বাবরি মসজিদ নিয়ে আদালতের রায় এবং গান্ধীকে ঘিরে কিছু কথা
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : নভেম্বর ২২, ২০১৯
বাবরি মসজিদ নিয়ে যে রায় ঘোষিত হয়েছে তার মধ্যে কূটনীতি আছে, কিন্তু ন্যায় নেই। ভারতের প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়া বা আইনও মানা হয়নি রায় ঘোষণায়। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা এ রায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ এই রায়কে সমর্থন করেনি। রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, কিছু মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে রায়টা দেয়া হয়েছে, প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে নয়। তিনি বলেছেন, ‘রাম শুধু মহাকাব্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে অনেক মানুষের মনে একটা বিশ্বাসও রয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের বলে একটা মসজিদের জমি মন্দিরের নামে হয়ে যেতে পারে না।’ কিন্তু মুসলমানরা যে এ রায় মেনে নিয়েছেন, দাঙ্গা বা রক্তপাতের পথে যাননি তার জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। কারণ তারা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং একটা মসজিদ রক্ষার জন্য অযথা রক্তপাত ঘটবার পথ পরিহার করেছেন। ভারতের মুসলমানদের দিক থেকে এই পথ অবলম্বন সর্বক্ষেত্রে মানবজীবনে একটা উদাহরণ হতে পারে রক্তপাত এড়াবার জন্য।
ভারতের যে ঘটনা ঘটলো সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারা, আধুনিক যুগে এসে একটা মসজিদকে মন্দির বানিয়ে ফেলা এর দায়ভার আরো বহুজনের সঙ্গে ভারতের জাতির পিতা গান্ধীকে নিতে হবে। সকল রকম আবেগ বাদ দিয়ে ভারতের ইতিহাসের ওপর যদি তীক্ষ্ণ আলো ফেলা যায়, তাহলে এই সত্যিটি প্রমাণিত হবে যে, গান্ধীর বিরাট দায় রয়েছে এই ঘটনায়। ভারতে জাতীয় কংগ্রেস যখন জন্ম নেয়, যদিও তা ছিল ইংরেজ ঘেঁষা আর নরমপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু কংগ্রেস তখন সাম্প্রদায়িক কোনো দল ছিল না। উনিশশো বিশ সালে জিন্নাহকে হটিয়ে দিয়ে গান্ধী যখন কংগ্রেস দখল করল, তখন থেকেই সেখানে সাম্প্রদায়িক চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে। কংগ্রেসের প্রধান ব্যক্তিত্ব গান্ধী বললেন, ধর্ম বাদ দিয়ে রাজনীতি হতে পারে না। তিনি ধর্ম টেনে আনলেন কংগ্রেসের রাজনীতিতে। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রক গান্ধী বললেন, তিনি ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে চান আর চান গো-রক্ষণ বা গোমাতাকে রক্ষা করতে। কংগ্রেস যখন রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় আর রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তখন কি তা আর অসাম্প্রদায়িক দল থাকতে পারে?
সাধারণভাবে মনে হবে, কংগ্রেস ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক দল কিন্তু তার কার্যক্রম কি তা প্রমাণ করে? কংগ্রেস নিজেও বলেছে, তারা অসাম্প্রদায়িক দল। ভারতে যেখানে বহু মুসলমান বসবাস করছে সেখানে একটি অসাম্প্রদায়িক দল কী করে সেখানে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলে? রামরাজত্বই তো এখন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিজেপি আর অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাতারা। বর্তমানে যা ঘটলো সেইরকম বিশ্বাসের বীজ বপণ করেছিলেন গান্ধী উনিশশো বিশ সালেই। তিনি খিলাফতের মতো একটি ধর্মীয় আন্দোলনকে সমর্থন করলেন এই শর্তে যে, মুসলমানরা ভারতে আর গো-হত্যা করবে না। জিন্নাহ তখন গান্ধীর এই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করেননি বলেই কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হলেন, গান্ধীর অনুসারী বিপুল জনতার ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে। গান্ধী সেদিন একইভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিলেন হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে। জিন্নাহ বললেন, এর পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। ঠিক তাই হলো, কয়েক বছর যেতে না যেতেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলো। হিন্দু-মুসলমানের সেই বিভেদ আর দূর হলো না। গান্ধী কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রামরাজত্বের ধারণা ছাড়লেন না। মতিলাল, জওহরলাল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ কংগ্রেসের নেতারা কেউই গান্ধীকে এসব কথা বলতে বাধা দেননি।
মওলানা আজাদ বহু বছর যাবত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, প্রায় টানা সাত বছর। মুসলমান সভাপতির উপস্থিতি দেখে কংগ্রেসকে সাম্প্রদায়িক দল মনে হবার কারণ নেই। কিন্তু তিনি কি কখনো রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন? জিন্নাহ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন এই মানুষটাকে। যখন আজাদ শেষের দিকে পশ্চাৎপদ মুসলমানদের দাবিগুলিকে যৌক্তিক বলে গান্ধীকে একটি পত্র লিখলেন, তিনি আর কংগ্রেসের সভাপতি থাকতে পারলেন না। গান্ধী তাঁকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। গান্ধী শুধু রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা আর গো-রক্ষার কথা বলেননি, পশ্চাৎপদ মুসলমানদের জন্য কোটা সংরক্ষণের বিরোধী ছিলেন। তিনি বলতেন সকলকেই প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা প্রমাণ দিয়ে পদ পেতে হবে। তিনি কি জানতেন না, পশ্চাৎপদ মানুষরা লড়াইয়ে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। মুসলমানদের জন্য কোটা সংরক্ষণের বিরোধী এই গান্ধীই আবার হরিজনদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করলেন। যখন অন্ত্যজরা দাবি করল যে, তারা হিন্দু নয় ভিন্ন সম্প্রদায় এবং তাদের জন্য সাম্প্রদায়িকভাবে কোটা সংরক্ষণ করতে হবে। ইংরেজ সরকার তাদের দাবি মেনে নিলো। গান্ধী তখন অনশনে বসলেন। তিনি দাবি করলেন, দরকার হলে হরিজনদের জন্য আরো বেশি কোটা সংরক্ষণ করতে তিনি প্রস্তুত, কিন্তু তারা হিন্দু নয় এ কথা মেনে নেয়া যায় না। কারণ হরিজনরা হিন্দু নয় এটা মেনে নিলে ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যায়।
যখন সাঁইত্রিশ সালে কংগ্রেস বিভিন্ন প্রদেশের ক্ষমতায় বসল, তখন বোম্বাইয়ে নারিমান আর বিহারে সৈয়দ মাহমুদ সেখানকার কংগ্রেসের প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু নয় বলে তাদের মুখ্যমন্ত্রী করা হলো না। তাদের বাদ দিয়ে বিজি খের আর কৃষ্ণসিংহ দুজন হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলো। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে সেখানকার মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিজেপি আর হিন্দুত্ববাদীদের বর্তমান শ্লোগানটা কী? ‘হিন্দি, হিন্দু আর হিন্দুস্থান’। কংগ্রেসের পতাকাকে স্বাধীন ভারতের পতাকা হিসাবে চালানো হলো। বর্তমান ভারতের পতাকার সঙ্গে কংগ্রেসের পতাকার খুব সামান্যই পার্থক্য রয়েছে। স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসের শাসনেই হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছিল। ভারতের ছয়-সাতটি প্রদেশ ছাড়া আর বাকি প্রদেশগুলিতে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বর্তমান যুগে একটি রাষ্ট্রে গরুকে দেবতা মনে করে বিরাট সংখ্যক নাগরিকদের গোমাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত করা কি আধুনিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা হতে পারে? বহু মানুষের খাদ্য বাছাইয়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে কি সেখানে গণতন্ত্র থাকতে পারে?
বিশ শতকে বিশের দশক থেকে গোহত্যা নিষেধের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন গান্ধী, গান্ধী ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে সন্ন্যাসী সমতুল্য। হিন্দু মহাসভা গো-হত্যার বিরুদ্ধে ছিলো কিন্তু হিন্দু মহাসভার বলতে গেলে তেমন কোনোই প্রভাব ছিল না বিশ শতকের বিশের দশকে। গান্ধীর গো-হত্যা নিষেধকে ঘিরেই স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা হয়েছে। সরকারি কাগজপত্রে দেখা যায়, ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সতেরো বছরে ভারতে দাঙ্গার সংখ্যা পাঁচ হাজার চারশো একান্নটা। চিন্তা করা যায়! দাঙ্গার প্রধান একটি কারণ, গো-হত্যা। গোরক্ষার মতো এক কুসংস্কারকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেখা গেছে যেখানে গোমাংস খাওয়া হয়নি, সেখানে ভুল বুঝে মানুষকে গোমাংস খাওয়ার জন্য হত্যা করা হয়েছে। গান্ধীকে বলা হচ্ছে ভারতের বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যিনি গোরক্ষা আন্দোলনের ভবিষ্যতের ফলশ্রুতির কথা ভাবতে পারেননি, তিনি কী করে প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হন? তিনি যদি তাই হতেন তাহলে ভারতে সকল মানুষের স্বার্থে, ভবিষ্যতে দাঙ্গা বা রক্তপাত বন্ধের লক্ষ্যে গোরক্ষার নীতি পরিহার করতেন।
সত্যি বলতে গান্ধীর চেয়ে অনেক বেশি দূরদর্শী এবং সম্মানিত সেখানে দিল্লি জামে মসজিদের বর্তমান ইমাম। তিনি রক্তপাত না হবার জন্য রায় ঘোষণার পূর্বেই বলেছেন, রায় যা হোক তারা মেনে নেবেন। মসজিদের একজন ইমাম যা পারলেন, গান্ধী তা পারলেন না কেন ভারতের মানুষের স্বার্থে? ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য এই যে, বাংলা তথা ভারতবর্ষের যেসব ব্যক্তিত্বরা সমাজজীবনে বিপুল প্রভাব ফেলেছেন, তাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করতে পেরেছেন খুব কম লোক। স্বামী বিবেকানন্দর মতো বিরাট মাপের মানুষ হিন্দুত্বকে এতো বড় করে তুলেছিলেন, যার প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনে। পাশ্চাত্য যখন মানবতাবাদ প্রচার করছে ইশ্বর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথসহ সকলেই তখন বেদ বা হিন্দুত্বের মহিমা প্রচারে ব্যস্ত। ভারতবর্ষের সকল বড় মাপের মানুষরাই আসলে একটা ধর্মের পক্ষে দাঁড়ালেন। ফলে ভারত আধুনিক রাষ্ট্র না হয়ে হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। ভারতের মনীষীদের দ্বারা প্রাচীন ভারতের ঋষি এবং বেদবাদী ধর্মকে বড় করার প্রবণতা শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতকেই শক্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের পক্ষে বহুবার সরাসরি কলম ধরেছেন কিন্তু ব্যক্তিজীবনে উপনিষদ বা বেদ বা প্রাচীন ঋষিদের প্রতি তার দুর্বলতা ভারতবর্ষে ‘হিন্দুত্বের ভিত্তিকে’ শক্ত করেছে। হিন্দুত্বের ভিত্তি যতই শক্ত হয়েছে, ভারতের মুসলিম শাসক আর মুঘলদের বিরুদ্ধাচারণ হয়েছে ততবেশি। যদিও এর পথিকৃৎ ছিল ইংরেজ শাসকরা।
মুসলিম শাসক আর মুঘলদের বিরুদ্ধচারণ শেষ পর্যন্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলে গেছে। না হলে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন আসবে কেন, যার ভয়াবহ পরিণাম দেখা গেল বাবরি মসজিদের ঘটনায়। রাষ্ট্র দ্বারা ভারতের মুসলমানদের উপর প্রভুত্ব সৃষ্টি হলো হিন্দুদের। বাবরি মসজিদের রায় প্রমাণ করলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ভারতের বিচার ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু মুসলমানরা হিন্দুদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে কি এরপর ধর্ম নিরপেক্ষ বলা চলে? শেষ কথা হলো এই যে, সরকারিভাবে ভারত বহুদিন ধরেই হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হলেও, ভারতের জনগণ বা সকল হিন্দুরাই সাম্প্রদায়িক নন। বরং অনেক বেশি উদার। ভারতের জনগণের মনে যে উদারতা রয়েছে, সেই উদারতা রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গ্রহণ করতে পারেনি। ভারতের বহু মানুষ তাই বাবরি মসজিদে রায়ে লজ্জিত এবং প্রতিবাদী। জনগণের উপরে রাষ্ট্র তার আধিপত্য এভাবেই চাপিয়ে দেয় বণিকদের বা মুনাফার স্বার্থে। রাষ্ট্র যাই করুক, আমরা জনগণ যেন সকল ধর্মের প্রতি, সব মানুষের প্রতি উদার হতে পারি।