বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়
পর্ব ২
খায়রুল এ. চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
শ্রীনগরে আমরা উঠেছি ডাল লেকঘেঁষা বুলভার্ড রোডের পাশে একটা হোটেলে। কাশ্মির ঘুরে দেখতে আগে থেকেই ড্রাইভার ঠিক করা ছিল। ইনোভা জিপ নিয়ে এসেছে সে। সকাল সকাল রওনা দিলাম দুধপত্রীর উদ্দেশে। ওখানে শালিগঙ্গা নদী আর দুধধোয়া তৃণভূমি দেখতে যাব। দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার, যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগবে।
দুধপত্রী নিয়ে একটা কিংবদন্তি আছে, গল্প শুরু করে ড্রাইভার ফাইয়াজ আহমেদ। শেখ নুর উদ্দিন নূরানি নামের একজন কামেল একবার এখানে এসে নামাজ পরার জন্য অজুর পানি পেতে উপত্যকার মাটিতে লাঠির আঘাত করলে সেখান থেকে দুধ বের হয়ে আসে। এ থেকেই জায়গাটির নাম হয়েছে দুধপত্রী। শ্রীনগর পার হয়ে বড়গাম জেলার শেষ প্রান্তে দুধপত্রী। বড়গাম মানে বড় গ্রাম। কাশ্মিরী ভাষায় গ্রামকে ‘গাম’ বলে। আর গ্রামে থাকে যারা তাদের বলে ‘গামুক’, বাংলায় কী বলে তা চিন্তা করে যুৎসই কিছু মনে এলো না।
কাশ্মিরীদের নিজস্ব ভাষা আছে। উর্দুর মতোই আরবি হরফে লেখা হয় কাশ্মিরী ভাষা। ফাইয়াজ বলল, স্কুল কলেজে হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি কাশ্মিরীতেও পাঠদান করা হয়। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমরা পথ চলি, জানতে চাই কাশ্মির সম্পর্কে। পেছনের সিটে বসা স্ত্রী কন্যারাও মনযোগ দিয়ে শুনে আমাদের কথপোকথন।
কাশ্মিরীরা বিদ্যাশিক্ষায় ভারতীয় অপর জাতিগোষ্ঠিগুলোর তুলনায় অনেক প্রাগ্রসর। স্বাক্ষরতার হার গড় ভারতীয়দের চেয়ে অনেক বেশি। পুরো ভারতে স্বাক্ষরতার হার যেখানে শতকরা ৭৪ ভাগ, কাশ্মিরে তা ৮৫ ভাগের ওপর। ডিপিএস, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল, প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট হাই স্কুলসহ আরো বেশ কটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্যাম্পাস আর স্কুলবাসও দেখলাম পথিমধ্যে।
অনেক কাশ্মিরী ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর বাংলাদেশে যায় চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে। তাই এতদিন আমার ধারণা ছিল, কাশ্মিরে বোধহয় পড়ালেখার ভালো ব্যাবস্থা তেমন একটা নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো ইউনিভার্সিটি নাই? অবাক হলো সে। বলল, কাশ্মির ইউনিভার্সিটির নাম তুমি শোনো নাই! সব সাবজেক্ট পড়ানো হয় এখানে।
বড়গাম শহরটা পার হচ্ছি। কাশ্মিরের এত ভেতরে এতবড় একটা শহর আর লোকজনের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কাশ্মিরের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত কৃষিভিত্তিক। প্রচুর আপেল, আখরোট, কাজুবাদাম আর মূল্যবান জাফরান উৎপাদন হয় এখানে। পশমিনা শালের জন্য কাশ্মির পৃথিবী বিখ্যাত। হর্টিকালচার কাশ্মিরীদের আরেকটি অন্যতম আয়ের উৎস। সবকিছু ছাপিয়ে পর্যটনই কাশ্মিরীদের আয়ের প্রধান উৎস। বিরাট সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান হয়েছে এ খাতে।
বড়গাম শহরে ঢোকার মুখে ফাইয়াজ জানালো, এখানে মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকরা বাস করে। পুরো কাশ্মিরে শিয়ারা সংখ্যায় বেশি নেই, অল্পসংখ্যক যা আছে তারা সবাই এখানে বাস করে।
দুধপত্রীর প্রবেশমুখে দেখা যায় অদূরে হিমালয় পর্বতের পূবশাখার বিশাল পাহাড় শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে অবিচল। তার মাথায় মুকুটের মতো খেলা করছে মেঘরাশি। জানালা দিয়ে হাত বাড়াতেই বাইরের শীতল বাতাস টের পেলাম। পাহাড় জুড়ে পাইন আর দেওদার গাছ দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো। গাছগুলো একহারা, লম্বা, পাহাড়ের মতো ঋজু। সামনে পান্না-সবুজ ঘাস বিছানো বিশাল খোলা মাঠ। একটু দূরে পাহাড়ি পথ বেয়ে এগুলে শালিগঙ্গা নদী, উপত্যকার পাথুরে পথ বেয়ে নেমে এসেছে।
গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়ায় চেপে শালিগঙ্গার কাছে গেলাম। দূর থেকে শালিগঙ্গার পাথরভাঙা জল গড়ানোর একটানা শব্দ শোনা যায় পাহাড়ের নিস্তব্ধতা চিরে। ফেরার পথে কালাই রুটি আর মাসালা চায়ের স্বাদ নিলাম। পথে একটা রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার খেলাম। ওয়েটারটা খুব মজার। আমার কাছে বাংলাদেশি যেকোনো নোট চাইলো স্মারক হিসেবে। একটা একশ টাকার নতুন নোট উপহার পেয়ে খুব খুশি হলো। রেস্তোঁরার পাশে দেখলাম একটা আপেল বাগান। জীবনে প্রথম স্বচক্ষে গাছে আপেল দেখলাম। সত্যি কিনা পরীক্ষা করতে হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখা হলো।
ফেরার সময় ফাইয়াজের কাছে জানতে চাইলাম, কাশ্মিরীরা কি চায়— স্বাধীন রাষ্ট্র, নাকি পাকিস্তানের সাথে মিলতে? সে বলল, আমরা ইন্ডিয়াতেই থাকতে চাই, কিন্তু অন্য প্রভিন্সগুলো যেমন স্বাধীনতা ভোগ করে, তেমন স্বাধীনতাই আমরা চাই। বললাম, কাশ্মিরীদের তো বেশ কটি পার্টি আছে, কোন দল ক্ষমতায় এলে ভালো হবে মনে কর তুমি? ‘কোনো দলই ভালো না, ক্ষমতায় এলে নিজেদের লোক ছাড়া অন্যদের কোনো কাজে লাগে না, তারচেয়ে কেন্দ্রের সরকারই ভালো’— ফাইয়াজের জবাব দ্ব্যর্থবোধক, অনিশ্চিত— যেমন অনিশ্চিত কাশ্মিরীদের রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। চলবে