বাঙলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে খান সাহেব
মঈনুল ইসলাম তুহিনপ্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০১৯
সলিমুল্লাহ খান ভালো লেখক, অনুবাদক, বিশ্লেষক। দার্শনিকও তারে বলা যায়। কেন জানি এই দেশে একজন মানুষরে সব হইতে দেয়া হয়, দার্শনিক বাদে। ব্যাপারটা হতাশাজনক। আমাদের শত শত কবি, লেখক, গল্পকার, অনুবাদক, পলিটিশিয়ান, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি আছেন। এদের মধ্যে একজনও দার্শনিক নাই, এইটা মানা মুশকিল। যদি কেউ কেউ থাকেন, তার মইধ্যে খান সাহেবও আছেন অবশ্যই।
খান সাহেব প্রথম জীবনে কবি হওয়ার খায়েশ করছিলেন। `এক আকাশের স্বপ্ন` নামে তার একটা কবিতার বই পাওয়া যায়। সম্ভবত ওই শুরু, ওই শেষ। খান সাহেব ভাষা নিয়া যে কায়-কারবার করতে চাইছেন, বাঙলা কবিতার ভাষিক ঐতিহ্য তার থেকে এতটাই দূরবর্তী— এবং অতি অবশ্যই শক্তিশালী— ছিল যে, খান সাহেবও তা টের পাইছিলেন। তিনি কবিতা লেখেন নাই। সম্ভবত ভালো সিদ্ধান্ত ছিল।
খান সাহেবের মাধ্যমেই এদেশের অনেক তরুণ লাকাঁ-ফুকো ইত্যাদিতে মত্ত হইছেন। খান সাহেবরে কেউ কেউ ইওরোসেন্ট্রিক বইলা থাকেন। মূলত ইওরোপীয় দর্শনের ইতিহাস নিয়া খান সাহেবের প্রস্তুতি ও রেফারেন্স এত ব্যাপক ছিল যে, তার চিন্তার ডায়নামিক্স লোকে সহসাই ধরতে পারে না। যেমন, অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ বা তালাল আসাদ খান সাহেবের আলাপ ও লেখালেখিতে মিশেল ফুকোর চাইতে বেশি গুরুত্ব পাইছেন। এইটা অনেকে ওভারলুক করেন। খান সাহেব লালন, রবীন্দ্রনাথ এমনকি আরজ আলী মাতুব্বরের `দার্শনিকতা` নিয়াও লেখছেন। আহমদ ছফার লেখালেখির স্বরূপ উন্মোচনরে উনি নিজের জীবনের অন্যতম ব্রত বানাইছেন। ভারতবর্ষ ও সাউথ এশিয়ার ইতিহাস নিয়াও তিনি ছিলেন সবিশেষ সচেতন। খান সাহেব ওয়েস্টার্ন দর্শন পড়ছিলেন তারে মোকাবেলা করার পূর্বপ্রস্তুতি হিশাবে, এই কথাটা বোঝা দরকার। পোস্ট কলোনিয়াল চিন্তাভাবনা বা পোস্ট-মডার্নিস্ট দর্শন-ইতিহাস-সাহিত্যচেতনা বলতে যা আমরা বুঝি, বাংলাদেশে তার গঠন ও প্রচারে খান সাহেবের কিছু অবদান আছে বৈকি! বাঙলাদেশে পদ্ধতিগত জ্ঞানচর্চা গইড়াই ওঠে নাই যখন, জ্ঞানের ইণ্ডাস্ট্রিই যখন নাই, সেই সময়ে এন্টি-স্টাব্লিশমেন্ট নামক বস্তু ছিল কেবলই বাতাসি প্রলাপ, যা পরে অনেকেরই বুঝে আসছে। খান সাহেব অন্তত সেই প্রলাপের স্রোত থিকা কিছুটা মুক্তি দিতে পারছেন এই প্রজন্মের তরুণদের, এইটা তার কৃতিত্ববিশেষ।
খান সাহেবের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার বাগ্মীতা। চিন্তারে সূচারু বক্তব্যে রূপ দেওয়ায় খানের জুড়ি নাই। বাঙলাদেশে পাবলিক লেকচারারের ধারণা এবং পাবলিক লেকচারার হওয়ার আগ্রহরে জনপ্রিয় কইরা তোলার পেছনে খানের অবদান অস্বীকার করা যায় না। বলাবাহুল্য, আমাদের অ্যাকাডেমিয়ায় এখন যে আমরা মোহাম্মদ আজমের মতো বক্তা পাই, তার পরোক্ষ প্রণোদনা হিশাবে খান আমাদের সামনে থাকবেন। জ্ঞানচর্চা বলি বা জ্ঞান বিনিয়োগ, এরে স্মার্ট ও গ্ল্যামারাস (আবেদনময় বলতে পারেন) কইরা তোলায় খানের বিশেষ অবদান আছে। যদিও খানের বক্তব্যের নানাবিধ ক্রিটিক শ্রোতামহলে চালু আছে। খান চলেন ডালে ডালে, পাতায় পাতায়। ফলে খানের কথাবার্তার শিকড়ের সন্ধান পাওয়া খুবই মুশকিল হইয়া পড়ে। আমারও এই অভিজ্ঞতা হয় নাই, তা না। সেইটারে খানের অযোগ্যতা বলার মতন যোগ্যতা নাই বিধায় এই নিয়া আর চিন্তাক্ষয় করি নাই, নিজের অজ্ঞতাই সার ভাবছি।
খানের এই সকল গুণাবলি তার ভেতর একজন শক্তিশালী পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের সম্ভাবনা জাগায়ে তুলছিল, যিনি বাঙলাদেশের উপর চাইপা বসা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একরৈখিক মিথ্যা, এবং এই মিথ্যাজাত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অচলায়তনগুলিরে জ্ঞানের অবজেক্টিভিটি, বিদ্যাবুদ্ধির মৌলিকত্ব ও চিন্তার ডায়নামিক্স দিয়া প্রবল আঘাতে ক্ষতবিক্ষত কইরা তুলবেন। সেই প্রস্তুতি খানের পুরামাত্রায় ছিলও বটে, খান তা হইয়া উঠছিলেনও, বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ডোমিনেন্ট হিস্ট্রিকাল ডিস্কোর্স অনুসারে তিনি তার লেখালেখির কারণে `মৌলবাদী` তকমাও পাইছিলেন। কিন্তু জানি না কেন, ২০১৩ সালে বাঙলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিনির্মাণের ডিসাইসিভ মুহূর্তটিতে খান সাহেব সেই পথ থেকে যেন সরে দাঁড়াইলেন খানিক। এই সরে আসাটা বিস্ময়কর না হইলেও, কিছুটা অস্বস্তির তো ছিল বটেই, খানের ভক্তদের অনেকেই সেই অস্বস্তি আজও লালন করেন। গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে কোমর বাইন্ধা নামা তার একটা প্রকাশ মাত্র ছিল; `মেহেরজান বিতর্ক` ও মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খানের তখনকার বক্তব্য শুনলে মনে হবে, হুজুগের বশে গণজাগরণ মঞ্চের আবেগী সাপোর্ট না খালি, খানের এই চয়েজ ছিল খুবই পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার অংশ।
ঘটনা এইখানেই শেষ হইলে হয়ত ভালো হইত। কিন্তু যেহেতু সলিমুল্লাহ খান বাঁইচা আছেন, তাই ঘটনাও শেষ হয় না। ২০১৩ সালের সেই সলিমুল্লাহ খানই, ২০১৮ সালে হেফাজত-আওয়ামী লীগ সমঝোতার সূত্রে পাওয়া `কওমি স্বীকৃতি` এবং ইত্যকার ডিবেটে আরো একদফা বিস্ময়রুপে টকশোগুলাতে নাজিল হইলেন। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির পক্ষে তার সাফাই-সাবুদ যতটা না কওমি মাদ্রাসার প্রতি দরদপ্রবণ, তারও অধিক আওয়ামী লীগের প্রতি প্রতিরক্ষপ্রবণ ঠেকলো সেই সময়। নতুবা এককালের কঠিন হেফাজত-বিরোধী খান সাহেব যখন হেফাজতেরই এক বিখ্যাত নেতার ব্যাপারে বললেন যে, সে অনেক ভার্সিটি অধ্যাপকের চাইতেও ভালো বাঙলা জানে, সেই প্রশংসারে বানানো প্রশংসা মনে করার কারণ যথেষ্টই আছে।
২০১৩-র সেই রাজনৈতিক অবস্থান সলিম সাহেবের জন্য পরে গিয়া খুব একটা সুখকর হয় নাই। দেশের যে প্রতিভাবান তরুণেরা একটা নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনির্মাণের স্বপ্নে সলিম খানের সেমিনারের আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন, তাদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হইছে। সলিম খানের কথাবার্তারে সন্দেহের চোখে দেখা এবং বাঙলাদেশের ডোমিনেন্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বর্গ, যা তরুণদের কাছে ব্যাপক বিরাগভাজন এবং `ফ্যাসিবাদ` নামে হাজির, তার একজন সুচতুর সমর্থক হিশাবে তারে দেখা, পড়া ও শোনার চল শুরু হইছে, যা তার পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হইয়া ওঠার পথে একটা (আপাত:) স্থায়ী প্রতিবন্ধক তৈরি করছে। আপাত:, কারণ রাজনীতিতে শেষ বলতে কোন কথা নাই।
অবশ্য, গায়েবের খবর খোদা জানেন। মোহাম্মদ আজমের মতন কেউ কেউ মনে করেন, সলিমুল্লাহ খানের মত লোকের সিদ্ধান্ত, তা যাই হউক, অবজেক্টিভ হওয়াই অধিক সঙ্গত। হইতেও পারে তা, সলিমুল্লাহ খানের শাহবাগ হয়ত আর দশজনের শাহবাগের চাইতে ভিন্নতর চিন্তা-চেতনারই ফসল। সলিম খানের মত লোকের ব্যাপারে এই ধারণা অযৌক্তিক না। কিন্তু ইতিহাস ও সময়ের কাঠগড়ায় সলিমুল্লাহ খানের সেই চিন্তার রুপরেখা আঁকা থাকবে না হয়ত (যেহেতু এই বিষয়ে সলিম খান এখনও কোন স্বভাবসুলভ অবজেক্টিভ আলাপের অবতারণা করেন নাই), থাকবে কেবল ইতিহাসের একটা বিশেষ ঘটনা ও মুহূর্তরে, সেই মুহূর্ত ও ঘটনার কুশীলবদেরে তার প্রাণপণে সাপোর্ট দিয়া যাওয়ার কথা। তার সাথে সাথে, আজকে বাঙলাদেশ যেই কলঙ্কজনক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কালপর্বে উপস্থিত, তার একজন অনুঘটক হিশাবে, এবং ভবিষ্যৎ বাঙলার চিন্তাজগতে, ব্যক্তিগত সমূহ প্রভাব সত্ত্বেও, সময়ের স্রোতের সাথে গা ভাসানো বা স্রোতের সামনে থেকে সইরা দাঁড়ানো একজন গণবিরোধী চিন্তক হিশাবেই তিনি চিত্রায়িত হবেন— এমনই মনে হয়। যদি তাই হয়, বাঙলাদেশের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের জন্য সেইটা হবে এক গভীর ট্রাজেডি।