বাণী বসুর গল্প ‘মাঝরাতে’

প্রকাশিত : মার্চ ১১, ২০২১

কথাসাহিত্যিক বাণী বসুর আজ জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ১১ মার্চ তার জন্ম। আশির দশক থেকেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা গল্প ‘মাঝরাতে’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

জীবনে কখনো ভূত দেখলাম না এ নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ দুঃখ আছে। অথচ আমি নেহাত অভীতু মানুষ নই। ভূত যদি আসে, যদি দেখা দেয় তাহলে আমি আমার ভয়-ভয় ভাব নিয়ে রেডি। আমাকে ভয় পাওয়াতে ভূতের বেশি বেগ পেতে হবে না। সেরকম ভূতুড়ে বাড়িও ছাই আমার কপালে জুটল না! অবশ্য সে আমারই দোষে। ওইরকম বাড়ির ধারকাছ আমি মাড়াবোই না, ভূতের ভয়ে নয়, নোংরার ভয়ে মানুষের ভয়ে। আমার কাছে আসতে হলে ভূতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় আসতে হবে, যেখানে বিদঘুটে গন্ধ নেই, ময়লাটে জিনিসপত্তর নেই, আলো জ্বাললেই জ্বলে, কল খুললেই জল, শুলেই ঘুম, খিদে পেলেই মোটামুটি খাবার। এইরকম নন-অ্যাডভেঞ্চারাস মানুষের যে ভূত দেখা হবে না তাতে আর আশ্চর্য কী!

অন্ধকারেও আমার ভয় হয় না। অসুবিধে হয় কিন্তু ভয় টয় নয়। জীবনে বহুবার বহু বিপাকে পড়েছি, তখন ভয় পেয়েছি অবশ্যই। কিন্তু সে ভয় যদি হাত পা অসাড় করে দিত তাহলে আর এত দূর আসতে হতো না। তখন উঠে পড়ে লাগার দিন , কী করে এ বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। পরীক্ষাতেও আমি কখনো ভয় পাইনি। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রছাত্রীরা যেখানে শুকনো মুখে লাস্ট মিনিট রিভিশন করছে, সেখানে আমি মায়ের হাতে রসগোল্লা খাচ্ছি। ডিম বা রসগোল্লা নিয়ে আমার কোনো কুসংস্কার নেই অথচ সারা জীবনটা ভয়ে ভয়ে, সাবধানেই কেটে গেল। মানে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে আমি সন্ধ্যে আসতেই দেব না, তার আগেই পিঠটান। বাঘ যদি আমার সামনে লাফিয়ে পড়ে তক্ষুনি আমি ধপাস করে পড়ে যাব, নে বাবা, চট করে আগে টুঁটি টিপে মেরে দে, তারপরে ডিটেলে যাস। এ ধরনের মানুষকে বলে কাপুরুষ। ভেতরে কোনো লড়াই-ই নেই।

দেখুন, লোকে ভূত আর ভগবান এই দুটো বিষয়কে সব সময়ে এক করে দেখে। যেন ভূত না থাকলে ভগবানও থাকবে না এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কেন রে বাবা! ভূতের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক কী? ভগবান হলেন, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। যেখানে যা আছে, যা ঘটছে সব তাঁর জানা। আর ভূত হল বায়ুভূত, যদি থাকে। দিনে দিনে ভূ-গোলোকে সব কার্যের পেছনে কারণ আবিষ্কার করার চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ লোক এখন ভগবানে বিশ্বাস করে না। আবার এক চতুর্থাংশ প্রবল ভাবে বিশ্বাস করে, ঠিক যেভাবে তাদের পূর্বপুরুষ বিশ্বাস করেছেন। পড়ে রইল আর অর্ধেক। তার মধ্যে কিছু বিশ্বাসের দিকে ঢলে, কিছু অবিশ্বাসের দিকে। আমি নিজে কোনদিকে কী বৃত্তান্ত খুলে না-ই বললাম্ নিজেই কি জানি? ভগবান নামে কোনো ব্যক্তি কোনো এক জায়গায় সব কিছুর দায়িত্ব নিয়ে বসে নেই এ কথা আমরা অনেকেই মানি।

এ-ও মানতে শুরু করেছি যে ভগবান একটা সারা বিশ্বব্যাপী শক্তি। খেলে বেড়াচ্ছে, আমরাও তার অন্তর্গত। তা সত্ত্বেও ছোট বড় যে-কোনো বিপদে হে ভগবান রক্ষা করো বলে ডাকাডাকি করি কি করি না! করি তো! আমার মতো অনেক হাফ-এথীস্টও তাই করেন। এর ভেতরে আমি কোনো অসংগতি দেখতে পাই না। পরে বিশ্লষণ করে মনে হয় নিজের ভেতরে নিজের অতীত কোনো শক্তির কাছে আমার প্রার্থনা। সবটা তো আমরা জানি না। আমাদের ভেতরের সেই বিন্দু বিন্দু ইশ্বর-শক্তি হয়তো আমাদের জোর দেয়! কখনো কখনো রক্ষা করে। অর্থাৎ নিজের যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে একরকম করে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা দিতে পেরে নিশ্চিন্ত ছিলাম। এমন সময়ে সারা পৃথিবীতে একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। সেটা হলো একটি ঘোষণা।

সুইজারল্যান্ডের জিনিভার কাছে সার্ন নামে পৃথিবীর বৃহত্তম ফিজিক্স ল্যাব-এ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার নামে এক দৈত্যাকার যন্ত্রে প্রোটন কণায় কণায় বিপুল বেগে সংঘর্স ঘটিয়ে বিগ ব্যাং নামে বিশ্বের প্রারম্ভিক বিস্ফোরণের অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি করা হবে, তাতে মহাবিশ্ব ও সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য আমরা জানতে পারব। কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল স্টিফেন হকিং-এর মতো বিজ্ঞানীরাও এটা না করতে বলেছেন। কী জানি কী বিপদ তারা আশঙ্কা করেছেন! আরো একটা ফিসফিসানি শোনা যেতে লাগলো—এতে নাকি গড পার্টিকল বা ঈশ্বরকণা আবিস্কৃত হতে পারে। ২০১২-র চার জুলাই ঘটল ঘটনাটা।

সেই দিন রাতে কেন যেন কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সারা শরীরে, মনে কী একটা অস্বস্তি, একটা অশান্তি। সেটা ঠিক কেন কোথায়, বুঝতেও পারছি না, আবার শান্তিও পাচ্ছি না। অনেক রাতে উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে তেমন কোনো পরিস্কার আকাশ দেখতে পেলাম না। অনেকদিনই পাই না। তারা দেখতে পাই না। অথচ বহুদিন পর্যন্ত তারা ভরা আকাশ না দেখতে পেলে আমার ঘুমই হতো না। চাবি নিয়ে ছাতে উঠে গেলাম। মাথার ওপর একটা সাদাটে, ফ্যাকাশে আকাশ। জানি, বায়ুদুষণে, সারা কলকাতাময় বিশাল বিশাল টাওয়ার নির্মাণে, আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের চেহারারও এই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তবু মন মানল না। মনে হল আকাশটা কী এক অমঙ্গলের আশঙ্কায় যেন থমথম করছে। সত্যি বলতে কী, পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে সে নিয়ে আমার কোনো ভয় ছিল না। গেলে যাবে, সবাই মিলে মরে গিয়ে বেঁচে যাব। কীভাবে শেষটা হবে সে নিয়েও ভেবে তো লাভ নেই, যা সাইকার হবে আমাদেরও তাই হবে। তাহলে?

হঠাৎ একট কালো বিদ্যুৎ! গড পার্টিকল, গড পার্টিকল! এতদিন ধরে বিজ্ঞান যা যা আবিষ্কার করেছে তাতে একটা একটা করে আমাদের স্বপ্ন ভেঙেছে। আমরা জেনেছি আমাদের সৃষ্টির পেছনে কোনো মাহাাত্ম্য নেই। বিবর্তিত হতে হতে আজকের চেহারাটা পেয়েছি আমরা, ঠিক আছ মেনে নিলাম, তাছাড়া বিবর্তন যখন হয়েছে, তখন আরো হবার চান্স আছে। তখন কোনো মহিমায় পৌঁছানো যায় কিনা মানুষ চেষ্টা করে দেখতেই পারে! কিন্তু বিজ্ঞান এখন ভালোবাসার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সবটাই বায়োলজিক্যাল, এরকম একটা সম্ভাবনা নিয়ে তোলাপাড়া চলছে। প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা, মা-সন্তানের ভালোবাসা সবটাই জৈব অথচ আমাদের ধারণা ছিল এই ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই একমাত্র আমরা অলৌকিকের দেখা পাই। এখন আমাদর শেষ স্বপ্ন নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া চলেছে। এবার যদি বিজ্ঞান ওই শেষ রহস্যটুকু ফাঁস করে দেয়…!

বাইরের প্রকৃতি কালো, ছাতের ওপরে একা একা দাঁড়িয়ে আমার মনে হল ব্রক্ষ্মাণ্ড আসলে একটা চেতনাহীন যান্ত্রিক কালো দানব, যার চেতনা নেই সে দানব ছাড়া কী? সে কী করছে জানে না, তার কোনো বিচারবোধ নেই, তার কাজ শুধু এলোমেলো পা ফেলা, তাতে যা ধ্বংস হচ্ছে তা ভালো না মন্দ তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, কেন না সে জানেই না। আবছা ভাবে মনে হল—শুনেছিলাম ফিজিক্স এখন চেতনা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। বার  করে ফেললেই হল। চেতনা কতকগুলো কেমিক্যাল অ্যাকশন রিঅ্যাকশন! হিগ্স্ বোসন পার্টিকলের অন্য নাম গড পার্টিকল। কেন? একে ধরাছোঁয়া যায় না, এই আছে এই নেই! অথচ অঙ্ক কষে বোঝা যাচ্ছে তার থাকার কথা। এই পার্টিকলই নাকি সেই মিসিং লিঙ্ক যার বিহরে ফিজিক্সের অঙ্ক কষা ছকটি অসম্পূর্ণ হয়ে আছ। তাহলে গড পার্টিকল পাওয়া গেলেই আমাদের যাত্রা শেষ? চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে ঘন ধোয়ার কুণ্ডলি, আমি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলাম। কেমিক্যাল গড! ফিজিক্যাল গড! বায়োলজিক্যাল গড! কোথাও কোনো মানবিক গড তো নেই-ই, নেই কোনো অলৌকিক সচেতন শক্তি, মানুষ যদি এই বিশ্বের কে কী কোথায় কেন, কেন ভালো কেন মন্দ সব স—ব ব্যাখ্যা করে ফেলতে পারে তার ইকোয়েশনে ফেলে তাহলে কী হবে!

বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখি আমি হাত পা নাড়াতে পারছি না। সর্বনাশ, তবে কি আমার পক্ষাঘাত হয়ে গেল? অনেক্ষণ পরে আস্তে আস্তে সাড় ফিরল, ভীষণ একা একা লাগল, কোনোক্রমে নিচে নেমে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকে থুম হয়ে বসে থাকি, অসাড় মন নিয়ে। ঘুমন্ত মুখগুলি দেখি, দেখতে দেখতে এইটুকু সান্তনা নিয়ে শুয়ে পড়ি যে ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত আমি একা নয়! তবে ঘুম আসে না।

কাগজে খবর। হ্যাঁ, হিগ্স্-বোসন কণা পাওয়া গেছে, হ্যাঁ ওই মিসিং লিঙ্ক আবিষ্কৃত হওয়ায় ফিজিসিস্টদের স্বপ্ন সফল হয়েছে। নিখিল বিশ্ব যেসব কোয়ার্ক ও ইলেকট্রন দিয়ে প্রধানত গঠিত, তাদের এনার্জি আছে, মাস নেই, তাহলে মাস কোথা থেকে এলো? সে এই হিগ্স্ বোসন কণাদের দান। না না গড পার্টিকল নামটা একটা ভুল নাম। আসলে, বিজ্ঞানী লেডারম্যান কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, বলতে চেয়েছিলেন গডড্যম্ড পার্টিকল, সে যে ধরা দিতে চায় না। তিনি বলতে চেয়েছিলেন অতি বদমাশ চতুর কণা। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারেই ঠিক নামটা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ‘সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে’। কে জানে সে হয়তো আমাদের অবাঙ্মনসোগোচর ব্রহ্মের একটি কোষমাত্র।