সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

বাইরে থেকে দেখা: সিপিবি-বাকশাল

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০১৯

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন যে, বাকশাল গঠনে সিপিবির কোনো সায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে অন্য সব দলকে নিষিদ্ধ করলে সিপিবির সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। বাকশালে যোগ দেয়া অথবা পার্টিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া। সিপিবি প্রথম পথ বেছে নিয়েছিল। তবে পার্টি বিলুপ্ত করেনি। গোপনে একটি সেল বা কোর গ্রুপ চালু রেখেছিল। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের এই পোস্ট যদি তৎকালীন পার্টি মিটিংয়ের কার্যবিবরণীতে থেকে থাকে, তাহলে তার পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। সিপিবির মতো একটি দলে সকল দলিল ও রেকর্ড সংরক্ষিত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পার্টির সভাপতি হিসাবে হয়তো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সেই কার্যবিবরণী এতদিনে পাঠ করার সুযোগ পেয়েছেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষে কোনো ভিত্তিহীন পোস্ট দেয়া কঠিন।

(৪৪ বছরের প্রচলিত ধারণা নিয়ে প্রশ্ন যখন উঠেছে, খননকার্য চলতে থাকবে। বঙ্গবন্ধু কাদের সাথে পরামর্শ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই সত্যও নিশ্চয়ই একদিন বেরিয়ে আসবে।) আমি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পোস্টকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করেই কয়েকটি কথা বলতে চাই।

পঞ্চাশ বছর দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সিপিবি এবং তার গণসংগঠনগুলো একনাগাড়ে সার্ভিস দিয়ে গেছে। সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী, ক্ষেতমজুর সমিতি, মহিলা পরিষদ, কৃষক সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কথা বলেছে আওয়ামী লীগের ভাষায়। সিপিবি নিজে কখনো ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখেনি, বরং সবসময় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে সহযোগিতা করেছে। স্বাধীনতার পর দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসুসহ সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল তারা। তখন থেকে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সদস্যরা ভোট দিয়েছে নৌকা মার্কায়। ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সালে আসন সমঝোতা ছিল দুই দলের। বাকি সবসময় ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচীসহ সকল গণসংগঠনের সদস্যদের ভোট পড়েছে নৌকার বাক্সে। অনেক আসনে নিজেদের দলীয় প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও।

হিসাবটা সহজেই পাওয়া যায়। প্রত্যেক আসনে অন্তত পাঁচ হাজার লোক আছে যারা প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন সদস্য। কিন্তু সিপিবির প্রার্থী পেয়েছে মাত্র ৩০০-৫০০ ভোট। বাকি ভোট চলে যায় নৌকা মার্কায়। অর্থাৎ সুশৃঙ্খল পার্টি হিসাবে সিপিবি-কে আমরা যতটা প্রশংসা করি, পার্টি ততোটা সুশৃঙ্খল নয়। ছাত্র ইউনিয়ন সদস্যদের শতকরা ৯৯ জন ছাত্রজীবন শেষে আর পার্টির কোনো উইং-এর সাথে সম্পর্ক রাখেনি। এর পেছনে প্রধানত কাজ করেছে সেই মনস্তত্ত্ব, সিপিবি ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কাজেই বিএনপি-জামাতকে ঠেকাতে হলে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে। ট্রাজেডির বিষয় হচ্ছে এই মনোভঙ্গি কিন্তু প্রচার করেছেন পার্টির নেতৃত্বই। তখন প্রশ্ন জাগে, তারা নিজেদের প্রার্থী তাহলে দিতে গেলেন কেন?

এখন এই আমলে এসে পার্টিনেতৃত্বের একাংশ এবং ছাত্র ইউনিয়ন-উদীচীর একাংশের আওয়ামী-মোহ ভঙ্গ হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ এখন চিহ্নিত লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী সরকার। জনসাধারণের বিপক্ষে তাদের অবস্থান। ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ভোটের বাক্স আগের রাতে ভরে ফেলা ছাড়া আওয়ামী লীগের গত্যন্তর ছিল না। কারণ অন্য কেউ না জানলেও সকল সংস্থার জরিপের সত্যটি প্রধানমন্ত্রী জানতেন। সত্যিকারের নির্বাচন হতে দিলে তাঁর প্রার্থীরা জিততে পারবে না। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন আমলাতন্ত্রকে, পুলিশ-র‌্যাবকে, সেনাবাহিনীকে। টাকা জুগিয়েছে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ঋণখেলাপি বিদেশে টাকা পাচারকারী ব্যবসায়ীরা। ফলে ক্ষমতা এখন নামেমাত্র রাজনীতিবিদদের হাতে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও হতাশা প্রকাশ করেন যে তাদের কথার কোনো মূল্য দেয় না কেউ। পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যরা সরাসরি বলেই ফেলে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছি আমরা। ফলে যারা মধ্যরাতের নির্বাচন করে দিয়েছে তাদেরকে অঢেল সুযোগ-সুবিধা দিতে সরকার বাধ্য। দিচ্ছেও তাই। তারা ইচ্ছামতো বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নিচ্ছে, সরকারের নীতিমালা ঠিক করে দিচ্ছে, ঋণ খেলাপিদের শাস্তি থেকে রক্ষা করছে, বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে।

এই অবস্থায় আওয়ামী সরকারকে সমর্থন করা নৈতিক দেউলিয়াপণার চূড়ান্ত উদাহরণ। তাই সিপিবিকে মুখ খুলতেই হচ্ছে। নিজেকে আওয়ামী বলয় থেকে সরিয়ে নিতে হচ্ছে। সেটাও যে সর্বাংশে সফল হচ্ছে তা-ও না। কারণ সিপিবি এবং অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে পুরনো ধারায় অভ্যস্তদের দ্বারা বাধা আসছে পদে পদে। এমনও শোনা গেছে গত সংসদ নির্বাচনে মঞ্জুরুল আহসান খানসহ তিনজনকে মনোনয়ন দিলে সিপিবি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহযোগী হবে। আওয়ামী লীগ দেয়নি।

জানি না সিপিবি-র নেতারা এখন ঠিক কোন লাইনে ভাবছেন। তবে কোনো সুনির্দিষ্ট লাইন যে এখনো তারা গ্রহণ করতে পারেননি, তা বোঝা যায়। এই রকম দোদুল্যমানতা থাকলে ক্ষীণকায় সিপিবি আরো ক্ষীণকায় হয়ে যাবে। তাদের উচিত যারা আগের মনস্তত্ত্বে আছে, (পার্টির মধ্যে, ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে, উদীচীর মধ্যে) তাদেরকে আওয়ামী লীগে চলে যেতে বলা। তারপরে যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে, তা নিয়ে নিজের অবস্থান গড়ে তোলার জন্য কাজ করা।

আগে যা হয়েছে তা নিয়ে হা-হুতাশ না করে এখন নিজেদের পথে চলাটাই বোধহয় সময়ের দাবি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক