটলা ফিরোজ শাহ্’র, যা জ্বীনের শহর নামেও বিখ্যাত। সহৃদয় পাঠক এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম ডালরিম্পলের দ্য সিটি অব জ্বীনস পড়তে পারেন। তেরশ ৫৪ সালে বিশাল এলাকা জুড়ে সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুঘলক নির্মাণ করেছিলেন এ নগর যার কঙ্কাল ছাড়া তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই আর। ইতিহাসখ্যাত সম্রাট অশোকের একটি স্তম্ভ এখানে সংরক্ষণ করেছেন ফিরোজ শাহ্। এখানে এলে দেখা মিলবে দুই হাজার বছরের বেশি বয়সি এ স্তম্ভটির। রহস্যে মোড়া একটা মসজিদ আছে এখানে। তের শ ৯৮ সালে দিল্লি বিজয়ি তৈমুর লং বিশাল এই মসজিদের স্থাপত্য কৌশলে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে রাজমিস্ত্রি নিয়ে সমরখন্দে অনুরূপ আরেক মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বলা হয় জ্বীনরা তখন এসে মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে থাকে। জ্বিনদের উদ্দেশে চিঠি লিখে তাদের কাছে প্রতিকার চায় মানুষ।

গা ছমছম করা এক হাজার বছর আগের পরিত্যক্ত এ নগরটি দিল্লির অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। অনেকবারের চেষ্টায় এবার আমরা দেখতে পেলাম এ জায়গাটি। সময় হল দেশে ফেরার কাল চলে যাব, কিন্তু দিল্লির আকর্ষণ কখনো শেষ হবে না। বারবার আসতে হবে এখানে। চলবে