বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়
পর্ব ৭
খায়রুল এ. চৌধুরীপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২২
ভারত স্বাধীন হবার কিছু আগে থেকে পাঞ্জাবের শিখরা তাদের ধর্ম রক্ষা আর অধিকার আদায়ের দাবিতে শিরোমানি আকালি দলের নেতৃত্বে যে পাঞ্জাব সুবাহ আন্দোলন শুরু করে তারই ফলশ্রুতিতে ইন্ডিয়া রিঅরগানাইজেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধির সময়ে ১৯৬৬ সালে হিমাচল প্রদেশকে কিছু অঞ্চল দিয়ে পাঞ্জাব ভাগ হয়ে হিন্দু প্রধান এলাকা নিয়ে হরিয়ানা এবং শিখ প্রধান এলাকা নিয়ে পাঞ্জাব রাজ্য গঠিত হয়। আবারো ধর্মকে কেন্দ্র করে ভৌগলিক সীমানার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সীমানার সৃষ্টি করা হলো। শিখরা নিজেদের রাজ্য পেল বটে, কিন্তু শুরু হলো অস্তিত্বের নতুন সংগ্রাম।
চন্ডিগড়কে করা হল পান্জাব ও হরিয়ানা এ দুই রাজ্যেরই রাজধানী, এলো কেন্দ্রশাসিত ইউনিয়ন টেরিটোরির আওতায়। রাজধানী ভাগাভাগি শিখদের একেবারেই মনপূত হয়নি। হিন্দু বলতে শিখ এবং বৌদ্ধদেরকেও বোঝাবে এবং শিখদের বিয়ে তাদের রীতিতে হলেও রেজেস্ট্রি করতে হবে হয় হিন্দু কিংবা বিশেষ রেজিস্ট্রি আইনে, সংবিধানের এই ২৫ ধারার ২ (বি) অনুচ্ছেদটি শিখদের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। যে হারে পাঞ্জাবের রাভি, বিয়াস ও সুতলেজ নদীর পানি পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্হানের মধ্যে ভাগাভাগি করা হল তাও মেনে নিতে পারেনি শিখরা। আরও স্বায়ত্বশাসন ও কেন্দ্রের পরিবর্তে রাজ্যের কাছে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করলো আকালি দল।
যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি সহ প্রবাসী ধনী শিখদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীন খালিস্তানের দাবিতে শুরু হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। ভারত-পান্জাব, পাকিস্তান-পান্জাব এবং চন্ডিগড়কে নিয়ে নতুন শিখ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজিত হবার পর পাকিস্তানও শিখদের এ আন্দোলনে মদদ দিতে থাকে। উগ্রপন্থী শিখ নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে আশির দশকের শুরুতে উগ্রপন্থীদের জঙ্গী তৎপরতা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেলে ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের মাধ্যমে অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়ে তা দমনের চেষ্টা করা হয়।
রক্তপাত যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে না বরং সমস্যাকে আরো গভীর করে তোলে একথা আবারো প্রমাণ হলো স্বর্ণ মন্দির অভিযানের পর। এ অভিযানের প্রতিশোধ হিসাবে সে বছরই হত্যা করা হয় ইন্দিরা গান্ধিকে। ফলশ্রুতিতে পুরো উত্তর ভারত জুড়ে শিখ বিরোধী যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে তার লেলিহান আগুনে পুড়ে মরে হাজার হাজার শিখ প্রাণ। আরো জঙ্গী রূপ লাভ করে শিখদের সংগ্রাম। উনিশশো ৮৫ সালে একই দিনে আয়ারল্যান্ড ও জাপানে বিমান বিস্ফোরণে শত শত মানুষ হত্যা, ১৯৮৭ সালে ট্রেনে এবং ১৯৯১ সালে বাসে আগুন দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যাসহ ব্যাপক জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে শিখরা।
একপর্যায়ে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পান্জাব বিধান সভায় ১৩টির মধ্যে ১০টি আসনেই জয়লাভ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে কেন্দ্র থেকে নির্বাচন বাতিল করে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় পূননির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে কংগ্রেস সরকার কঠোর পথ অবলম্বন করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখ আপাতত বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে শিখদের একটা বড় অংশই বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, এ রক্তপাত কোনো সমাধানের দিকে নিচ্ছে না, বরং দূর্বল করছে নিজেদেরই। কাশ্মিরীদের মতো তাদের মধ্যেও আছে রাজনৈতিক দোলাচল, ধর্মীয় ও জাতিগত অস্তিত্বের সংকট এবং হতাশা।
কঠিন শাসনের বজ্রআঁটুনি এখনো বিদ্যমান চন্ডিগড়, পাঞ্জাবে। সেজন্য বিমানবন্দরে ছবি তোলার এ নিষেধাজ্ঞা। সেজন্য পাঞ্জাবের বিধানসভার অধিবেশনে চলাকালীন নিরাপত্তা ঘেরাটোপে লো কহবুসিয়ের ‘খোলা হাত ভাস্কর্য’ দেখা থেকে বঞ্চিত থাকে সাধারণ মানুষ। সংবিধানের ২৫, ২ (বি) ধারা এখনো বলবৎ আছে। সেজন্য রাজস্থানি গাড়িচালক বলছে শিখ, বৌদ্ধ সবার মূলেই আছে হিন্দুত্ব। আশার কথা, তিনি বলছেন সব মানুষই এক, সবার পরিচয় একটাই— আমরা সবাই মানুষ!
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিচারে চন্ডিগড় পৃথিবীর অন্যতম এক নগর। নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রদর্শনী এবং গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতীয় জলবায়ুর রুদ্রতা প্রশমন করতে যেভাবে এখানে ফুল ও বৃক্ষের ব্যবহার করা হয়েছে তা যেন এক জীবন্ত ল্যাবরেটরি। স্থাপত্যকলা এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্রদের এখান থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। চলবে