বিজ্ঞান কী ইসলামের প্রতিপক্ষ
তাহমিদ হাসান মুত্তাকীপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
অনেকের মধ্যে এরকম একটা ধারণা কাজ করে যে, বিজ্ঞান ও ধর্ম বিপরীতধর্মী কথা বলবে। দুটোর একটা বেছে নিতে হবে, দুটো একসাথে চলতে পারে না। এ থেকে তারা বিজ্ঞান ও ধর্মকে প্রতিপক্ষরূপে উপস্থাপন করে।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের স্থানে, ইসলাম ইসলামের স্থানে। বিজ্ঞান ও ইসলামকে মিক্স আপ করা যাবে না। দুটো আলাদাভাবে থাকবে। ব্যক্তিজীবনে একজন সালাত, সাওম এরকম ইবাদত পালন করতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের কোনও কথা ইসলামের মাধ্যমে যাচাই করা যাবে না।
অনেক বিষয়ে বাস্তবিক ভাবেই ইসলাম ও বিজ্ঞান কিছুটা ভিন্ন কথা বলে। তাহলে এখানে আমাদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিত?
ইসলাম: একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন
ধর্ম বলতে আমরা অনেকে একজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া, তার উপাসনা ও আনুষঙ্গিক কিছু আনুষ্ঠানিকতা বুঝে থাকি। কোনও কোনও ধর্মের ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞা প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু ইসলাম এর চেয়ে আরও বেশি কিছু।
ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পন। একজন মুসলিম একমাত্র আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলে। ইসলাম হলো, আল্লাহ তায়ালার মনোনীত দ্বীন। এখানে আছে একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা।
আজান হলে আমি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসবো, আবার নামাজ শেষে মদ-গাঁজা নিয়ে পড়ে থাকবো, ইসলাম এরকম জীবনব্যবস্থা নয়। বরং এখানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই জীবনের কোনও কাজই ইসলামের বাইরে নয়। হোক সেটা সালাতে দাঁড়ানো কিংবা জ্ঞানচর্চা। আমাদের প্রতিটি কাজ হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ সূরা আল মায়িদাহ– আয়াত ৩
বিজ্ঞান কী
আজ বিজ্ঞানকে নিয়ে এত হইচই, চারদিকে বিজ্ঞানের জয়জয়কার শোনা যায়। কিন্তু জানলে অবাক হতে হয়, বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞার বিষয়ে এখনো ঐক্যমত তৈরি হয়নি।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান, আর ইংরেজি ভাষায় Science শব্দটি ল্যাটিন শব্দ scientia থেকে, যার অর্থ জ্ঞান। তবে সব ধরনের জ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কোন জ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হবে, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
প্রচলিতভাবে, গবেষণা ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে কোনও বিষয় সম্পর্কে অর্জিত প্রমাণিত জ্ঞান ও যৌক্তিক ভবিষ্যতবাণীকে আমরা বিজ্ঞান হিসেবে ধরে থাকি। আমরা যদি উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা দেখি, সেখানে বলা হয়েছে, Science is a systematic enterprise that builds and organizes knowledge in the form of testable explanations and predictions about the universe।
এই সংজ্ঞা যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে বিজ্ঞানকে কেবল নিশ্চিত প্রমাণিত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। বিভিন্ন হাইপোথিসিস, প্রেডিকশন বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখন ব্লাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণিত। আমরা কিছুদিন আগে ব্লাক হোলের ছবি পেয়েছি। তবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব থেকে প্রথম যখন ব্লাক হোলের ধারণা করা হয়েছিলো, তখন কিন্তু এটা প্রমাণিত ছিল না।
মানুষের সীমাবদ্ধতা ও পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান
বিজ্ঞান যেহেতু কিছু শর্তসাপেক্ষে মানুষের অর্জিত জ্ঞানেরই সংগ্রহশালা, তাই মানুষের সীমাবদ্ধতাগুলো বিজ্ঞানের জন্যও প্রযোজ্য। মহাবিশ্বে যে কতশত রহস্য লুকিয়ে আছে, তার খুব অল্পই আমরা জানি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনও উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। তাঁর জন্যই আসমানসমূহে যা রয়েছে তা এবং জমিনে যা আছে, তা। কে সে, যে তাঁর নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া? তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে এবং যা আছে তাদের পেছনে। আর তারা তাঁর জ্ঞানের সামান্য পরিমাণও আয়ত্ব করতে পারে না, তবে তিনি যা চান তা ছাড়া। তাঁর কুরসি আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে এবং এ দুটোর সংরক্ষণ তাঁর জন্য বোঝা হয় না। আর তিনি সুউচ্চ, মহান।’ সূরা আল বাকারা– আয়াত ২৫৫ (আয়াতুল কুরসী)
এই আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন স্পষ্ট ঘোষণা করে দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা সকল বিষয়ে জানেন। অন্যদিকে, মানুষ শুধুমাত্র সে জ্ঞানটুকুই অর্জন করতে পারেন, যতটুকু তিনি চান। মানুষের জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতা বিজ্ঞানও স্বীকার করে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে আমরা জানতে পেরেছি, প্রকৃতির সব রহস্য আমরা কখনোই জানতে পারবো না। একটা পর্যায়ে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আর বলতে পারবেন না যে, এটা এরকম, বরং সর্বোচ্চ এমনটা বলতে পারবেন, এটা এরকম হতে পারে।
সময়ের সাথে আমরা নতুন নতুন তথ্য জানছি। আমাদের জ্ঞানের পরিধি একটু একটু করে বাড়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানও আধুনিক হচ্ছে। বিজ্ঞানের পুরনো ধারণাগুলো ভুল প্রমাণিত হয়ে নতুন ধারণা সে স্থান নিচ্ছে। আবার একদিন হয়তো সেটাও বদলে যাচ্ছে।
টলেমি জন্ম নিয়েছিলেন ১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী আছে জগতের কেন্দ্রে, আর গ্রহ-নক্ষত্র যা কিছু আছে সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তখন মানুষেরাও এটাই বিশ্বাস করেছে। কিন্তু তারপর কেউ কেউ দেখলেন আকাশের কিছু তারার গতিপথের দিকে তাকিয়ে কথাটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। ষোড়শ শতকের দিকে নিকোলাস কোপারনিকাস বললেন, সূর্য কেন্দ্রে, পৃথিবীসহ গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। প্রায় দেড় হাজার বছর যেটা ছিল বিজ্ঞান, সেটা বদলে গেল। আচ্ছা, এখন যদি কেউ পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেলে বিশ্বাসী হয়, তাকে কি বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে?
বিজ্ঞানী নিউটন বললেন, আলো এক ধরনের কণা। বিজ্ঞানী হাইগেন বললেন, না, আলো এক ধরণের তরঙ্গ, যেটা ইথার মাধ্যমে বিচরণ করে। বিজ্ঞানী মাইকেলসন ও মোরলে পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন, ইথার বলে কিছু নাই। বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল বললেন, আলো আসলে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ। মাধ্যম ছাড়া চলে। বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক বললেন, আলো আসলে গুচ্ছ গুচ্ছ কনা আকারে নির্গত হয়। এটাই সাইন্স, এটা ধ্রুব কিছু নয়। মানুষের নতুন কিছু জানার সাথে যেটা বদলে যেতে থাকে।
বিশ্বজগতের যে অংশটুকু থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছেছে, তা হলো পৃথিবীর চারিদিক থেকে প্রায় চার হাজার ছয়শ পঞ্চাশ কোটি আলোকবর্ষ। এই এরিয়াটুকুকে বলা হয় দৃশ্যমান মহাবিশ্ব। যত শক্তিশালী টেলিস্কোপই হোক না কেন, মানুষ এর বাইরে দেখার ক্ষমতা রাখে না।
কসমিক ইনফ্ল্যাশন তত্ত্ব বলছে, সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের 1.5*10^23 গুণ আর হতে পারে তা অসীম। এর বাইরে মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স, এসবের কথা না-ই বা বলি। সম্পূর্ণ মহাবিশ্বও না ধরি, শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্বের কতটুকু মানুষ জানে? বলা হয়, পৃথিবীর সমুদ্র তলদেশের মাত্র ৫% মানুষ উন্মোচন করতে পেরেছে। এই পৃথিবীরই কত রহস্য জানা বাকি রয়ে গেছে!
পক্ষপাতী বিজ্ঞান
বিজ্ঞানীরাও কিন্তু মানুষ। তারা মানবীয় দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। বিজ্ঞানের অন্ধকার দিকও রয়েছে। কখনো বিজ্ঞানীরা নিজেরাই পক্ষপাতী হয়েছেন, অথবা কখনো সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় চাপ তাদেরকে পক্ষপাতী করেছে। কখনো ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেছে গবেষণার আগেই, আর কখনো সত্যকে গোপন করা হয়েছে। কখনো পূর্বের বদ্ধমূল ধারণাকে ঠিক রাখতে গবেষণা এদিক-ওদিক করে ফেলা হয়েছে।
‘ইদানীং আমরা যে IQ টেস্ট করি সেই পদ্ধতিটি ১৯৫০-এর দশকে Dr. D Wechsler এর বানানো। শুরুতে তিনি পেলেন, ৩০-এরও বেশি টেস্ট নারী-পুরুষের মাঝে ‘একজনের’ পক্ষে ‘বৈষম্য’ করছে। যেন, টেস্টেরই দোষ, সে কেন একই রেজাল্ট দিচ্ছে না। কেন দুই লিঙ্গ দুই রকম পারফর্ম করবে? উভয়ে তো সমান। অতএব, টেস্টই ঠিক নেই। বুইঝেন ব্যাপারটা। পারফর্মেন্স গ্যাপ যেগুলোতে বেশি, সেই টেস্টগুলো বাদ দিয়ে দিলেন Wechsler সাহেব। ‘সমস্যা’টা সমাধান করা দরকার। এরপরও যখন দুই লিঙ্গকে সমান দেখানো যাচ্ছে না, তখন যেটা করা হলো, কিছু টেস্ট রাখা হলো যেগুলোতে পুরুষ ভালো করে, নারী খারাপ করে। আর কিছু টেস্ট রাখা হলো, যেগুলোতে নারীরা ভালো করে, পুরুষ খারাপ করে। পুরোটাকে বলা হলো ‘IQ টেস্ট’; এবং ‘নারী-পুরুষ’ আইকিউ সমান। এই হলো বিজ্ঞানের অবস্থা। যখন গবেষণার রেজাল্ট আপনার পছন্দ হচ্ছে না, মনমতো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আপনি প্রাপ্ত ডেটাগুলো এদিক-সেদিক করে নিচ্ছেন। উদাহরণ যেন অলিম্পিকে কোনো পোলভোল্ট ইভেন্টে কয়েকজন অ্যাথলেটকে আপনি ওজনের বাটখারা বেঁধে দিচ্ছেন। আর কয়েকজনকে পোলের উচ্চতা কমিয়ে দিচ্ছেন। যাতে ‘সত্য’টা প্রমাণিত হয় যে, শক্তি আর দ্রুততা যাই হোক, সৃষ্টিগতভাবে সব পোলভল্টারই সমান। (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ২– শামসুল আরেফিন শক্তি)
যিনি সব জানেন
ইসলাম এসেছে এই সমগ্র বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তার কাছ থেকে, যিনি সবকিছু জানেন ও সবকিছুই তার আয়ত্বাধীন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করি এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরে আছে অধিকতর এক জ্ঞানীজন।’ সূরা ইউসুফ– আয়াত ৭৬
আল্লাহ তায়ালা তার প্রেরিত কিতাবকে প্রজ্ঞাময় উল্লেখ করেছেন, ‘প্রজ্ঞাময় কোরআনের কসম।’ সূরা ইয়াসিন– আয়াত ২
আল কুরআনে বিজ্ঞান
বিজ্ঞান কিছু বছর আগে যেটা আবিষ্কার করেছে, তার অনেক কিছুই কুরআনে রয়েছে চৌদ্দশো বছর আগে থেকেই। সূরা আল আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং জীবন্ত সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?’ সূরা আল আম্বিয়া– আয়াত ৩০
আশ্চর্যজনক নয় যে, বর্তমান বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের এই আয়াত মিলে যায়। বিগ ব্যাং থিউরিতে এরকমটাই বলা হয়েছে। আর প্রাণের সূচনা যে পানি থেকে হয়েছে, বর্তমান বিজ্ঞানের ধারণাও এরকমই। এরপর সূরা আয যারিয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আমার ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সমপ্রসারিত করছি।’ সূরা আয যারিয়াত– আয়াত ৪৭ এখানেও আধুনিক বিজ্ঞান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কথারই স্বীকৃতি দেবে। বর্তমান বিজ্ঞান সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা সমর্থন করে। আর এটা কুরআনের মু’যেজার একটি যে, বিজ্ঞান যত আধুনিক হবে, স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান কুরআনের কথাগুলোরই সত্যতার সাক্ষ্য দিতে থাকবে।
কুরআন পৃথিবীর কোনও মানুষের রচনা হলে এটা সম্ভব হতো না। কারণ কুরআনের অনেক তথ্য মানুষ জেনেছে কুরআন নাজিলের অনেক পরে। আর এখানে দুএকটি উদাহরণ দেওয়া হলো, এরকম আরো অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য মহাগ্রন্থ আল কুরআনে রয়েছে।
বৈপরীত্ব ও করণীয়
আমরা দেখি, বিজ্ঞানের সব কথা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। যেমন, আমরা বিবর্তনবাদের কথা বলতে পারি। এই বৈপরীত্বের কারণ বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা এমনকি এটাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে, আমরা এখন জেগে আছি নাকি স্বপ্ন দেখছি। তাহলে, বিজ্ঞানকে মানবীয় ত্রুটির ঊর্ধ্বে পরম সত্য কীভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে? বিজ্ঞানকে আমরা ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখব না, আবার বিজ্ঞানকে পরম সত্যও মনে করি না। আমরা বিজ্ঞান দিয়ে কুরআনকে জাস্টিফাই করব না, বরং কুরআন দিয়ে বিজ্ঞানকে জাস্টিফাই করতে পারি। বিজ্ঞান যা বলছে তা যদি কুরআন বা ইসলামের সাথে না মেলে, তাহলে আমরা বলবো, ইসলাম সত্য, এবং বিজ্ঞান হয়ত পরবর্তীতে ইসলাম যা বলেছে তার সত্যতার সাক্ষ্য দেবে।
এর কারণ হলো, ইসলাম এসেছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে, যিনি সবকিছুই জানেন ও দেখেন। ইসলাম যা বলেছে, তার কোনও পরিবর্তন হবে না, অথচ আজকের বিজ্ঞান কালকেই বদলে যেতে পারে।
ইসলামে চিন্তা ও গবেষণার গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা বিজ্ঞান বা জ্ঞানচর্চাকে কুরআনের প্রতিপক্ষ করেননি। বরং জ্ঞানচর্চাকে কুরআনে উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনের প্রথম যে আয়াত নাজিল হয়েছে, সেখানেই বলা হয়েছে, ‘তুমি পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ সূরা আল আলাক্ব– আয়াত ১
সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলে স্রষ্ঠার মহিমা বোঝা যায়। কুরআনে সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা ও জ্ঞান অর্জনের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘যারা আল্লাহকে দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট এবং শায়িত অবস্থায় স্মরণ করে থাকে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টির ব্যাপারে চিন্তা করে (ও বলে), ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি, তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, সুতরাং আমাদেরকে অগ্নির শাস্তি হতে রক্ষা করো।’ সূরা আল ইমরান– আয়াত ১৯১
আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিতে নিদর্শন রেখেছেন। তাই আমাদের চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। ‘তিনি তা দিয়ে তোমাদের জন্য জন্মান শস্য, যায়তূন, খেজুর, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল। এতে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তিনিই রাত ও দিনকে তোমাদের উপকারে নিয়োজিত করেছেন। আর সুরুজ ও চাঁদকেও; এবং তারকারাজিও তাঁরই নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত; বিবেকসম্পন্ন লোকেদের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ সূরা আন নাহল– আয়াত ১১-১২
আল কুরআনে আরো বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির মধ্যে, রাত ও দিনের পরিবর্তনের মধ্যে, যে সব জাহাজ মানুষের লাভের জন্য সাগরে চলাচল করে তাদের মধ্যে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন এবং সকল প্রকার প্রাণী তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আর বায়ুরাশির প্রবাহের মধ্যে (গতি পরিবর্তনে) এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী (আল্লাহর আজ্ঞাধীন ভাসমান) মেঘের মধ্যে জ্ঞানী লোকের জন্য অবশ্যই (আল্লাহর মহিমার) বহু নিদর্শন রয়েছে।’ সূরা আল বাকারা– আয়াত ১৬৪
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা চিন্তা ও গবেষণার সাথে এই গ্রন্থ থেকে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারবো। ‘তাহলে তারা কি (আল্লাহর) এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? কিংবা তাদের কাছে এমন কিছু (নতুন বস্তু) এসেছে যা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আসেনি?’ সূরা আল মু’মিনুন– আয়াত ৬৮
এখন আমরা ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে জানি, কিন্তু কুরআন যখন নাজিল হয়, তখন মানুষের এ বিষয়ে ধারণা ছিল না। সূরা আল ওয়াকিয়ার ৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘সুতরাং আমি কসম করছি নক্ষত্ররাজির অস্তাচলের, আর নিশ্চয় এটি একটি মহাকসম, যদি তোমরা জানতে।’ সূরা আল ওয়াকিয়া– আয়াত ৭৫, ৭৬
বর্তমানে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, এখানে কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে বলা হয়েছে। এটা কুরআনের একটি মু’জেজা যে, চিন্তা ও গবেষণা করলে আমরা কুরআন থেকে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারব। এটা এমন এটি গ্রন্থ যা চির আধুনিক।
বিজ্ঞান কি ইসলামের প্রতিপক্ষ
ইসলাম চিন্তা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করে। সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করতে পারে। বিজ্ঞান ও ইসলাম প্রতিপক্ষ নয়। তবে, ইসলাম এসেছে স্রষ্টার নিকট থেকে যিনি সমস্ত ভুলত্রুটি থেকে পবিত্র। অন্যদিকে, বিজ্ঞান মানবীয় দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। বিজ্ঞান ও ইসলাম প্রতিপক্ষ নয়। তবে একজন মুসলিমের জন্য ইসলাম সবার আগে। বিজ্ঞান ও ইসলামের মধ্যে কোথাও অমিল থাকলে সেটা মানুষের সীমাবদ্ধতা। হতে পারে, ভবিষ্যতে বিজ্ঞান অমিলের বিষয়গুলোতেও ইসলামের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। ইসলাম এসেছে বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছ থেকে, আর নিঃসন্দেহে ইসলাম সত্য।
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞান, পথনির্দেশ ও দীপ্তিমান কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে।’ সূরা আল হাজ্জ– আয়াত ৮। আরেকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ইসলামের বিধানগুলো আমরা আল্লাহর আদেশ হিসেবেই মানবো। সালাত, সাওম এরকম ইবাদতগুলোর বৈজ্ঞানিকভাবে বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে, আমরা তা নিয়ে গবেষণা করতে পারি এবং এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারি, কিন্তু আমাদের ইবাদতের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি।