বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ‘পাঠশালা’ শিক্ষা
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
মুসলিমদের আগমনের আগে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বৈদিত শিক্ষা ব্যবস্থায় স্পষ্ট বলা ছিল শূদ্র এবং নারীরা বেদ পাঠ এবং বেদ শুনতে পারবে না। মূলত বৈদিক শিক্ষায় বেদই পড়ানো হতো, শিক্ষার্থীকে পুরো বেদ মুখস্থ রাখতে হতো। বেদ শিখবার জন্য তখনো লিপি বা পুঁথি ছিল না। সকলকে শুনে শুনে বা বারবার আবৃত্তি করে তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে হতো। বর্তমান সময়ের “আবৃত্তি” কথাটা এখান থেকে এসেছে। কিছু হাতে গোণা শূদ্র যাঁরা ছিলেন কায়স্থ বা করণিক তাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য কিছু লেখাপড়া করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু বেদ পড়বার বা শুনবার অধিকার ছিল না তাদের। শিখতেন লিপি সরকারি নির্দেশ লিখে প্রচার করার জন্য। নিম্নবর্গের মধ্যে যাঁদের বলা হতো অন্ত্যজ তাঁদের সামান্য লেখাপড়া করার সুযোগ তখন ছিল না। মুসলিম শাসকরা সুবিধাভোগী হিন্দুশ্রেণীর কবল থেকে নিম্নবর্গের হিন্দুদের শিক্ষালাভের সুযোগ করে দেন। ফলে নিম্নবর্গের হিন্দুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়।
মুসলিম শাসকদের শাসনে ষোল শতকের বাংলায় পূর্বের ব্রাহ্মণদের নিয়মের বহু ব্যত্যয় ঘটে। বেদপাঠে সকলের অধিকার না থাকলেও শিক্ষা লাভের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। হিন্দুসমাজের চার বর্ণের শিশুরাই পঞ্চম বর্ষে বিদ্যারম্ভ সংস্কার বা হাতেখড়ির অধিকার লাভ করে। মুসলিম শাসকরা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য যে করমুক্ত ভূমিদান করতেন তা শুধু মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই ছিল না, হিন্দুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যও করমুক্ত তথা লাখেরাজ সম্পত্তি দান করা হতো। মুসলিমদের শাসনে নিম্নবর্ণের মানুষদের গুণের কদর ছিল তার প্রমাণ, ‘নল দায়মন্তী’র কবি মধুসূদন ছিলেন একজন নাপিত। একজন ধোপা ভাগমন্ত ধোপী ‘হরিবংশ’ লিখে সম্মান লাভ করেন। নিম্নবর্ণের দু-একজন নারীও যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন। দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ’বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে স্বীকার করেন, বাংলা দেশে পাঠান শাসনের প্রাবল্যের যুগ ছিল এক বিষয়ে বাংলার ইতিহাসের সর্বপ্রধান যুগ। কারণ এই সময় থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রাণ পেতে শুরু করে। নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যেও সাহিত্যচর্চা শুরু হয়।
সুলতানী আমলে বাংলায় শিক্ষার তিনটি স্তর ছিল। যথা প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চস্তর। মুসলিম সমাজের প্রতিটি শিশু চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে উপনীত হলে তাকে সুন্দর পোষাকে সাজিয়ে পরিবারের সকল সদস্য ও অন্যান্য স্বজনদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদানের সূচনা করা হতো। শিশুটিকে কুরানের কিছু অংশ পাঠ করানোর চেষ্টা চলতো। শিশুটি পড়তে না চাইলে তাকে অন্তত ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করানোর প্রথা ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় বিশুদ্ধ উচ্চারণের দিকে জোর দেওয়া হতো। বাংলায় সুলতানী শাসনামলে মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরের বিদ্যালয়গুলো ‘মাদ্রাসা’ নামে আখ্যায়িত ছিল। মধ্যযুগের এই মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। কিন্তু ধর্মের বাইরেও নানা বিষয় পড়ানো হতো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাগুলি সাধারণত রাজধানী ও নগরগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাদ্রাসায় আরবী এবং ফারসী ভাষা শিখতে হতো। মুঘল শাসনে মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যক্রম যথেষ্ট বিস্তৃত করা হয়েছিল। আকবরের সময়ে পাঠক্রমের মধ্যে ছিল গণিত, জ্যামিতি, হিসাব, কৃষি, ভূমি জরিপ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, প্রকৃতি বিজ্ঞান, শরীরবিদ্যা ও ও নীতিশাস্ত্র।
মাদ্রাসার শিক্ষামাধ্যম প্রধানত ছিল ফারসী। সংস্কৃত গ্রন্থগুলি ফার্সীতে অনুবাদের পাশাপাশি আকবর হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করেন। কিছু কিছু মাদ্রাসায় ‘সংস্কৃত’ শেখার ব্যবস্থা ছিল। মুঘল যুগের বাংলায় দেখা গিয়েছিল, হিন্দুরাই প্রধানত মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে এবং ফারসী ভাষা শিখে সরকারের বড় বড় পদ লাভ করতেন। বাংলার বড় বড় সরকারী পদ মুঘল শাসনে হিন্দুদের দখলেই ছিল। মুর্শিদকুলী খানের সময়ে বাংলার পনেরো জন বড় জমিদার আর একুশজন ছোট জমিদারদের মধ্যে মাত্র দুজন দুজন চারজন ছিলেন মুসলমান। বাকিরা সবাই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল সেই অর্থে অভিজাতদের জন্য। সুলতানী বা মুঘলদের যুগের প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে মক্তব, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা সহ সংস্কৃত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল অবৈতনিক। শিক্ষকরা বিনা বেতনেই ছাত্রদের নিজগৃহে শিক্ষা দিতেন এবং স্থানীয়দের সাথে মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন। তবে শিক্ষকগণ তাঁদের শিক্ষা প্রদানের জন্য শাসক কিংবা জমিদারদের পক্ষ থেকে ‘মদদ-ই-মাশ’ হিসেবে নিষ্কর ভূসম্পত্তি লাভ করতেন। ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকই ছিলেন প্রধানতম বিচারক। ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলেই তিনি ছাত্রকে সনদ প্রদান করতেন। রাষ্ট্র কর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিলো না। শিক্ষার্থীরা জানতো যে, শিক্ষকই তাদের মূল্য যাচাই করার একমাত্র কর্তা। সুতরাং এই শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য বাছাই করে পড়ার বা ফাঁকি দেয়ার অবকাশ ছিল না। বাংলার প্রথম আলোকপ্রাপ্ত মানুষ যাকে বলা হয় সেই রামমোহন রায় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন মাদ্রাসায়। পরে তাঁর পিতা তাঁকে বানারসের হিন্দু বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে পাঠালে তিনি সেখানে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সেখান থেকে চলে আসেন। যখন ইংরেজ সরকার কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রামমোহন তার বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেন সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে সত্যিকারভাবে শিক্ষার্থীদের আলোকপ্রাপ্ত হতে দেয়া হবে না।
বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে ব্রাহ্মণদের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে টোল বলা হতো। মুসলিম শাসক ও সম্পদশালী অভিজাত এবং জমিদারবর্গ করমুক্ত জমি দান করে মসজিদ, মন্দির, মক্তব, মাদ্রাসা ও টোলের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন। ষোল-সতেরো শতকে বাংলার টোলগুলি সারা ভারত জুড়েই খুব সাড়া ফেলেছিল। সরকারের উদার ভূমিদান ব্যতিরেকে বাংলায় সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা বা বাংলার টোলের শিক্ষাব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব হতো না। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, যখন মাগধী সভ্যতা নানাভাবে বিভক্ত ও চূর্ণবিচূর্ণ মগধের লোকরা তখন ক্রমাগত পূর্বমুখী হয়ে বাংলায় এসে বসবাস করতে শুরু করে এবং অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে টোল শিক্ষা বাড়তে থাকে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, বৌদ্ধ সঙ্ঘরামগুলি নষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে টোল বসার লক্ষণ আরম্ভ হয়। বাংলায় পনেরো-ষোল শতকে নবদ্বীপ বিদ্যাসমাজের উদ্ভব। নবদ্বীপ বিদ্যাসমাজের উদ্ভব থেকে বাংলাদেশে টোল-চতুষ্পাঠী কেন্দ্রিক সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা প্রসার লাভ করে। স্বভাবতই টোল ছিল সংস্কৃত মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসায় যেমন হিন্দুরা শিক্ষা লাভ করতে পারতো, টোলে মুসলমানদের জন্য সে-সুযোগ ছিল না। বর্ণ হিন্দুরাই শুধু টোলে পড়বার সুযোগ লাভ করতো।
ইতিপূর্বেই জানা গেছে, সংস্কৃত শিক্ষা লাভের জন্য প্রথমদিকে সাক্ষর হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল না। কিন্তু স্মৃতি ও শ্রুতির জায়গায় কালক্রমে বাংলার সংস্কৃত শিক্ষাধারায় পুঁথি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছিল। ষোল শতকের প্রখ্যাত বাঙালী স্মৃতিকার ছিলেন রঘুনন্দন। রঘুনন্দনের মতে তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে, যেমন ‘বাচিক’ বা উচ্চকণ্ঠে পাঠ, ‘উপাংশু’ বা অনুচ্চস্বরে পাঠ, এবং ‘মানস’ বা মনে মনে পড়া। সন্দেহ নেই, এই মানস চর্চা বা মনে মনে পড়ার সঙ্গে পুঁথির সম্পর্ক বাংলার সংস্কৃত শিক্ষা প্রক্রিয়ায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। যদিও শিক্ষক ও বাচনিক ধারার প্রাধান্য বজায় ছিল। আসলে পাণ্ডুলিপির ব্যবহার মূলত ও প্রধানত শিক্ষকের পড়ানোয় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা খুব সহজ ছিল না। কথিত আছে বাসুদেব পণ্ডিতের টোলে রঘুনাথ নবদ্বীপের পাঠ শেষ করেন। বাসুদেব নিজে আবার মিথিলায় গিয়ে মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের নিকট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সার্বভৌম উপাধি লাভ করে দেশে ফিরেছিলেন। দেশে ফিরে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি বলে তিনি ‘কসুমাঞ্জলি’ গ্রন্থটি অবিকল লিখে ফেলেন। বাসুদেবকে নিয়ে এরকম গল্প আছে একবার একজন তাঁর ঝোলার মধ্যে কী কী পুঁথি আছে দেখতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, ‘পুঁথিতে কী প্রয়োজন! গুরুর কৃপায় সবই স্মৃতিপটে অঙ্কিত আছে’।
রঘুনন্দনের মতে, যে ব্যক্তি শিক্ষালাভ করেছে তার আবশ্যিক কর্তব্য উপযুক্ত কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা। তিনি বেদের সাক্ষ্যে, যে ব্যক্তি শিক্ষালাভ করেছে অথচ শিক্ষাদান কর্তব্য পালন করেনি, তার মুক্তির পথ রুদ্ধ এমনই বলেছেন। এই শিক্ষাদান ত্রিবিধ উপায়ে করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ তিন উপায় হচ্ছে; শিক্ষক হিসাবে, কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যাকার হিসাবে বা পুঁথি রচনা করে। রঘুনন্দন সময়ের প্রেক্ষিতে মনুর অনেক বিধানেরই সংস্কার করেছিলেন। রঘুনন্দন পূর্বের ব্রাহ্মণদের মতো শূদ্রদের শিক্ষার ব্যাপারে কঠোর থাকেননি। কালানুসারে রঘুনন্দনের সময় বিদ্যারম্ভের সংস্কার হিসাবে উপনয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য হ্রাস পায়। ব্রাহ্মণের পক্ষে অবশ্য পালনীয় সংস্কার হিসাবে উপনয়নের গুরুত্ব বজায় থাকলেও তা শুধুমাত্র পৈতে সংস্কার হিসাবেই পালিত হতে থাকে। উপনয়নের সঙ্গে বিদ্যারম্ভের সম্পর্ক রীতিমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। অন্যপক্ষে প্রাক্-উপনয়ন বিদ্যারম্ভ সংস্কার প্রাধান্য পেতে থাকে যা হাতেখড়ি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। টোল ও চতুষ্পাঠীর শিক্ষায় দেখা যায় কাব্য-ব্যাকরণের প্রাধান্য। বিশেষ করে বাংলার টোলগুলি সম্পর্কে একথা খুবই ঠিক।
সতেরো শতকে নবদ্বীপের টোলগুলি খুব জোরেসোরে চালু হয়েছিল। যারা সাহিত্যচর্চার জন্য নবদ্বীপের টোলে আসে তারা প্রত্যেকেই টোলের বৃত্তি লাভ করে। তারা যে সকল গ্রন্থ পাঠ করে তা কণ্ঠস্থ করে ফেলতে হয়। যখন দুজন অধ্যাপক দর্শন নিয়ে কোনো একটা মত নিয়ে তর্ক করেন ছাত্রছাত্রীদের তা শুনবার অধিকার থাকে। যদি কারো কাছে অধ্যাপকদের আলোচনা ও তর্ক দূরূহ বা জটিল মনে হয়, তাহলে সেই ছাত্র সর্বদা প্রশ্ন করে বিষয়টি বুঝে নেয়ার অধিকার রাখে।নবদ্বীপের টোলে সাধারণত স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র পড়ানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে নদীয়ার খ্যাতি ছিল ভারতব্যাপী। ভারতের সর্বস্থান থেকেই এখানে ছাত্ররা অধ্যয়ন করতে আসে। স্মৃতির টোলে সাধারণত আট বছর পড়তে হয়, ন্যায়ের টোলে দশ বছরের কম নয়। টোলগুলি মাসে দশদিন করে বন্ধ থাকে। প্রতিপদ, অষ্টমী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, পৌর্ণমাসী, শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের দুই তিথিতে টোল বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়াও স্বরস্বতী পূজায় দু সপ্তাহ এবং অন্যান্য পর্ব উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা ছুটি পায়। ন্যায়ের টোলের ছাত্ররা আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত ছুটি ভোগ করে, স্মৃতির টোলের ছাত্ররা ভাদ্র হতে কার্তিক পর্যন্ত। নবদ্বীপের টোলের পাঠ শেষ করতে পারলে সে পণ্ডিত ভারতের সমস্ত বিদ্যাকেন্দ্রে সম্মানিত হন।
ন্যায়ই নবদ্বীপের টোলগুলির পাঠ্যক্রমের প্রধান দিক ছিল। বাংলার হিন্দু টোলগুলির এই ন্যায়শাস্ত্র বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধরা স্মৃতি-শ্রুতি স্বীকার করে না। সুতরাং তর্কবুদ্ধি তাদের প্রধান অবলম্বন। স্বয়ং বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘পণ্ডিতরা যেভাবে সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে নিকষ পাথরে পরীক্ষা করে থাকে; হে ভিক্ষুগণ, তোমরা আমার কথাগুলিকে সেভাবে পরীক্ষা করে গ্রহণ করবে। কেবল আমার গৌরব রক্ষার জন্য তা গ্রহণ করবে না।’ যার অর্থ দাঁড়ায় বুদ্ধ তার শিষ্যদের অন্ধভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করতে না করেছিলেন। কিন্তু স্মৃতির বিধান অন্ধভাবেই পালনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের সেই আদিপর্বে হিন্দু দার্শনিকগণ তর্কবিতর্ক দ্বারা সত্য নিরূপণ করার চেষ্টা করতেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে শাস্ত্র নিয়ে এধরনের চর্চা বেশ সম্মান লাভ করেছিল এবং সমাজে প্রতিষ্ঠাও মিলছিল। সত্যিকারভাবে সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে টোল আর চতুষ্পাঠীর মধ্যেও কিছু প্রভেদ ছিল। চতুষ্পাঠী কথার অর্থ চারবেদ পাঠের প্রতিষ্ঠান, যদিও অন্য শাস্ত্র পাঠের সুযোগও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, উত্তর ভারতের সংস্কৃত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চতুষ্পাঠীতে বেদবিদ্যা অধ্যয়ন আবশ্যিক হলেও বাংলার টোলে বেদ পাঠের তেমন প্রচলন ছিল না। বাংলায় সাধারণত তিন ধরনের টোল ছিল। কিছু টোলে প্রধানত ব্যাকরণ, সেই সঙ্গে সাহিত্য, অলঙ্কার ও কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। দ্বিতীয় ধরনের টোলে প্রধানত স্মৃতি এবং সেই সঙ্গে কখনো পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হতো। আর তৃতীয় ধারার টোলে ন্যায়শাস্ত্রই ছিল প্রধান পাঠ্য বিষয়।
সাধারণত কোনো বিশেষ টোলে কোনো একটি বিষয়েই উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু প্রায় সব টোলেই ব্যাকরণ ও অলঙ্কার পড়ানো হতো। হয়তো টোলের বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের পরিবর্তে কোনো প্রবীণ ছাত্র এই সব বিষয়ে পাঠ দিতেন। আবার ব্যাকরণ, অলঙ্কার বা কাব্য-সাহিত্যেও উচ্চতর বিশেষজ্ঞ শিক্ষার প্রচলন ছিল। এইসব বিষয়ে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্তরা সাধারণত ব্যাকরণতীর্থ, কাব্যতীর্থ বা কাব্যরত্ন উপাধি লাভ করতেন। যাঁরা ন্যায়শাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্রে অথবা উভয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষালাভ করতেন তাঁরা ন্যায়তীর্থ বা স্মৃতিতীর্থ অথবা উভয় উপাধিই লাভ করতেন। একই বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষক ভিন্ন উপাধিও প্রদান করতেন যেমন, স্মৃতিরত্ন, কাব্যরত্ন, ন্যায়রত্ন, ন্যায়বাগীশ বা তর্করত্ন প্রভৃতি। খুব কম ক্ষেত্রেই একজন শিক্ষার্থী পাঁচ বা সাতটি বিষয়ে উচ্চতর বিশেষজ্ঞ শিক্ষা পেতেন। এসব ছাত্রেরা পঞ্চতীর্থ বা সপ্ততীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতেন। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে সাধারণত একাধিক শিক্ষকের কাছে বিভিন্ন টোলে শিক্ষা লাভ করতে হতো। সংখ্যা কম হলেও যাঁরা বেদ বা বেদান্তে বিশেষজ্ঞ হতেন তাঁরা বেদান্ততীর্থ উপাধি পেতেন। শিক্ষার্থী টোলে দীর্ঘদিন ধরে এই যে শিক্ষা লাভ করতেন, সমাজ-রাজনীতি বা দেশের অর্থনীতির সাথে এর সামান্যতম যোগ ছিল না। সংস্কৃত এই শিক্ষাধারা ছিল সম্পূর্ণ বিমূর্ত ও ঊর্ধ্বমুখী। শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র জীবন-মৃত্যু-পরজন্ম ইত্যকার ভাববাদী প্রশ্নে পণ্ডিত বানিয়ে তুলতো। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এসব শিক্ষার কোনো কাজে আসতো না। সত্যিকার অর্থে এসকল শিক্ষার ব্যবহারিক দিক বলে কিছু ছিল না। পুরোটাই ছিল বৈদিকধর্মকে ঘিরে নানা প্রশ্নের উত্তর খুজে বেড়ানো, যার সঙ্গে বাস্তব কর্মযোগের সম্পর্ক ছিল না। কারো কারো ক্ষেত্রে চল্লিশ বছর হয়ে দাঁড়াতো শিক্ষা জীবন।
মাদ্রাসায় ভাববাদী ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার সমাহার ঘটেছিল। মাদ্রাসা শিক্ষা কিন্তু টোলের মতো ছিল না। মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হলেও পাশাপাশি ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র সবকিছুই পড়ানো হতো। মাদ্রাসা শিক্ষায় পাশ্চাতের বহু বিষয় স্থান করে নিয়েছিল। মুঘলরা যখন ভারত জয় করে পাশ্চাত্যে তখন রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের কাল। মুঘলরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে বহু কিছু গ্রহণ করতে দ্বিধা বোধ করেনি। মুঘলদের আগমনে সারা ভারতের শিক্ষাধারা ব্রাহ্মণ বা হিন্দুদের রাজত্বের চেয়ে ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে। মুঘল যুগের শেষভাগে পাঠক্রমে যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানগুলির প্রাধান্য দেখা যায়। সত্যি বলতে, যখন চার্চের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা বন্ধ হয়ে যায়, মাদ্রাসাই ছিল তখন শিক্ষার প্রগতিশীল ধারা। প্রাচীন গ্রীসের বহু শিক্ষাই মাদ্রাসায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্লাটো আর য়্যারিস্টটলের বহু গ্রন্থ মাদ্রাসায় পাঠ্য করা হয়েছিল। খ্রিস্টান গির্জা বা বৈদিক ধর্মের মতো ইসলামে নারীর জন্য শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল না। ফরাসী বিপ্লবের সময় ফরাসী দেশে অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিপ্লবীরা ক্ষমতা গ্রহণের পর সেগুলি সব নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছিল চার্চের অধীনে কট্টরভাবে ধর্মশিক্ষার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধীনে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রিত হতো। বিপ্লবী সরকার তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিষিদ্ধ করে রুশোর শিক্ষাচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উপর জোর দেয়।
মুসলিম শাসনে মধ্যযুগে বাংলার গ্রাম সমাজের সম্পর্কবিন্যাসে একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আর তা হলো, সমাজের তলা থেকে, প্রধানত মধ্যবর্ণ থেকে উঠে আসছে কয়েকটি গোষ্ঠীÑসদ্গোপ, আগুরি, চাষিকৈবর্ত। মধ্যযুগের শেষদিকে সম্পন্ন কৃষকের স্তরে এদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আর সেই সঙ্গে রয়েছে শেখ মুসলমানরা। কৃষির তত্ত্বাবধান ছাড়াও চালের কারবার আর তেজারাতি ব্যবসাতেও এঁরা যুক্ত হচ্ছেন, কিছু উদ্ধৃত্ত অর্থ এঁদের হাতে থাকছে। মন্দির নির্মাণ করে, ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করে এঁরা নিজেদের বর্ণাভিজাত্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হলেন। হিতেশরঞ্জন সান্যাল দেখান যে, বাঙলার যে মন্দির স্থাপত্য হিন্দুদের গর্বের বিষয় সেই শিল্পের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মধ্যবর্ণের উঠতি গোষ্ঠীগুলি। দীর্ঘকাল ধরে বাংলায় শূদ্ররাই ছিল বৃত্তিধারী সমাজ। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষির পাশাপাশি প্রশাসনে করণিকের দায়িত্ব তাঁরাই পালন করতেন। লিপির ব্যবহার ছাড়া সাহিত্যচর্চা বা করণিকের দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল না। শূদ্ররা যে লেখাপড়া করতেন এর থেকেই বোঝা যায়। সুলতানী এবং মুঘল আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বাড়বাড়ন্ত এখন আর গল্প কথা নয়। সমানভাবে এ কথাও সত্যি, যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেছেন, তাঁদের লিপি বা পড়া লেখার সাথে সম্পর্ক ছিল।
শূদ্ররা লেখাপাড়ার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন দেখা যায় গুপ্তদের যুগ থেকেই। সৎশূদ্র বা কায়স্থ হিসেবেই সমাজে তাঁদের মতো কিছু মানুষের স্থান হয়েছিল। সাহিত্য চর্চায় তখন তাঁরা মনোযোগ দিয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। কিন্তু অসৎ শূদ্ররা ছিল গুপ্ত ও পাল যুগে একেবারেই পশ্চাদপদ। না ছিল বিত্ত না ছিল মর্যাদা। মুসলিম শাসনেই সম্ভবত অসৎ শূদ্রদের সমাজে কিছুটা মর্যাদা জায়গা তৈরি হয়। বিশেষ করে ডোম-চণ্ডালদের ব্যাপারে এ কথা বলা যায়। বনমালী গোষ্ঠী হিসেবে ডোম-চণ্ডলদের তখন একটা খ্যাতি ছিল। জমিদারের সেনাবহিনীর অগ্রভাগে থাকতেন ডোমেরা, যার কথা কয়েকশো বছর ধরে শোনা গেছে, ঘুমপাড়ানি ছড়ায়, ‘আগে ডোম, বাগে ডোম, ঘোড়া ডোম সাজে’। মুসলিম শাসনের পূর্বে সবচেয়ে সমস্যা হয় চণ্ডালদের নিয়েই। ঘৃণাসূচক শব্দই এদের সম্পর্কে প্রয়োগ করা হয়েছে স্মৃতিশাস্ত্র বা পুরাণসাহিত্যে। যাঁরা নমশূদ্র বলে পরিচিত তাঁদেরকেই এক সময় মনে করা হতো চণ্ডালদের বংশধর। নমশূদ্ররা আবার চণ্ডালদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন ডোমদের। এই চণ্ডালরা প্রায় পুরো বাংলা জুড়েই আছেন। কৃষিজীবীর সম্মান এঁরা পাননি। চণ্ডালদের ভিতর তেমন কোনো সামাজিক আন্দোলনও দেখা যায়নি। প্রাচীন সাহিত্যে চণ্ডালদের বর্ণনা করা হয়েছে ‘নিকৃষ্ট দর্শন’ বলে। বলা হয়েছে যে-গ্রামে চণ্ডাল বাস করে, সেই গ্রামে বেদমন্ত্র পর্যন্ত উচ্চারণ করা উচিৎ নয়। কিন্তু বাংলার মধ্যযুগের ইলিয়াসশাহী শাসনে এবং পরবর্তীকালে মুঘলদের শাসনের ইতিহাসে দেখা যায় চণ্ডালরা পড়াশুনা করছে, শিক্ষকতা করছে। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও এঁদের যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলে।
মুঘল আমলে বিশেষ করে সতেরো শতক নাগাদ বাংলার অর্থনীতি যথেষ্ট গতিশীল হয়ে উঠেছিল। মুঘল শাসনে বড় যে ঘটনাটা ঘটেছিল তা হলো পর্তুগীজ বণিকদের আগমন। পর্তুগীজরা বাংলাদেশে ব্যবসা করার সনদ পেয়েছিল গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের সময়ে। পর্তুগীজদের পর বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে পড়লো ওলন্দাজ, ইংরেজ, দিনেমার ও ফরাসীরা। বিদেশীদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বাংলায় পণ্যের নতুন নতুন বাজার খুলে গেল। বাংলা থেকে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানী হতে থাকলো ইউরোপের বাজারে। বিদেশী বণিকরা যতদিন পর্যন্ত বঙ্গদেশে ব্যবসা করার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো, বাংলার জন্য তা সুফল বয়ে আনলো। ইউরোপের বাজারে তখন বাংলার মসলিন সহ বহু পণ্যের ভীষণ কদর। বিদেশী বণিকরা কেবল বাংলা থেকে পণ্য নিয়ে যায়নি, নিজদেশের পণ্য নিয়ে এলো ভারতের বাজারের জন্য। মরিচ আর তামাক পর্তুগীজদের আমদানী। পর্তুগীজরা বাংলায় লঙ্কা নিয়ে আসার আগে পর্যন্ত ভারতীয় রান্নায় গোল মরিচ আর আদা ছাড়া ঝালের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পর্তুগীজরা তামাক এনেছিল ষোল শতকে, কিন্তু সতেরো শতকের প্রথম দিকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়লো। সম্রাট আকবর পর্যন্ত তামাকের ভক্ত ছিলেন। বিলাসদ্রব্য হিসেবে তামাক খুব কম সময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদেশীদের এই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রথমে নীরবে ছড়িয়ে পড়লো। বিদেশী ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছিল কিন্তু সাধারণ মানুষকে ঘিরে। রাজন্যবর্গরা প্রথমে এসব দিকে সেভাবে নজর দেননি। বাংলার সাধারণ মানুষের এক অংশকে তাই পণ্য বিনিময় এবং টাকা লেনদেনের জন্য হিসেবটা খুব দক্ষতার সঙ্গে বুঝতে হতো। দক্ষ জনবল তৈরির জন্য তাই নতুন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার দরকার ছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ভাষায়। বাংলা ভাষায় ‘পাঠশালা’ নামক নতুন শিক্ষাধারা সেসব ব্যাপারে সহায়ক হয়েছিল। পর্তুগীজরা ব্যবসা করেই ক্ষান্ত হয়নি, অনেকে স্থানীয় জমিদার এবং সুলতানদের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতো। অনেক আবার নিজেরাই জমিদার হয়ে বসেছিল। রাতারাতি ধনী হবার জন্য জলদস্যু বাহিনী গঠন করেছিল তাদের মধ্যে একদল। বাংলায় পর্তুগীজ দস্যুদের নাম হয়েছিল হার্মাদ। পর্তুগীজদের সাথে বাংলার সাধারণ মানুষের সম্পর্ককে ঘিরে সর্বজনবোধ্য এক ভাষা চালু হয়েছিল, যাকে বলা যায় এক ধরনের ভাঙা পর্তুগীজ। কপি, বিস্কুট, সাগু, কফি, সালসা, আতা, পেয়ারা, পেঁপে, কাজু, গীর্জা, যীশু ইত্যাদি পর্তুগীজ শব্দ। পর্তুগীজ বণিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য দেশীয়রা যেমন পর্তুগীজ ভাষা শিখেছিলেন, স্থানীয়দের সাথে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য বাংলা শিখেছিলেন পর্তুগীজ বণিক আর পাদ্রীরা। বাংলা ভাষা শেখায় সহায়তা হবে মনে করে, তাঁরা বাংলা শেখার বই তৈরি করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রথম যে বইটি ছাপানো হয়, তার নাম ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’। সতেরশো তেতাল্লিশ সালে লেখা। পর্তুগীজদের ছাপাখানা ছিল কিন্তু বাংলায় ছাপার অক্ষর তখন ছিল না বলে রোমান হরফে এই বাংলা বইটি মুদ্রিত হয়।
সতেরো শতক বা তার আগে থেকে বঙ্গে ও বিভিন্ন স্থানে এরকম বহু কিছুই ঘটে যাচ্ছিলো, সরকারের সে-সব ব্যাপারে তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারের ফলে যথেষ্ট পরিমাণ রূপা আমদানি হতে থাকে। দেশে মুদ্রা অর্থনীতির প্রসার ঘটে। বাণিজ্যিক শস্যের উৎপাদন, রমরমা ধানচালের কারবার, বস্ত্রশিল্পের রপ্তানি সতেরো শতকের গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুদ্রার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুঘল আমলেই বাংলার রেশম ও চিনিশিল্পের প্রসার ঘটে। সতেরো শতকে মুদ্রা অর্থনীতির এই প্রসারের সঙ্গে হিসাবের জটিলতা ও অঙ্ক শেখার প্রয়োজন বাড়ার একটা সম্পর্ক স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। তাছাড়া মুঘল আমলেই জমির পাট্টা, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদির প্রচলন ও গুরুত্ব সমধিক হয়। ফলে নথিপত্র লেখার কাজ শেখাও জরুরি হয়ে উঠে। স্বভাবতই অভিজাতরা করণিকের কাজ করতে লজ্জা বোধ করতেন। সমাজের নিম্নস্তরের লোকদেরই এই ধরনের কাজ করতে হতো। ফলে তাঁদের মধ্যে লেখা পড়া ও অঙ্ক শেখার প্রচলন বেড়ে যায় বৃত্তিমূলক কাজে অংশ নেয়ার জন্য। ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে তাঁরা বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করতে থাকেন, পাঠশালা শিক্ষার যাত্রা এভাবেই শুরু হয়েছিল। বাংলা ভাষায় বৃত্তিমূলক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল মধ্যযুগের শেষ দিকে গড়ে ওঠা পাঠশালাগুলিতে। বঙ্গদেশে মাতৃভাষায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার প্রতিষ্ঠানগুলিই কালক্রমে ‘পাঠশালা’ বলে পরিচিত হতে থাকে।
বাংলার পাঠশালা
সুলতানী আমলে গড়ে ওঠে বাংলা শিক্ষার প্রথাবদ্ধ ধারা হচ্ছে বাংলার পাঠশালা। সুলতানী আমলে গড়ে উঠলেও সতেরো শতক নাগাদ মুঘল যুগেই বাংলা পাঠশালার পুরো বিকাশ ঘটে। নিশ্চয় সেটা বেদ শিক্ষা নয়। ব্রাহ্মণদের বেদ শিক্ষার বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন এক শিক্ষার পথ বেছে নিয়েছিলেন নিম্নবর্গের লোকজন। জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-উপজাতি ইত্যাদি নানা বিভাজনে সমাজ ছিল তখন বহুধা বিভক্ত। ফলে সমাজে বসবাসকারী লোকসংখ্যার একটা বৃহৎ অংশই জনসংখ্যার মূল স্রোতের বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। মূলস্রোতের বাইরে যাঁরা ছিলেন, নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই তাঁরা সমাজ বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে নতুন পন্থা উদ্ভাবনে বাধ্য হলেন। শিক্ষা বঞ্চিত সেই মানুষগুলো নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় এক শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড় করালেন, সমাজে তাঁরাই হলেন সেই ব্যবস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই সেটা ঘটেছিল। সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই হলো পাঠশালা। বাংলার ‘পাঠশালা’ হলো সমাজের প্রয়োজনে সমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজ নিয়ন্ত্রিত একটি প্রথাবদ্ধ ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহায়তায় নির্দিষ্ট পাঠক্রমের ভিত্তিতে এবং একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠলো এই ‘পাঠশালা’। কী চিন্তা নিয়ে এইসব পাঠশালার জন্ম হয়েছিল? শিক্ষার্থীরা যেন বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে সহজেই পরবর্তীকালে বৃহত্তর সমাজের মুখোমুখি হতে পারে। শিশুদের পরবর্তীকালের কর্মজীবন ও সমাজজীবনে প্রবেশের পথ স্বাভাবিক করতে পাঠশালার ভূমিকা ছিল ব্যাপক। পাঠশালা শিশুদের বাস্তবসম্মত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। সতেরো-আঠারো শতকের বাংলা সাহিত্য ও বিদেশী পর্যটকদের বিবরণে পাঠশালার উল্লেখ ও বর্ণনার ছড়াছড়ি।
সরকারী দলিলপত্রে কিন্তু পাঠশালার কথা জানা যাবে না। সরকারী দলিলে পাঠশালার কথা নেই বলে যে পাঠশালা ছিল না তা নয়। সরকার দলিলে স্থান পায় রাজ্যের বড় বড় ব্যাপার, বিশেষ করে যেখানে সরকারের রাজস্ব-আয় ব্যয় বা প্রশাসন জড়িত। পাঠশালা সরকারী এইসব বিষয়ের সাথে সামান্যভাবেও জড়িত ছিল না। সরকারের নজরদারী বা প্রশাসনিক আওতার বাইরে পাঠশালা গড়ে উঠেছিল। সরকার পাঠশালাকে অর্থ সাহায্য দিলে বা জমিজমা দান করলে সরকারী নথিতে তার উল্লেখ থাকতো। মধ্যযুগ বর্তমানকালের মতো নয় যে, নিম্নবর্গের কর্মের ইতিহাস সরকারী নথিতে স্থান পাবে। সরকারীভাবে বিশেষ বিশেষ বিষয়গুলিই দলিলে স্থান দেওয়া হতো। মুঘল শাসকদের নথিপত্র ঘেঁটে কিংবা ঢাকা-মুর্শিদাবাদের দলিলে দৃষ্টি বুলিয়ে ইংরেজদের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যাবে না। কারণ মুঘলদের চোখে ইংরেজরা তখন সামান্য বণিকমাত্র। কিন্তু ইংরেজদের দলিলপত্রে শাসকদের সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যাবে। ফলে সতেরো শতকের বাংলায় পাঠশালার উদ্ভব কোনো গল্প নয়। পর্যটকরা সর্বদা যেহেতু সাধারণ মানুষ সম্পর্কে আগ্রহী থাকেন, ফলে তাঁদের রচনায় পাঠশালার কথা পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিদেশী বণিকদের সাথে স্থানীয়ভাবে সর্বসাধারণের যে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল, পাঠশালা শিক্ষার সেটাই হলো প্রেক্ষাপট। স্থানীয় পর্যায়ে জমিজমার হিসেব বা বাংলার রায়তদের সাথে জমিদার-ইজারাদারদের চুক্তির বিষয়গুলি যে স্থানীয়ভাষায় সম্পাদিত হতো সেটাই ছিল স্বাভাবিক। পাঠশালা গড়ে ওঠার বাস্তবতা ছিল সেখানেই।
ইতিপূর্বে দেখা গেছে, শিক্ষা-সংক্রান্ত পুস্তক রচনা বা লেখা ও পড়ার ব্যাপারটা বৈদিক যুগে এবং পরবর্তী হিন্দু শাসনে কমই ছিল। স্মৃতিতেই বেদের সকল স্তোত্র বা সংহিতা ধরে রাখা হতো। জ্ঞান শুধুমাত্র লিপি-পরিচয় দ্বারা হওয়া সম্ভব ব্রাহ্মণরা তা বিবেচনা করতেন না। নিম্নশ্রেণীর লোকদের যদিও বেদ পাঠের অধিকার ছিল না কিন্তু তাঁদেরও স্মৃতিশক্তি কম ছিল না। মুখে মুখে তাঁরা বড় বড় গণিতের সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। মধ্যযুগের বাংলায় গণিত শেখার কিছু বাঁধা নিয়ম ছিল যার সাহায্যে তাঁরা এধরনের দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। করণিক বা কায়স্থরা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এই ধরনের বহু অঙ্কের নিয়ম আবিষ্কার করেন। ছড়ার আকারে গণিতগুলি রচিত হয়েছিল। সেগুলির কিছু মুখে মুখে প্রচারিত ছিল, কিছু কিছু তাঁরা লিপিবদ্ধ করে রেখে যান। গণিতের নানা সূত্র তখন নিরক্ষর নিম্নশ্রেণীর লোকের মুখে মুখে শোনা যেতো, কাগজ-কলম ছাড়াই তাঁরা অঙ্ক করতে পারতেন। বাজার দরের সুক্ষ্মতম হিসাব মুখে মুখেই বলে দিতেন। চাষারা কাগজে-কলমে অভ্যস্ত ছিলেন না, নিতান্ত জটিল অঙ্ক হলে তাঁদের মধ্যেই অক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন দু-একজন কাগজ-কলম নিয়ে বসতেন। খুব জটিল অঙ্ক না হলে কেউই কাগজ-কলম নিতেন না। যাঁরা তখন লিখতে পড়তে জানতেন চাষা সমাজে তাঁদের প্রভুত সম্মান ছিল। কবিতার ছন্দে রচিত সেই অঙ্কগুলিকে আর্য্যাও বলা হতো। শত শত এরকম আর্য্যা পাড়াগাঁয়ের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের জানা ছিল। বিশেষ করে শুভঙ্করের আর্য্যা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। পরবর্তীকালে সেগুলিই পাঠশালা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। কিংবা সেগুলিই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাদানের জন্য পাঠশালার প্রতিষ্ঠা হয়। পাঠশালার গুরু মহাশয় সেই সাথে আরো কিছু পাঠ্য যোগ করেন।
বাংলায় অধ্যয়ন বলতে পড়াশোনা শব্দবন্ধের ব্যবহার কিন্তু বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলার টোলের শিক্ষা প্রক্রিয়াকে ‘পড়াশোনা’ বললেও বাংলা পাঠশালার শিক্ষাপ্রক্রিয়া থেকেই ‘লেখাপড়া’ শব্দবন্ধের উদ্ভব। বাংলার টোল ছিল সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মক্তব ছিল প্রধানত আরবী ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসায় আরবী এবং ফারসী দুটো ভাষারই প্রাধান্য ছিল। বাংলার পাঠশালায় লেখা, পড়া এবং অঙ্ক শেখানো হতো বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষার ‘পাঠশালা’ শিক্ষা ব্যবস্থা কবে থেকে চালু হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয় কৃষি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কৃষি জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা, লিখিত নথির প্রচলন, হিসাবের নানা জটিলতা লেখা আর অঙ্ক শেখার প্রয়োজনকে বাড়িয়ে তুলেছিল। আর এই প্রয়োজনের তাগিদেই তৈরি হয়েছিল পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলার ব্যবসায়ী, কারিগর ও কৃষিজীবীরা মিলে নিজেদের প্রয়োজনে নিজ উদ্যোগে এই পাঠশালা শিক্ষার ভিত গড়ে তোলেন। কৃষক ও কারিগরদের সে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল পার্থিব বিষয়কে কেন্দ্র করে। গ্রামের জনসাধারণরা যুক্তি-তর্ক, ন্যায়শাস্ত্র বাদ দিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে সেই শিক্ষাধারার সাথে যুক্ত হন। কারণ সময়ের প্রয়োজনে উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঘিরেই সে শিক্ষাধারার জন্ম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষা তখন শাসক বা স্থানীয় ভূস্বামীর সহযোগিতা পেলেও বাংলার পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা ভূস্বামী শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি। নিষ্কর জমি সরকার থেকে দান করা হতো মাদ্রাসা ও টোলের জন্য, বাংলা প্রাথমিক শিক্ষা বা পাঠশালার জন্য নয়। পাঠশালা শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। মুসলিম শাসকরা পাঠশালা শিক্ষার জন্য কোনো নিষ্করভূমি বরাদ্দ না করলেও নিম্নবর্গের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
বাংলার ‘পাঠশালা’ ছিলো একটি বিশেষ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাক্রমের ভিতর অন্তর্ভুক্ত ছিল পড়া লেখা, গণিত, পত্রলিখন, সংস্কৃত, ব্যাকরণ, এবং জমিদারী ও মহাজনী হিসাবরক্ষণ। জমিদারী বা কৃষি-সংক্রান্ত হিসাব-রক্ষণে শেখানো হতো জমির মাপজোক ও রাজস্বের হিসাব। মহাজনী বা বাণিজ্যিক হিসাব-রক্ষণে পড়ানো হতো সুদকষা এবং কী করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায়। সতেরো শতকে পাঠশালায় সাধারণত মুদ্রিত গ্রন্থ ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। হস্তলিখিত গ্রন্থও খুব কম ব্যবহার করা হতো। শিক্ষক মুখেমুখেই ছাত্রদের পাঠদান করতেন এবং ছাত্ররা গুরু প্রদত্ত তথ্যাদি মুখস্থ করতো। নির্ধারিত কোনো পাঠক্রম ছিল না, গুরু যে বিষয়ে ভালো জানতেন সে বিষয়ের উপরই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো। পাঠশালার শিক্ষা কার্যক্রমে অঙ্কশাস্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে কড়ির হিসাব, একশো পর্যন্ত গণনা, ভূমির পরিমাপ, ওজন মাপার হিসাব, শুভঙ্কর-এর গণনা, যোগ ও বিয়োগ পদ্ধতি এবং বিশ পর্যন্ত গুণনের নামতা শেখানো হতো গুণ ও ভাগের জন্য। এসব বিষয়ে শিক্ষালাভের পর জমিদারী ও মহাজনী হিসাব শেখানো হতো। কিন্তু ছাত্ররা নিরক্ষর ছিল না। তাদেরকে লিখতে পড়তে জানতে হতো। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, পাঠশালার গুরু মহাশয়েরা হস্তাক্ষর এবং হিসাব শিক্ষাদানেই সমধিক পটু ছিলেন। সে যুগের বাঙালী গৃহস্থের উপযোগী সাধারণ জ্ঞানদানই পাঠশালার কার্য ছিল। তবে যে ছাত্র সাধারণ জ্ঞান লাভের পরে জমিদারের বা মহাজনের কাগজপত্র লিখে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবতো তাদের শুভঙ্করী হিসাবে পটুতা লাভ আবশ্যক বিবেচিত হতো।
সকল পাঠশালার গুরুই জমিদারী এবং মহাজনী হিসাব শিক্ষাদানে সক্ষম ছিলেন না। যিনি যা সুচারুরূপে জানতেন, তাই শেখাতেন। ফলে কোনো কোনো পাঠশালায় কেবল জমিদারী হিসাব আবার অন্য পাঠশালায় কেবল মহাজনী হিসাব শেখানো হতো। সাধারণত কৃষক পরিবারের শিক্ষার্থীরা জমিদারী হিসাব এবং ব্যবসায়ী পরিবারের শিক্ষার্থীরা মহাজনী হিসাব পড়তে আগ্রহী হতো। জমিদারী ও মহাজনী হিসাব উভয়ের প্রতিই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল। কিছু কিছু পাঠশালা ছিল যেখানে গুরু এই দুই পদ্ধতির হিসাবের কোনোটাই পড়াতেন না বা তিনি এসব পড়াতে অক্ষম ছিলেন। বর্ধমান জেলার ছয়শো নয়টি পাঠশালায় জমিদারী বা মহাজনী হিসাব-পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু ঐ জেলায় মোট ছয়শো উনত্রিশটি পাঠশালা ছিল। বাকিগুলিতে শুধু লেখাপড়া এবং সহজ অঙ্ক শেখানো হতো। বাংলার পাঠশালায় গুরু পত্রলিখন পদ্ধতির উপর বেশ গুরুত্ব দিতেন। গুরু ছাত্রদের পত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সম্বোধন, ব্যবসা-সংক্রান্ত পত্রাদি, বিভিন্ন ধরনের আবেদনপত্র, চুক্তি ও বন্ধকী দলিল রচনার পদ্ধতি শেখাতেন। সুতরাং একথা বলা যায় যে, পাঠশালার শিক্ষা কার্যক্রম দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা চিন্তা করেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, পাঠশালা সকল শিশুকে এ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। কিন্তু মাদ্রাসা বা টোলের তুলনায় বাংলার ব্যাপক মানুষকে শিক্ষার সাথে যুক্ত করতে পেরেছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া স্বল্প সময়ে সকলকে এ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভবও ছিল না। চাকরি লাভের প্রশ্নে বলা যায়, ব্যাপক মানুষের পাঠশালায় শিক্ষা নিয়ে চাকরি পাবার সুযোগ তখনো সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাঠশালায় শিক্ষালাভ করতো নিম্নবর্গের মানুষরা আর পাঠশালা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাধারা। বর্ধমান জেলাতেই সে যুগে সাড়ে ছয়শো পাঠশালা ছিল, ব্যাপারটা চিন্তা করা বিস্ময়কর। ইউরোপেও তখন প্রাথমিক পাঠদানের জন্য এত ব্যাপকভাবে বিদ্যালয় ছিল না।
পাঠশালার শিক্ষা কার্যক্রম চারটি স্তরে বিন্যস্ত ছিলো। প্রথম স্তর: শিক্ষার্থীরা আট দশ দিন কাটাতো মাটির উপর কাঠি দিয়ে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের অক্ষরসমূহের উপর হাত ঘুরিয়ে। দ্বিতীয় স্তর: আড়াই থেকে চার বৎসর কাল শিক্ষার্থীরা তালপাতার উপর ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বর চিহ্নসমূহ যুক্ত করা এবং যুক্তাক্ষর লেখা শিখতো। সাথে সাথে তারা সংখ্যা-তালিকা, ওজন-পরিমাপ ও টাকা-পয়সার হিসাব প্রভৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করতো। তৃতীয় স্তর: এই স্তরে শিক্ষার্থীরা প্রায় দুই থেকে তিন বৎসরকাল কলাপাতায় লিখতো এবং সহজ গণিত, ভূমি-পরিমাপ এবং বাণিজ্যিক ও কৃষি-সংক্রান্ত হিসাবের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা লাভ করতো। চতুর্থ স্তরে শিক্ষার্থীরা কাগজে লেখার অনুমতি পেতো। কৃষি ও ব্যবসা-সংক্রান্ত হিসাবের অন্যান্য বিষয়গুলি এই সময়ে তারা শিখতো। একই সাথে তাদের বিভিন্ন ধরনের পত্রলিখন ও সংস্কৃত-ব্যাকরণের কিছুটা শেখানো হতো। পাঁচ বৎসর বয়সে শিক্ষার্থী পাঠশালায় পড়া শুরু করতো এবং প্রায় ছয় থেকে নয় বৎসরকাল শিক্ষার্জন করতো। শিক্ষার্থীর মেধার উপর ব্যাপারটা নির্ভরশীল ছিল। পাঠশালায় একজন শিক্ষক থাকার কারণে গুরুকে একাই বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হতো। বিভিন্ন স্তরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীকক্ষ ছিল না। সবাই এক সাথেই গুরুর সামনে বসতো, হয়তো একই গাছতলায় না হয় একই ঘরে। পাঠশালা শিক্ষার মধ্য দিয়ে একটি শিশু সাধারণত সাক্ষরতাই লাভ করতো। ধর্মশিক্ষা লাভের জন্য কেউ পাঠশালায় যেতো না। শিক্ষার্থী মাতৃভাষায় পড়া লেখা আর সহজ অঙ্ক করার কাজটি দক্ষতার সঙ্গেই শিখে নিতো।
বাংলার পাঠশালায় শিক্ষাদানের একটি অভিনব প্রথা ছিলো ‘সর্দার পোড়ো’। গুরু তাঁর শিক্ষাদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য উপরের স্তরের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে তাঁকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন সর্দার নিয়োগ করতেন। প্রাথমিক স্তরের ছাত্রদের শিক্ষাদান এবং শৃঙ্খলা বিধানে এরা গুরুকে সাহায্য করতো। পাঠশালার ছাত্রদের যোগ্যতা অনুসারে দুটি ভাগ করা হতো। বড় বা উচ্চশ্রেণীর এবং প্রাথমিক স্তরের। বড়দের বা উঁচুশ্রেণীর পড়ানোর কাজ গুরুমশায় নিজে করতেন। কিন্তু উঁচুশ্রেণীর ছাত্রদের মধ্য থেকে বাছাই করা সর্দারদের নিচের শ্রেণীর ছোটো ছোটো ছেলেদের পড়ানোর ভার দেওয়া হতো। এতে বড়দের পড়াটা ভালোভাবে আয়ত্ত হতো, গুরুমশয়া কিছুটা বেশি সময় পেতেন বড়দের দিকে নজর দেবার। বড়রা ছোটোদের কিছুটা শিক্ষাদানের দায়িত্ব লাভ করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পেতো। শিক্ষক হিসেবেও তাদের হাতেখড়ি হতো। একে ‘সর্দার পোড়ো প্রথা’ বলা হতো। বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অনেকখানি এদের হাতে থাকতো। গুরু প্রতিটি ছাত্রকে এবং তার পরিবারকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন এবং তাদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে দৃষ্টি রাখতেন। ফলে ছাত্রদের কেউ পাঠশালায় না এলে গুরু জানতে পারতেন। অনুপস্থিত ছাত্রদের খুঁজে বের করতে ‘সর্দার পোড়ো’ নামক ছাত্রদের দায়িত্ব দেওয়া হতো। মাদ্রাজে থাকা এক মিশনারী চিকিৎসক বেল এই ‘সর্দার পেড়ো’ প্রথার উপযোগিতায় মুগ্ধ হন এবং নিজের দেশ বিলেতে গিয়ে এই প্রথাটির প্রর্বতন করেন। পরবর্তীতে চিকিৎসক বেল-এর পদ্ধতিটি সেদেশে ‘বেল পদ্ধতি’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু মূলত এটি ছিল পাঠশালার শিক্ষা পদ্ধতি।
পাঠশালা শিক্ষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল মিলিত কণ্ঠে বা সমস্বরে পাঠগ্রহণ। প্রথমে গুরু কোনো শ্লোক বা নামতা ইত্যাদি বলতেন, সকল শিক্ষার্থীকে মিলিত কণ্ঠে তা আবার বলতে হতো। বারবার এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীগণ পাঠ মুখস্থ করতো। পাঠশালায় ভর্তির কোনো নির্ধারিত সময়সূচি থাকতো না। বৎসরের যে-কোনো সময় ছাত্র পাঠশালায় যোগদান করতে পারতো। কোনো বাৎসরিক পরীক্ষার প্রচলন ছিল না। গুরু যখন মনে করতেন যে ছাত্র এক স্তরের শিক্ষা লাভ করেছে তখন তিনি সেই ছাত্রকে উপরের স্তরে উন্নীত করতেন। কাগজে-কলমে ছাত্রের উপস্থিতি সংরক্ষণ করার বালাই ছিল না। পাঠশালাগুলিতে কোনোরকম আসবাব, পঠনপাঠনের উপকরণ বা পাঠশালা ছাত্রদের বসার জন্য কোনো আয়োজন করতো না। বসার জন্য ছাত্র নিজেই নিয়ে আসতো মাদুর বা ছালা, মাঝখানে গুরু বসতেন একটু উঁচু টুলের উপর, ছাত্ররা বসতো তাঁকে ঘিরে চারদিকে। পাঠশালার কোনো নির্দিষ্ট বর্ষসূচীও ছিল না। ফলে, সুবিধামতো পাঠশালা বন্ধ বা খোলা রাখা যেতো। ফসল কাটার সময়, কিংবা বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পাঠশালা বন্ধ রাখা হতো। পাঠশালা দিনে দুবেলা বসতো, ভোর থেকে দশটা পর্যন্ত আবার বেলা তিনটা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রেখেই এরূপ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সকাল দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বিরতির সময় ছাত্ররা নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে স্নানাহার সম্পন্ন করতে পারতো এবং বাড়ির কিছু কাজও করতে পারতো। যেমন কৃষিকাজে ব্যস্ত বাবার খাবার পৌঁছে দেওয়া, গরু-হাঁস-মুরগির পরিচর্যা করা ইত্যাদি।
বাংলার পাঠশালায় যে নানা বৃত্তির বা পেশার শিক্ষা হতো তার ভুরি ভুরি নজির মেলে। এমনকি ঘর তৈরি, পুকুর কাটা, বা কুয়ো তৈরির মাজজোকও শেখানো হতো পাঠশালায়। আসলে ব্যবহারিক শিক্ষার উপর জোরই ছিল বাংলা পাঠশালার জীবনকাঠি। পাঠশালায় যারা পড়তো তারা ছিল মূলত কৃষিজীবী, কারিগর, দোকানদার বা জমিদারী সেরেস্তার কর্মচারীদের সন্তান। কৃষি, কুটিরশিল্প, কারিগরি আর ব্যবসাই ছিল তখন সাধারণ মানুষের প্রধান জীবিকা। বাংলা ভাষায় শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে সরকারী উচ্চপদে চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনে বা জমিদারীর কাজের সহায়ক হিসেবে চাকরি লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতো। পাঠশালার শিক্ষা শেষে অনেকেই দেখা গেছে একই সঙ্গে জমিদারী সেরেস্তায় বা মহাজনের খাতা লেখার কাজ করতো। তখনকার দিনে বাংলার স্থানীয় রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় হিসেবপত্র বাংলাতেই রাখা হতো। যাঁরা এসব নথিপত্র লিখতেন তাঁদের সাধারণত বলা হতো মুন্সি। বাংলা ভাষায় সাক্ষর লোকদের পক্ষেই বাংলায় এসব নথিপত্র লেখা সম্ভবপর ছিল। পাঠশালা শিক্ষা এইসব জীবিকার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হতে পেরেছিল। সাধারণ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত এক সাধারণ শিক্ষাধারা হিসেবেই পাঠশালার আবির্ভাব।
বাংলা পাঠশালা ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। পাঠশালা শিক্ষা আধুনিক অর্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষা না হলেও তা যে পুরোপুরি ব্যবহারিক শিক্ষা ছিল সেবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জমিদারী বা কৃষি-সংক্রান্ত হিসাব-রক্ষণে শেখানো হতো জমির মাপজোক ও রাজস্বের হিসাব। মহাজনী বা বাণিজ্যিক হিসাব-রক্ষণে পড়ানো হতো সুদকষা এবং কী করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায়। পত্রলিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে পত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সম্বোধন, ব্যবসা-সংক্রান্ত পত্রাদি, বিভিন্ন ধরনের আবেদনপত্র, চুক্তি প্রভৃতির রচনা পদ্ধতি শেখানো হতো। পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞানের কোনো স্থান ছিল না। পাঠশালা গড়ে উঠেছিল সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে এবং একটি গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। শিশুকে জীবন গড়ে তোলার ধর্মনিরপেক্ষ প্রাথমিক শিক্ষাটা দেয়া হতো। সমাজের সব শ্রেণী থেকেই এখানে ছাত্র আসতো এবং তা এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তার কথাই প্রমাণ করে। এমনকি কোনো ধনী পরিবারের অর্থানুকূল্যে পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হলেও তার দ্বার এলাকায় সব বালকের জন্যই খোলা থাকতো। বাস্তবক্ষেত্রে অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেকে বিনা বেতনে পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হতো এবং সাংবাদিক এ্যাডাম এই বিষয়টির খুব প্রশংসা করেছেন। ছাত্ররা বেতন দিতে পারতেন নানাভাবে, নগদমূল্যে অবার শষ্য বা গাছের ফল বা সবজি দিয়ে, গুরুর দরকার বুঝে।
ব্রিটিশদের মাধ্যমেও মধ্যযুগের পাঠশালা শিক্ষা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। আঠারো শতকে এডওয়ার্ড ইভস্ লণ্ডন থেকে ভারতে আসেন। ইভসের বিবরণে জানা যায় সতেরশো সাতান্ন-আটান্ন খ্রিস্টাব্দে বাংলায় লেখাপড়া শেখার অনেক বিদ্যালয় ছিল। ইভস্ লিখেছেন, ‘যদিও শিশুদের লেখাপড়া শেখার অনেক বিদ্যালয় ছিল তবে তাতে মাতৃভাষার বেশি আর কিছু শেখানো হতো না।’ সতেরশো একানব্বই সালে ক্রফোর্ড জানাচ্ছেন, ‘সব শহরে এবং প্রধান প্রধান গ্রামগুলিতে লেখাপড়া শেখার বিদ্যালয় ছিল।’ তিনি জানাচ্ছেন যে, খুঁটির উপর তালপাতার ছাউনি দিয়ে বিদ্যালয়-ঘর তৈরি হতো। বালকেরা মাটিতে চাটাইয়ের আসনে বসতো। তালপাতার পুঁথি ব্যবহার হতো। বাঁ হাতে পুঁথি ধরে ডান হাতে লোহার শলা দিয়ে চেপে লেখা হতো। কিন্তু প্রায়ই তারা বালিতে আঙুল দিয়ে লিখতো ও অঙ্ক কষতো। কখনো কখনো নুড়ি বা কড়ি দিয়ে গোনা অভ্যাস করতো। উল্লেখ করা দরকার যে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার দু-একটি নজির পাওয়া গেলেও সাধারণভাবে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রথা ছিল না বলেই মনে হয়। সতেরো শতকে যে বাংলায় বর্ণশিক্ষা বা সাক্ষরতার হার বাড়ছিল এই সব তথ্য থেকে তা যথেষ্ট অনুমান করা যায়। কিন্তু সেই হার সেদিনের বিবেচনায় যথেষ্ট হলেও বর্তমানে হয়তো যথেষ্ট বলা যাবে না। বাংলা ভাষায় শিক্ষা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকরা ছাড়াই তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশের গ্রামগুলিতে। সে বিচারে এই ব্যাপকতাকে খাটো করে দেখলে ভুল হবে। বিচার করতে হবে সেদিনের প্রেক্ষিতে; যখন জনগণের টাকায়, জনগণের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল এই পাঠশালা। বাংলার সাধারণ মানুষের প্রয়োজনেই তা বিস্তার লাভ করেছিল। সহজ অঙ্ক এবং বর্ণশিক্ষা লাভের এই ধারা অকারণে হয়নি। বাংলার তৎকালীন সমাজ-অর্থনীতির প্রয়োজনেই তা সাড়া ফেলেছিল।
উইলিয়াম ওয়ার্ড আঠারশো তিন সালে লিখেছেন যে, বাংলার প্রায় সব বড় গ্রামেই সাধারণ বিদ্যালয় ছিল। খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে অথবা ছায়াযুক্ত গাছের তলায় এইসব পাঠশালা বসতো এবং দরিদ্র জনগণের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজন এই পাঠশালা বহুকাল ধরে মিটিয়ে আসছিল। তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, গ্রামের এই বিদ্যালয়গুলিতে পার্থিব শিক্ষা দেওয়া হতো। পাঠশালার শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অক্ষর পরিচিতির পর যুক্তাক্ষর লিখতে হতো। তারপর মানুষের নাম, গ্রামের নাম, পশুপাখীর নাম লিখতে হতো। পরে অঙ্ক লেখা শুরু হতো। পাতায় লেখা শুরু হলে পড়ুয়ারা দিনে দুবার সর্দার পড়োর সঙ্গে কড়া, গণ্ডা, বুড়ি, পণ ও কাহনের নামতা মুখস্থ বলতো। তারপর এক থেকে একশ পর্যন্ত সংখ্যা ও নামতা মুখস্থ করতো। শেষে কলাপাতায় যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং ওজনের নিয়ম ইত্যাদি শিখতে হতো। বড় ছেলেরা সাধারণ চিঠিপত্র ও দলিল বা চুক্তিপত্র লিখতে শিখতো।’ উনিশ শতকের প্রথম দশকেই বুকানন হ্যামিলটন জানাচ্ছেন যে, হিন্দু ও মুসলমান ছেলেদের প্রাথমিক শিক্ষা হতো পাঠশালায় কোনো গুরুমশাইয়ের কাছে। আর এই গুরুমশাইরা যে-কোনো বর্ণের ও ধর্মের হতো। এইসব পাঠশালায় শিক্ষকের জন্য কোনো সরকারী অনুদান বা সাহায্যের ব্যবস্থা ছিল না। জীবনধারণের জন্য এঁদের সম্পূর্ণভাবে পড়ুয়াদের উপর নির্ভর করতে হতো। তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, পাঁচ বছর বয়সেই শিশুরা পাঠশালায় যেতো। এরা একই সঙ্গে লিখতে ও পড়তে শিখতো। এই পদ্ধতি ছিল দারুণ।
বিভিন্ন আলোচনায় একথা স্পষ্ট যে, সতেরো-আঠারো শতকে বাংলা পাঠশালা শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল আর বেশ গতিশীল হয়ে উঠেছিল। মনে রাখতে হবে সতেরো-আঠারো শতকেই উল্লেখযোগ্য মুসলমান কবিদের বাংলা কাব্যগুলি রচিত হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে বাংলা লেখাপড়ার প্রচলন না থাকলে এমনটি সম্ভব হতো না। এই সময় বাংলা পাঠশালা যথেষ্ট বিকাশলাভ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। মাত্র সতেরো শতকেই তা পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করে যদিও আরো বহু আগে থেকেই এই ধারার জন্ম। শিক্ষা গবেষক পরমেশ আচার্য লিখছেন, ‘এ পর্যন্ত যেসব উপাদান ও সাক্ষ্য আমরা দেখেছি তাতে বোঝা যায় বাংলা পাঠশালা শিক্ষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল মুসলমান অধিকারের পরেই।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘সন্দেহ নেই মুসলমানরা অধিকারের পরই বাংলা পাঠশালা শিক্ষা একটা প্রথাবদ্ধ রূপ নেয়। একই সময় বাংলায় মখতব শিক্ষাও প্রসার লাভ করতে থাকে। এই সময়ই বলতে গেলে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট রূপ পেতে থাকে। এক কথায় বাঙালি তার নিজের পরিচয় খুঁজে পায়। বাঙালির এই পরিচয় গড়ে ওঠে প্রধানত বাংলার হিন্দু-মুসলমান নিচুশ্রেণির প্রাণের সুরে।’ ছাত্ররা অন্যায় করলে বা পড়াশুনায় ফাকি দিলে বাঁশের কঞ্চি দ্বারা প্রহার করা হতো। কঠিন শস্তির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গুরু এবং তাঁর ছাত্রদের মধ্যে গভীর বন্ধন বিরাজ করতো। পিতাপুত্রের মতো ছিলো এই বন্ধন।
বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রথম দিকেও পাঠশালা শিক্ষাই ছিল বাংলা ভাষায় সাক্ষরতা লাভের ভিত্তি। বঙ্গদেশে তখন পাঠশালার অভাব ছিল না। মধ্যযুগের পাঠশালা শিক্ষার গতিশীলতার ছবিটা স্পষ্ট বোঝা যায় কয়েকজন ইংরেজ ব্যক্তির প্রতিবেদন থেকে। পাঠশালা শিক্ষার সঙ্গে টোল বা চতুষ্পাঠীয় সংস্কৃত উচ্চশিক্ষার কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাঠশালা ছিল পুরোপুরি আলাদা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শিক্ষাধারা। সব বর্ণের ও ধর্মের শিশুরাই পাঠশালায় পড়তে আসতো। পাঠশালা শিক্ষায় কোনো সম্প্রদায় বিভাজন ছিল না। বর্ধমানের ছয়শো উনত্রিশটি পাঠশালার মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল তেরো হাজারের কিছু বেশি। প্রতি পাঠশালায় গড়ে একুশ জন লেখাপড়া করতো। এদের মধ্যে তিনহাজার চারশো উনত্রিশ জন ছিল ব্রাহ্মণ, একহাজার আটশো ছিচল্লিশ জন কায়স্থ, একহাজার দুশো চুয়ান্ন জন সদ্গোপ। বাকিদের সাতশো ষাট জন একেবারে নীচের স্তরের বিভিন্ন বর্ণের মানুষ। একশো আট জন বৈদ্য, একশো একষট্টি জন ক্ষত্রিয়, সাতশো উনসত্তর জন মুসলমান আর তেরো জন খ্রিস্টান ছাড়া বাদবাকিরা এসেছিল মাঝের বর্ণ থেকে। বীরভূমের পড়ুয়াদের ছবিও প্রায় একই রকম। উইলিয়াম এ্যাডাম জানাচ্ছেন, একেবারে নীচের বর্ণের শিশুরা ক্রমেই বেশি বেশি করে পাঠশালায় পড়তে আসছিল। তিনি এ বিষয়ে একটা গতিশীলতা লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর মতে পাঠশালা ছিল মধ্যবিত্ত ও গরিবদের শিক্ষার জায়গা। খেয়াল করলে দেখা যাবে বর্ধমানের মোট তেরো হাজার পাঠশালা পড়ুয়ার অর্ধেকই নিচুবর্ণ থেকে এসেছিল। মাতৃভাষা বাংলাই ছিল শিক্ষার বাহন এবং একমাত্র শিক্ষণীয় ভাষা। ফলে খেটে খাওয়া আপামর জনগণের মধ্যে পাঠশালা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল।
পাঠশালা শিক্ষা যেভাবে অগাচ্ছিল আর যেভাবে প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বা সরকারি বাধা না পেলে দ্রুতই বাংলার সাক্ষরতার হার আকাশচুম্বি হতো। বড় বড় বুদ্ধিজীবী নয়, মাতৃভাষায় বাংলার প্রতিটি ছেলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতো। মেয়েরাও ধীরে ধীরে পরবর্তীতে তার সংস্পর্শে চলে আসতো। বর্তমানে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে সাক্ষরতা দান বা সরকারিভাবে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলা হয়, তা হলো সম্পূর্ণভাবেই পাঠশালা শিক্ষার অনুকরণ। কিন্তু বাংলার পাঠশালা শিক্ষাকে ধ্বংস করা হলো। ইংরেজদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাধারা ব্যহত হয়। ইংরেজ শাসক আর বাংলার ভদ্রলোকরা মিলে এই ব্যবস্থার বিপরীতে ইংরেজ শাসকরা ধনীকশ্রেণীর স্বার্থে নতুন শিক্ষা প্রবর্তন করতে গিয়ে দরিদ্র মানুষদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজদের এই শিক্ষানীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ইংরেজদের নতুন শিক্ষানীতি উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, যার ভিতর দিয়ে গ্রামের পাঠশালাগুলি ধ্বংস হতে থাকে। নতুন শিক্ষানীতির ভিতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামের নিম্নবর্গের সন্তানরা যে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়তে থাকে। সাক্ষরতার হার কমতে থাকে। বিপরীতে কিছু ভদ্রলোক সুবিধাভোগীর সন্তানরা ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে দরিদ্র মানুষের উপর ছড়ি ঘুরাতে আরম্ভ করে। ইংরেজদের আধুনিক শিক্ষার চরিত্রটি হয়ে দাঁড়ায়, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করা। কিছু মানুষ শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের দাসত্ব আরম্ভ করে আর নিজ দেশের সাধারণ মানুষের উপর দমনপীড়ন চালায়। পাঠশালা শিক্ষা গড়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, জনবিচ্ছিন্নভাবে নয়। ধারাবাহিকভাবে পাঠশালা শিক্ষা থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মাধ্যমিক শিক্ষা আর উচ্চশিক্ষা আরম্ভ হতো, কিন্তু ইংরেজদের হস্তক্ষেপ এবং চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতি সেখানে ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি করলো। যারা মনে করেন, ইংরেজরা এদেশে আধুুনিক শিক্ষাধারা চালু করেছে, তারা ভুলে যান সেটা আসলে আধুনিকতার নামে কতিপয় মানুষকে ইংরেজ শাসকদের দাস হিসেবে সৃষ্টি করবার মানসেই করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসকরা তা সরাসরি স্বীকারই করেছেন কিন্তু শাসকদের দোসর এবং অনুগামী বাংলার ভদ্রলোকরা মনে করেছেন সেটাকে আধুনিক শিক্ষা। বাংলার আধুনিক শিক্ষার মহান কারিগর হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয়, বিদ্যাসাগর এই শিক্ষানীতির পক্ষে ছিলেন। ইংরেজদের নতুন শিক্ষানীতির তিনি যেমন সমর্থক ছিলেন, ঠিক তেমনি বড় পদ অধিকার করেছিলেন অনেকদিন। তিনি পাশ্চাত্যের নতুন জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্বারা চমকিত ছিলেন কিন্তু এটা ধরতে পারেননি, সাম্রাজ্যবাদ নিজ দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার চাইলেও, ভারতে চেয়েছে কিছু করণিক সৃষ্টি করতে। তিনি হয়তো ধারণাই করতে পারেননি ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ পরিণাম কী দাঁড়াতে পারে।
বিদ্যাসাগর যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতেই পারেননি। সারাজীবন কলম চালিয়েছেন সে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। করমচাঁদ গান্ধীও এ শিক্ষানীতিকে বলেছেন, বুদ্ধির লাম্পট্য।