বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়
পর্ব ৫
খায়রুল এ. চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২২
আজকে আর সকাল নয়, খুব ভোরে রওনা দিলাম পেহেলগামের পথে। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশা নেই, ঠাণ্ডা বাতাস নেই, সূর্য আছে, কিন্তু গায়ে শীত লাগছে বেশ। শ্রীনগর থেকে পেহেলগামের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে। দিনে দিনে ফিরে আসবো তাই একটু আগেভাগে রওনা হলাম। শ্রীনগর থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠেছি। রাস্তার দুই পাশে চিনার আর উইলোর বীথি। আমাদের বামে জাবারওয়ান পর্বত, ডানে বয়ে চলেছে ঝিলম নদী।
পেহেলগাম মানে রাখালগাঁও, কাশ্মিরী ভাষায় puheyl মানে রাখাল, puheyl থেকে pahalgam এসেছে। স্থানীয়রা একে পেহেলগাম বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার দুশো ফুট উঁচু জায়গাটি কাশ্মিরের আরেকটি বিখ্যাত হিল স্টেশন। এখানকার বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি আর নিটোল জল নিয়ে পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা লিডার নদী যাযাবর বকরওয়ালদের খুব প্রিয়। এখানে দেখা মিলবে এই বকরওয়ালদের— বিশাল ভেড়ার পাল নিয়ে যাচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে, সাথে আছে দশ-বারোটা ঘোড়ার বহর। পাহাড়ের গায়ে মেষগুলো যখন নির্বিকার ঘাস খেয়ে চড়ে বেড়ায় তখন এগুলো কীভাবে নিচে পড়ে না গিয়ে খাড়া পাহাড়ের গায়ে নিজেদের আটকে রাখে তা খুব আশ্চর্য লাগে। মনে হয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন কাজ করছে না এদের বেলায়! জীবিকা হিসাবে মেষপালন পৃথিবীর আদিবৃত্তি যা এখনো টিকে আছে। কাশ্মিরের হিল স্টেশনগুলোর সবুজ তৃণভূমিতে মেষ চরানো এই যাযাবর বকরওয়ালদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানা অনেক আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে।
পেহেলগাম তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত হলেও অমরনাথ যাত্রার জন্যও জায়গাটি বিশেষভাবে পরিচিত। প্রতি বছর জুলাই-আগস্ট মাসে এখান থেকেই তীর্থযাত্রীরা ১২ হাজার আটশ ফুট উচ্চতায় অমরনাথ যাত্রা শুরু করেন। তখন বেসক্যাম্প হিসাবে তারা পেহেলগামকে ব্যবহার করে থাকেন। গল্প আছে, পার্বতিকে অমরত্বের গুঢ় তত্ত্ব বলার জন্য শিব এই অমরনাথ গুহাকেই বেছে নিয়ে ছিলেন। সেখানে যাবার সময় তারা পেহেলগামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কয়েকটি জায়গায় যাত্রা বিরতি করেছিলেন। অমরনাথ মন্দিরে প্রবেশের আগে শিব তার বাহন নন্দিকে এখানে রেখে গিয়েছিলেন। একটা ষাঁড়ের রূপ ধরে নন্দি এখানেই থেকে গিয়েছেন। এজন্যই পেহেলগাম থেকে আমরনাথ যাত্রা শুরু হয়।
হাইওয়ে ছেড়ে আমরা বিজবেহারা শহরে প্রবেশ করলাম। শহরের অভ্যর্থনা তোরণে লেখা, ওয়েলকাম টু চিনার টাউন। আশ্চর্য হলাম দেখে যে, পুরো একটা শহরই চিনারকে উৎসর্গ করে রেখেছে কাশ্মিরীরা। চিনারকে এতোই ভালোবাসে তারা! বিজবেহারা থেকে বের হয়ে চলছি পেহেলগামের পথে। দুই পাশে ঘন আপেল বাগান। লাল লাল আপেল ঝুলে আছে বাগানে। এ দৃশ্য বর্ণনাতীত। সব বাগানেই টাটকা জুস পানের ব্যবস্থা আছে। বাগানে বসে চিনি, প্রিজারভেটিভ ছাড়া আপেল জুস খেতে কার না মন চায়! আমরাও হাতছাড়া করলাম না সুযোগটা। প্রতি গ্লাস পঞ্চাশ রুপি। বাগানতাজা আপেলরসের স্বাদ বাকি জীবন মনে থাকবে এ কথা বলাই যায়। আপেল চাষ কাশ্মিরীদের অন্যতম প্রধান জীবিকা। প্রায় সাত লক্ষ লোক সরাসরি কাজ করে এ সেক্টরে এবং তিরিশ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আপেল চাষের ওপর। পরপর গত দুই বছর অগ্রিম তুষারপাতের কারণে ফলন ভালো হয়নি। তাছাড়া বাজারে আপেলের দামও কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। তুরুস্কের আমদানি করা আপেলের সাথে প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে কাশ্মিরী আপেল।
এদিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশে রপ্তানি করা আপেলও সীমান্তে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় পচে গিয়ে খামারিরা কয়েক বছর ধরে লোকশানের মুখে পড়েছে। আপেল চাষকে কেন্দ্র করে কাশ্মিরে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় আপেলকে ফল থেকে পণ্যে রূপান্তরিত না করতে পারায় কাশ্মিরের আপেল চাষ এখন বড় সমস্যার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
পৌঁছে গেছি পেহেলগাম। স্হানীয় কর্মসংস্থানের জন্য আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, এসব ট্যুরিস্ট স্পটে যেতে হলে নিজের গাড়ি ছেড়ে নির্ধারিত দামে এখানকার গাড়ি নিতে হয়, আমরাও নিলাম। যাবো শুধু আরু আর বেতাব ভ্যালি। প্রতিটি স্পটে যেতে আধা ঘন্টার মতো সময় লাগে। ভ্যালিগুলোতে যাবার রাস্তাগুলি বেশ ভীতিকর, উচ্চতাভীতি থাকলে অবস্থা বেশ করুণ হয়ে উঠতে পারে। তবে চৌকস গাড়িচালকদের ওপর আস্থা রাখলে দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ্যই হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভ্যালিগুলো এমনিতেই সাত হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় তার ওপর সেখানে দাঁড়িয়ে উপরের পাহাড়চূড়ায় তাকিয়ে প্রথমে মনে হল যেন পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঘুমিয়ে আছে মেঘ। কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা গেল এগুলো জমে থাকা তুষার! পাহাড় চূড়ায় বরফ দেখে, সবুজ তৃণভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করে আর দূর্লভ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখতে অসাধারণ কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম পেহেলগাম। এখানে বেশ কিছু অল-ভেজ রেস্তোঁরা আছে। অসাধারণ রান্না তাদের। লাঞ্চটা এগুলোর একটাতেই সেরে শ্রীনগরের পথ ধরলাম।
দুপুর পড়ে এসেছে, বিকালের কোমল রোদ বাইরে। দুই পাশে বিশাল পাহাড়, এর ভেতর দিয়ে ফিরে চলেছি আমরা। বাম পাশে আমাদের সাথে সাথে বয়ে চলেছে পেহেলগামরাণী লিডার নদী। বিজবেহারা পার হয়ে সংগম নামে একটা জায়গা আছে। এখানে তৈরি হয় পৃথিবী বিখ্যাত উইলো গাছের কাঠের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট। একটা কারখানায় নামলাম আমরা। ভেতরে প্রবেশ করে বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি, কিনবো না, শুধু কারখানাটা ঘুরে দেখতে চাই। এক কথায় সানন্দে রাজি হয়ে গেল ম্যানেজার। নিজেই ঘুরেফিরে সব দেখালো আমাদের, ছবিও তুলতে দিল।
কাশ্মিরের জাফরান পৃথিবী বিখ্যাত। এক কেজির দাম আড়াই লক্ষ রূপি। জাফরানকে হিন্দিতে কেসার আর ইংরেজিতে স্যাফরন বলে। কাশ্মিরের পমপুরায় চাষ হয় এই জাফরান, আর জায়গাটি আমাদের পথেই পড়ে। পমপুরার একটা দোকানে থেমে ১ হাজার দুইশ পঞ্চাশ রূপিতে ১০ গ্রাম জাফরান কিনলাম স্মারক হিসাবে। দোকানি আমাদের কাহাবা চা দিয়ে আপ্যায়ন করলো। বাদাম দিয়ে বানানো কাশ্মিরী কাহাবা চা পান করতে বেশ সুস্বাদু, দেশে ফিরে চেষ্টা করতে হবে। পেহেলগাম কাশ্মিরের অন্যতম সুন্দর দর্শণীয় স্থান। ট্রেকিংয়ের জন্য আদর্শ। কয়েক কিলোমিটার ভেতরে গেলে দেখা মিলবে কলোহই গ্লেসিয়ারের। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এই গ্লেসিয়ার ঝুলে আছে হিমালয়ের কলোহই চূড়ার নিচে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে এই গ্লেসিয়ার।
প্রতি বছর এতো পর্যটক আসে এখানে যে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন পর্যটন কর্তৃপক্ষের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে মনে হলো পাহাড়ের বোধহয় কোনো সম্মোহন আছে, নাহলে মানুষকে এতো টানে কেন? কিসের টানে ছুটে আসে মানুষ পাহাড়ের কাছে? তবে কী পাহাড়ও কথা বলে, একান্তে! যুগযুগ ধরে সুফিরা সাধকরা পাহাড়েই খুঁজেছেন নির্বাণ। শিব তার অমরত্বরের বাণী পার্বতিকে বলেছিলো এই পাহাড়ের গুহায়। আবার আসবো আমি পাহাড়ে! চলবে