বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়
পর্ব ১
খায়রুল এ. চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
ঢাকা থেকে সকালে রওনা দিলাম। দিল্লি হয়ে শ্রীনগর যাচ্ছি। আড়াই ঘণ্টা পর পৌঁছবো দিল্লি। প্লেন ছাড়ার আগে সবসময় জরুরি মুহূর্তে কীভাবে লাইফ ভেস্ট পরে অক্সিজেন মাস্ক মুখে লাগায়ে জীবন বাঁচাতে হবে, বিমানবালারা তা দেখান। অনেকবার প্লেন চড়া হয়েছে, কিন্তু নিয়মটা আর শেখা হয়নি। এখন আর নির্দেশনাগুলি মনযোগ দিয়ে শোনা হয় না। তবে বিশ্বাস করি, সমস্যা যদি কিছু হয়ই তখন সবার যা হয় আমার কপালেও তাই হবে। কিন্তু একটা বিষয় এখনও রহস্য রয়ে গেছে, প্লেনে সমস্যা হলে লাইফভেস্টটা পরে কি আকাশে লাফ দিয়ে বাঁচা যাবে, নাকি প্লেনটা সাগরে পড়লে পানিতে ভেসে থাকতে সাহায্য করবে ভেস্টটা— তা ঠিক জানা নেই। মজার ব্যাপার হলো, এ কথাটা শুধু প্লেনে চড়ার সময়, আরো নির্দিষ্টভাবে বললে, বিমানবালাদের নির্দেশনা দেয়ার সময়ই কেবল মনে পড়ে এবং এরপর যথারীতি ভুলে যাই।
কোলকাতা, রাঁচি, বারানাসিকে বামে রেখে পাটনা, লক্ষ্ণৌর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় তিনশো মাইল বেগে সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে প্রায় নয়শো মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্রের একটানা গর্জনের মতো শোঁ শোঁ শব্দ করে ডানে-বামে দোল খেতে খেতে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নামছে প্লেন। প্লেনের ভেতর সবসময় শোঁ শোঁ একটা শব্দ কানে লাগে— সাগরের একটানা গর্জনের মতো। সাগরের গর্জনে কোথায় যেন একটা প্রাণ আছে, জীবন্ত মনে হয়। কিন্তু প্লেনের একঘেঁয়ে শব্দটা ভাবায় না, আমাদের গতিমান করে।
প্লেনটা নামার সময় জানালার পাশে বসা কয়েকজন নিচের দৃশ্যের ভিডিও করছে, আমার পাশের লোকটিও করছে। পাখির চোখে পৃথিবী দেখাটা সত্যি অনেক রোমাঞ্চকর। টারমার্কের এদিক সেদিকে অনেক প্লেন দাঁড়ায়ে আছে, কোনোটি টেকঅফ মার্কের দিকে রওনা দিচ্ছে, কোনোটি আবার খানিক আগে ল্যান্ড করে পার্কিং মার্কের দিকে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। প্লেনগুলি দেখতে প্রায় পাখির মতো, দৈত্য পাখি। এদের ডানা আছে, লেজ আছে। পাখির ক্ষেত্রে ওড়ার জন্য ডানা আর লেজ যে ভূমিকা রাখে, যে প্রযুক্তি-কৌশলে প্লেন আকাশে ওড়ে তার ডানা আর লেজ এখনো অনেকটা সে ভূমিকাই রাখে। আর সে জন্যই প্লেন দেখতে একটা বড় পাখির মতো মনে হয়। মানুষের বানানো এই যন্ত্রের পাখিগুলিই আমাদের তার পেটের ভেতর বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু মনে হয় সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই যখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির কল্যাণে প্লেনের দেহ থেকে তার ডানা আর লেজটা হারিয়ে প্লেন আরো আধুনিক রূপ লাভ করবে। তখন হয়ত আমরা আরো সূক্ষ্ণ উৎকর্ষ লাভ করবো, কিন্তু পাখির সাথে আমাদের দূরত্ব বেড়ে যাবে।
দিল্লি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে লাখ লাখ মানুষ, মানুষের মাথা খায় মানুষ। এত লোক দেখে হতবাক, দিশেহারা। মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ নিয়ে ডোমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে আবার লাগেজ জমা দিয়ে সিকিউরিটি চেক করে এক কিলোমিটার হেঁটে ফ্লাইটে বোর্ডিং করতে হবে। এত অল্প সময়ে কাজটা প্রায় না, পুরোই অসম্ভব। কিন্তু উপায় তো নাই, হাল ছাড়া যাবে না, চেষ্টা করতে হবে। আমরা তিনজন— আমি, স্ত্রী আর কন্যা। একটা লাইনে দাঁড়ায়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। কমপক্ষে দুই ঘন্টা লাগবে ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ পেতে। শেষ চেষ্টা করার জন্য তৈরি হলাম। লাইনের সামনে দাঁড়ানো শিখদের একটা দল। তাদের মধ্যে সিনিয়র ধরনের একজনকে সমস্যাটা বুঝিয়ে বলতেই তারা সবাই আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন। এতে আমাদের সময় বেঁচে গেলো অনেকখানি। শিখদের ওপরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল বহুগুণ। তারপর দৌড়ঝাঁপ করে কোনো রকমে কানেকটিং ফ্লাইট ধরে শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা দেয়া গেল। কাশ্মীর উপত্যকায় যখন পৌঁছলাম তখন শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে গায়ে গায়ে।
দিনের বিদায়ের একটা সুর যেন বাজছে উপত্যকাজুড়ে। প্লেন ল্যান্ড করেছে শ্রীনগরের ছোট নিরিবিলি এয়ারপোর্টে। বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই বাজছে প্লেনের ভিতর। বিষণ্ণ এক বিকেলে কাশ্মীর এসে নামলাম। চলবে