বাংলার ভদ্রলোক ও ‘পাঠশালা’ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাত্রা
শেষপর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২০
ফরাসি বিপ্লবের পর পাশ্চাত্যের শিক্ষাধারায় যার প্রভাব যথেষ্ট সেই রুশো বলেছিলেন, শিশুকে পরিণত বয়স্ক মানুষ হিসেবে দেখার আগে তাকে ‘শিশু’ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। শিশুকে তার নিজস্ব ক্ষমতা পূরণ করার সুযোগ দেওয়া দরকার। তিনি মনে করতেন, শিশুর মনকে অকালে উপযুক্ত সময়ের আগেই বয়স্কজনোচিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি এই ধরনের কৃত্রিম শিক্ষাপ্রণালীর বিরোধিতা করেছিলেন। কৃত্রিম শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর সামনে পরিণত মানুষের ধ্যান ধারণাগুলিকে উপস্থিত করা হয় এবং জোর করে শিশুমনে পরিণত বয়স্ক মানুষের ধ্যানধারণা এবং চিন্তাধারা বা ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। শিশুকে বাধ্য করা হয় সেগুলি গ্রহণ করতে। এই ধরনের সদর্থক কৃত্রিম শিক্ষাকে রুশো অগ্রাহ্য করেছিলেন। রুশোর মতে, শিক্ষা বলতে বোঝায় শিশুমনকে বিমূর্ত এবং আগে থেকেই তৈরি করা ‘সত্য’ দিয়ে পূর্ণ করা নয়। যদি জোর করে শিশুর উপর কিছু ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা হবে শিশুর সহজাত স্বাভাবিক প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে কৃত্রিমভাবে তার মস্তিষ্কের ভিতর ঠেসে দেওয়া বা পুননির্মাণ করা। শিশুকে কৃত্রিম ছাঁচে ঢালাই করার প্রচেষ্টার ফল খারাপই হবে। শিশু স্বভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। বাংলার প্রাথমিক শিক্ষায় কিন্তু ছোটো ছোটো শিশুদের মগজে ইতিহাস ও ধর্ম সম্পর্কে নানা মনগড়া চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো, যা পরবর্তীতে বাংলায় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার সূত্রপাত ঘটায়। শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। বাবুশ্রেণীর বয়স্ক মানুষরা শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁদের বিশ্বাসগুলিকেই গলাধঃকরণ করিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথরা শিশুকে দেখেছিলেন ক্ষুদ্রাকৃতির পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে। তার কাছ থেকে আশা করা হতো যেন সে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো তার মগজটাকে জ্ঞানে ঠাসা করে রাখবে; পূর্ণবয়স্কর মতো কথা বলবে এবং কাজ করবে। শিশুর যেন কোনো শিশুকাল থাকবে না। রুশো বলেন, শিশুকে সেগুলিই শেখানোর চেষ্টা করা উচিৎ যেগুলি সে সহজে শিখতে পারবে। শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির চরম স্বাভাবিক বিকাশের দিকে পৌঁছানোর সাধনা। কিন্তু তারতো স্তরভেদ আছে। শিশুতো একদিনেই সব শিখে ফেলতে পারবে না। পাশ্চাত্যে বহুকাল পাঠের অর্থ না বুঝেই শিশুকে বহুকিছু শিখতে হতো, শব্দগুলির অর্থ না বুঝেই মুখস্থ করতে হতো। রুশো শিশুর প্রতি এই ধরনের শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, বিমূর্ত বস্তু শিশুর চিন্তার বিপরীত। পরিণত মানুষ হবার আগে শিশুকে শিশু হিসেবেই দেখতে হবে, এই স্তরে শিক্ষা অবশ্যই হবে শিশুর ক্ষমতা অনুযায়ী। শিশু যেন শিক্ষণীয় বিষয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সেভাবেই শিক্ষা দিতে হবে। রুশো মনে করতেন, শিশুদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের কোনো গুরুত্ব নেই। সবরকম মূলবান জ্ঞানই শিক্ষার্থী আয়ত্ব করতে পারে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। রুশো হাতে কলমে কাজকে এই পর্বের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ বলে মনে করতেন।
রুশো যে চিন্তাভাবনা আঠারো শতকের শেষে করেছিলেন, বাংলার ‘পাঠশালা’ সতেরো শতকের আগেই সেই প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসক এবং বাংলার অভিজাতরা সেই ধারণার বিরুদ্ধেই প্রাথমিক শিক্ষাকে পরিচালিত করেছিলেন। শাসকরা সনাতন পাঠশালার চরিত্র না বুঝে তার ইতিবাচক দিকগুলিকে না দেখেই, সেগুলি মানসম্পন্ন নয় বলে ঘোষণা দেন। ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোক, নব্য জমিদার এবং শহুরে সম্ভ্রান্তরা এ ব্যাপারে ইংরেজ শাসকদের মন্তব্যকে সঠিক মনে করেছিলেন। সত্যি বলতে ইংরেজ শাসকদের পাঠশালা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যে ঈশরচন্দ্রের বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা কী রকম হওয়া দরকার এবং সরকারের কী করণীয়, এ ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্র যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন তাতে তিনি ‘পাঠশালা’ শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। পাঠশালা শিক্ষকদের সম্পর্কে বিদ্যাসাগর কেন নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন তা কিছুটা প্রশ্ন সৃষ্টি করে। ঈশ্বরচন্দ্র পাঠশালার দুজন গুরুর অধীনে পড়াশুনা করেন। প্রথম গুরু প্রহার করায় তিনি দ্বিতীয় গুরুর পাঠশালয় উপনীত হন। তিনি নিজেই পাঠশালার দ্বিতীয় গুরু কালীকান্ত শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন সে সম্পর্কে পরবর্তীকালে লিখেছেন, ‘সাতিশয় পরিশ্রমী এবং শিক্ষাদান বিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ ও যত্ন বান’। কালীকান্তর কাছেই তিনি পড়ালেখায় হাত পাকিয়ে শুভঙ্করের অঙ্ক শিখে নামতা মুখস্ত করে গ্রামীণ সনাতনী পদ্ধতির পাঠ শেষ করেন আট বছর বয়সে। কালীকান্তের পরামর্শেই বাবার অমতে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় পড়তে আসেন। তা সত্ত্বেও পাঠশালা গুরুদের সম্পর্কে তার নেতিবাচক মন্তব্য প্রশ্ন সৃষ্টি করে।
ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে বারো বছরের শিক্ষা সমাপন শেষে মাত্র বাইশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার প্রধান পণ্ডিতের চাকরি পান। দায়িত্ব ইংরেজ সরকারী কর্মচারীদের বাংলা শেখানো। তিনি ইংরেজদের সাথে মেলামেশার সুযোগে নানা আধুনিক চিন্তার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেন। যুক্তিবাদী মননের সাথে পরিচিত হন। তিনি নতুন চিন্তার আলোতে স্নান করলেন এবং কুসংস্কার আচ্ছন্ন বাংলায় সেই চিন্তা প্রচার করতে চাইলেন। তিনি আরো বহু ইংরেজদের মতোই মনে করেছিলেন, সমাজের অগ্রগামীরাই শুধু নতুন চিন্তাকে ধারণ করতে পারবে। যাঁদের নির্দেশে সমাজ পরিচালিত হয়, তিনি নতুন চিন্তায় প্রথম তাঁদেরকেই দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। যাঁরা কুসংস্কার আচ্ছন্ন তাঁদের নতুন চিন্তায় দীক্ষা দেয়া কঠিন বলেই তিনি ভদ্রঘরের শিশুদের দিয়ে তাঁর কার্যক্রম আরম্ভ করার কথা ভাবলেন। ব্যাপারটাকে শিক্ষাদান হিসেবেই শুধু তিনি দেখেননি, কুসংস্কার আচ্ছন্ন বাংলার সমাজকে নতুন আলোতে উদ্ভাসিত করার মহৎ পরিকল্পনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থার পুরো নিয়ন্ত্রণ তিনি তাই কব্জা করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি মহৎ লক্ষ্যেই আবার সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কুসংস্কার আচ্ছন্ন বাংলার সাধারণ মানুষকে স্বভাবতই তিনি এই সংগ্রামে তাঁর সাথী ভাবতে পারেননি। ফলে তাঁকে ইংরেজ সরকারের এবং বাংলার ভদ্রলোকদের দ্বারস্থ হতে হলো। সনাতন পাঠশালা শিক্ষায় তাঁর চিন্তার প্রতিফলন ছিল না বলেই সনাতন পাঠশালার প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকারী সাহায্য চেয়ে বসলেন। কিন্তু বাংলার পাঠশালা কোনোরকম সরকারী সাহায্য ছাড়াই বিস্তৃত হচ্ছিলো। দুঃখজনক যে ইংরেজদের শাসনেই তা ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত’ হতে শুরু করে। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কর্মবীর ঈশ্বরচন্দ্র সেই ধ্বংসের সরাসরি ভাগীদার হলেন।
ফরাসি বিপ্লবে কী ঘটেছিল। পাশ্চাত্যে তখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, চার্চের নিয়ন্ত্রণের ভিতরে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। মুসলিমদের মাদ্রাসা শিক্ষা ধর্মের যতোটা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত ছিল, চার্চের শিক্ষাধারায় তাও ছিল না। মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে প্রাচীন গ্রীস রোমের শিক্ষার প্রভাব ছিল। চার্চ তা সম্পূর্ণ বর্জন করে। চার্চ ছিল ভয়াবহরকম ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পাশ্চাত্যে সাতশো আটশো বছর সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে চার্চের দ্বারা। ফলে নাটক-শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের রেঁনেসা মানে, চার্চের দ্বারা যা কিছু বন্ধ হয়েছিল সেগুলিকে ফিরিয়ে আনা। ইউরোপের নবজাগৃতি বা রেঁনেসাকে ঘিরে চার্চের প্রভাব কমতে শুরু করলেও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হলেও; সত্যিকার অর্থে চার্চের প্রভাব তখনো কমেনি। স্মরণ রাখতে হবে রেঁনেসার পরই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জন্য কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও সহ বহুজনকে নিগৃহীত হতে হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলার জন্য ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয় রেঁনেসার পরেই। ফরাসী বিপ্লব যখন ঘটে, ফরাসী দেশে চার্চ নিয়ন্ত্রিত অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিপ্লবের পর সবকটা বিশ্ববিদ্যালিয় বন্ধ করে দেয়া হয়। আঠারশো আট সালে নেপোলিয়ন নতুন পাঠ্যক্রম আর ধর্মের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে শুধুমাত্র প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়টি আবার চালু করেছিলেন। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বস্তরে চালু করা হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে কিছু কিছু শিক্ষা কার্যক্রম থাকবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশ জুড়ে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার ব্যাপারে তারা উৎসাহ দেখায় আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রুশো নিজে। বিপ্লব উচ্চশিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি যতোটা দেয়া হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষাকে। সঙ্গে সঙ্গে এটা বলা হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করবে ধনী দরিদ্র সকলে।
বাংলার দুর্ভাগ্য এই যে, ইংরেজ শাসনে ঠিক উল্টোটা ঘটলো। বাংলায় তখন ফরাসী দেশের চেয়ে উন্নত আর সর্বত্রগামী পাঠশালা শিক্ষা ছিল, যা প্রথমিক শিক্ষারই নামান্তর। ইংরেজ শাসনে শাসক আর বাবুরা মিলে তা ধ্বংস করার কাজে নেমে পড়লো। প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা তাদের কাছে প্রাধান্য পেল। ফরাসী বিপ্লবের সরকার সকলের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা পৌঁছে দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল আর বাংলার ইংরেজ সরকার কতিপয় মানুষকে শিক্ষিত করার কথা ভেবেছিল। ফরাসী দেশে বহু বহু বছর পর্যন্ত প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করে ফরাসী দেশের বিপ্লবী সরকার। বাংলায় যেখানে প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই পাঠশালা শিক্ষা গড়ে উঠছিল, ইংরেজ শাসনে সেটার আরো ব্যাপক বিস্তার না ঘটিয়ে, সেটাকে ধ্বংস করার চেষ্টায় সকলে লিপ্ত হলো। যখন বাংলায় পাঠশালা শিক্ষা গড়ে ওঠে তখন ছাপাখানা ছিল না। ফলে পুস্তককে ঘিরে লেখাপড়া করানোর সুযোগই তৈরি হয়নি। কারণ পুস্তক তখন হাতে লিখতে হতো। ইংরেজ শাসনে অবশ্যই পুস্তক ছাপিয়ে পাঠশালার প্রতিটি শিক্ষার্থীকে দেয়া যেতো আর বইয়ের বোঝা না বাড়িয়ে পাঠশালা যেমন ছিল অনেকটা তেমন রেখে, আলাদাভাবে মাধ্যমিক আর উচ্চশিক্ষা চালু করা সম্ভব ছিল। পাঠশালা যেভাবে চলছিল সেভাবে চলতে দিয়ে ভিতর থেকেই এর আরো কিছুটা উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু শাসকরা আর জমিদার এবং সুবিধাভোগী বাবুরা উপর থেকে নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে গিয়ে পাঠশালাকে ধ্বংস করে বাংলার সাধারণ মানুষের সাক্ষরতার হার রাতারাতি কমিয়ে দিয়েছিল।
বাংলায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রাধাকান্ত দেব বাংলা শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও বিস্তারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঈশ্বরচন্দ্র তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। পরমেশ আচার্য দেখাচ্ছেন, লক্ষ্য করবার বিষয় রাধাকান্ত দেব সাধারণের পাঠশালা শিক্ষার উন্নতি বিষয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন আর ঈশ্বরচন্দ্র ভদ্রলোকের শিক্ষা বিষয়ে তার কর্মপ্রচেষ্টাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। বাংলা শিক্ষাকেও শুধুমাত্র ভদ্রসমাজে সমাদৃত করার কাজেই তিনি মূলত ব্যাপৃত ছিলেন। জনশিক্ষা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে ছিল না। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, অক্ষয়কুমার দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এসব কাজে তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন। রাধাকান্ত দেব শুধু মাতৃভাষা শিক্ষার উপর জোর দেননি, মাতৃভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করে যুবকরা যাতে কৃষি ও শিল্প বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষেও মত দেন। রাধাকান্ত দেব এটাও বুঝেছিলেন বৃত্তিমূলক শিক্ষা না দেওয়া হলে যুবকরা শুধুমাত্র সরকারের করণিক হবার লোভে শিক্ষা লাভ করবে। কিন্তু এই ধরনের শিক্ষা যারা লাভ করবে সকলের জন্য করণিক হবার সুযোগ থাকবে না, ফলে তারা আবার চাষাবাদেও ফিরে যেতে পারবে না এবং বেকারত্বের অভিশাপ ভোগ করবে। রাধাকান্ত তাই উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন আর ঈশ্বরচন্দ্র চেয়েছিলেন সকল শিক্ষার্থীকে মুখস্তবিদ্যার বিরাট পণ্ডিত বানিয়ে তুলতে। মূল সঙ্কটটা ছিল শাসনব্যবস্থার গোটা বিন্যাসটার মধ্যেই। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা বা ভূদেব বেশ নিষ্ঠাভরে আমলাতান্ত্রিক বিবেক পরায়ণতার সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির কথা ভেবেছিলেন ভারতবর্ষের স্বার্থে এবং গভীর মনোযোগও দিয়েছিলেন ছাত্রদের মেধা বৃদ্ধির জন্য। খুব আন্তরিকতার সাথেই চেয়েছিলেন বিদ্যার ‘ঝুলি’তে ছাত্ররা যেন জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তোলে। নতুন পাঠক্রম, পরীক্ষা গ্রহণ সবকিছু সেই উদ্দেশেই করা হয়েছিল তবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল খণ্ডিত। নিজেদের বিশ্বাসের জায়গা থেকেই তাঁরা এসব করেছিলেন।
বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণীর দেখা মেলে। প্রায় দুশো বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও বাবু শব্দের ব্যবহার মোটমুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। বিশ্বনাথ জোয়ারদার দেখাচ্ছেন, ‘বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ভিন্ন নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। ইংরেজ শাসনের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন। পুরানো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হলো এক নতুন ধনী সম্প্রদায়ের। এরাই তখন বাবু। বাবু নামের রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেলেন, ‘যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিনীর অনুরোধে লক্ষীপূজা করিবেন, উপগৃহিনীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠাট্টা করে বাবুর যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তার মধ্যে অতিরঞ্জন থাকলে সত্যের অভাব নেই। এই বাবু জমিদার অথবা ব্যবসায়ী বাবু নয়, ইংরেজী শিক্ষিত বাবু। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, এরা নিজের ভাষাকে ঘৃণা করে পরের ভাষায় পারদর্শী, মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ। এরা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করে, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জন করে, উপার্জনের জন্য বিদ্যাশিক্ষা করে এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র চুরি করে। এদের বল হস্তে এক গুণ, মুখে দশ গুণ, পিঠে শত গুণ এবং কার্যকালে এরা অদৃশ্য।
ইংরেজ শাসনে বাংলার মুসলমান কৃষক সহ সকল কৃষকরা চরম দারিদ্রের মধ্যে নিপতিত হয়। বিশেষ করে কুটির শিল্প ধ্বংসের ফলে মুসলিম কারিগররা ভয়াবহ ক্ষতির স্বীকার হয়েছিলেন। বাংলার কারিগরি শিল্পকে সম্পূর্ণরূপে তছনছ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কৃষির ওপর নিক্ষেপ করা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। কটন লিখেছিলেন, ‘সরকারের কর্মকর্তারা পর্যন্ত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সারাদেশের কারিগররা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।’ কিন্তু বাংলার বাবুরা কৃষক ও কারিগরদের এই আর্তনাদ কানে তোলেননি। বরং নিজদেশের সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টের পাশে না দাঁড়িয়ে তাঁরা ইংরেজ শাসন দীর্ঘতর করার আবেদন জানিয়েছিলেন। বাবুরা কেন ইংরেজ শাসন দীর্ঘতর করতে চাইছেন সে সম্পর্কে কটন লিখেছেন, ‘এঁরা জানেন আমরা যদি আজ স্বেচ্ছায় ভারত ছেড়ে চলে যাই, যদি ভদ্রলোকদের জন্য শান্তি ও শৃঙ্খলার পাকা ব্যবস্থা না করেই চলে যাই, তবে সেই মুহূর্তে তাঁরা হিংস্র অশিক্ষিত সব যোদ্ধাদের পদানত হবেন।’ কটন এইসব শিক্ষিত বাঙালীদের সম্পর্কে আরো লিখেছেন, ‘এঁরা কিন্তু জনগণের মুখপাত্র নন। তাঁদের কথাবার্তায় সাধারণের মতামত বা আবেগ-অনুভুতির প্রতিধ্বনি মিলবে না।’ কটন খুব সত্যিই কথাই বলেছিলেন, বাংলার শিক্ষিতরা জনগণের মুখপাত্র ছিলেন না। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার মতো ব্যক্তিরা নিজেদের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাই ইংরেজ শাসনের কুফলগুলি দেখতে পাননি। সেজন্য চাষীদের দুভার্গ্যের সমব্যথী না হয়ে তিনি ইংরেজ শাসনের পূজারী হয়েছিলেন।
সংস্কারবাদীরা বিধবা বিবাহ, সতীদাহ এগুলি নিয়ে প্রচুর আন্দোলন করেছেন; নানা ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ভূমিকাও রেখেছেন কিন্তু গ্রামীণ সাধারণ মানুষকে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ইংরেজী শিক্ষালাভের ফলে ক্রমাগতই তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন। শাসকদের মতো সাধারণ জনগণকে তাঁরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন। বাংলার হাজার হাজার গ্রামের লক্ষ লক্ষ শিশু যে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নিরক্ষর হয়ে পড়ছে তা নিয়ে কোনো সভা-সমিতি বা আন্দোলন তাঁদের করতে দেখা যায়নি। স্মরণ রাখতে হবে, বিধবা বিবাহ, সতীদাহ নিবারণ, স্ত্রী শিক্ষা, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার আন্দোলন যতোই প্রগতিশীল হোক, এগুলো ছিল মধ্যবিত্তের আন্দোলন। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যই। নাট্যকার উৎপল দত্ত লিখেছেন যে, দরিদ্র বা সাধারণ মানুষের জীবনে বিধবা বিবাহের প্রচলন সবসময়ই ছিল; সম্ভ্রান্ত পরিবারেই তা শুধু নিষিদ্ধ ছিল। সতীদাহর প্রশ্নটিও ছিল সম্ভ্রান্ত বা ধনীকগোষ্ঠীর মধ্যে এবং সেটা চালু হয়েছিল খুব বেশিদিন নয়। প্রাচীন ভারতে সতীদাহ বলে কোনো প্রথাই ছিল না। যাই হোক, শহুরে সুবিধাভোগী আলোকপ্রাপ্তরা সতীদাহ নিবারণ, বিধবা বিবাহ আন্দোলন, স্ত্রী শিক্ষার প্রসার, পত্রিকা প্রকাশ এসব আন্দোলনে ব্যস্ত রইলেন মূলত কলকাতা ও কলকাতার আশপাশকে ঘিরে কিন্তু গ্রাম বাংলার দিকে তাঁদের নজর গেল না। গ্রাম বাংলার কৃষকদের হাহাকার তাঁরা শুনতে পাননি। বাংলার কৃষকদের থেকে ইংরেজী শিক্ষিত বাবুরা কতোদূরে বাস করতেন তার করুণ বিবরণ দেন বঙ্কিম ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে।
বাংলার কারিগরী শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে তছনছ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কৃষির উপর নিক্ষেপ করা ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। কিন্তু সেই কৃষিকেও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে দেয়নি শাসকরা। সারাদেশের কারিগর শ্রেণীগুলো তখন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, কারিগরী শিল্প ধ্বংস হচ্ছে, কৃষির উপর চাপ বাড়ছে; পাশাপাশি দরিদ্র কৃষক এবং ক্ষেতমজুররা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রগতিশীল বাবুদের কিন্তু এদিকে সামান্য নজর ছিল না, তাঁরা শুধু ব্যস্ত রইলেন নিজেদের সন্তানদের ইংরেজী শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত করতে। কার জন্য এবং কেন আলো চাই সেটা না জেনে, না বুঝেই। বাংলার এইসব নব্য প্রগতিশীলদের সাধারণ দরিদ্র মানুষের কথা ভাববারই সময় ছিল না, গ্রামীণ সাধারণ মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া তো দূরের কথা। ফলে বহু যুগ ধরে গ্রামে যে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে তো ধরে রাখাই গেল না, বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থাও ঘরে ঘরে পৌঁছানো গেল না। সত্যিকারভাবে সকল মানুষের সাক্ষরতা লাভের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারটাকে বহুকাল পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই দেখেননি তাঁরা, নিজ সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষার দিকেই ছিল তাঁদের নজর।
বাংলায় ইংরেজ শাসনে বারবার যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, শহুরে প্রগতিশীলরা কখনো তা নিয়েও মাথা ঘামাননি। হ্যাঁ ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে তিনি প্রচুর দান করেছেন, কিন্তু ইংরেজ শাসকরাই যে এর জন্য দায়ী মুখ ফুটে তা বলতে পারেননি। রবার্ট নাইট লিখেছেন, খরা পূর্বেও ভারতে ছিল এবং কখনো কখনো তা দুর্ভিক্ষেও পরিণত হতো। কিন্তু তখন জনতা এতো অসহায় ছিল না যে অভাব হলেই দুর্ভিক্ষ লাগবে। তখন দেশের প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব শস্য ভাণ্ডার ছিল দুর্ভিক্ষ ঠেকাবার জন্য। ইংরেজ সমাজতন্ত্রীরা তাই বলার চেষ্টা করেছিলেন ভারতে দুর্ভিক্ষের কারণ খরা নয়, কারণ ইংরেজদের খাজনা। যতো বড় দুর্ভিক্ষই হোক, কোনো দুর্ভিক্ষেই তারা কৃষকদের খাজনা মাফ করেনি, কোনো ধরনের সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। বাংলার জনগণকে মহামারী ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো সদিচ্ছা ইংরেজদের ছিল না বলেই এই সব বিপত্তির জন্ম। মুঘল শাসকরা কিন্তু যে যে কোনো বিপর্যয়ে খাজনা মওকুফ করে দিতেন, কৃষকদের পাশে দাঁড়াতেন। ইংরেজরা কৃষকদের বিপর্যয়ে সামান্য খাজনা ছাড় দিতো না। ইংরেজদের এই নিষ্ঠুর চরিত্র বিদ্যাসাগর দেখতে পাননি। তিনি ইংরেজকে দেখেছিলেন নতুন ধারার আলোকবর্তিকা হিসেবে। কারণ সমাজের কুসংস্কার দূর করার কাজে বিদ্যাসাগর তখন একপেশে ধারণায় অন্ধ হয়ে আছেন। ইংরেজদের শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ‘মহাবিদ্রোহে’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিলেন না, ছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে। ইশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে এখানে অবশ্য একটি তথ্য দিয়ে রাখা দরকার। আঠরশো সাতান্ন সালের মহাবিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা কলকাতায় এক বিজয় উৎসবের আয়োজন করে। সে-সময়ে ইংরেজদের নিষ্ঠুর পীড়ন ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলছিল বিদ্রোহীদের উপর। বাংলার প্রায় সকল বাবুরাই সে উৎসবে উপস্থিত ছিলেন, বিদ্যাসাগর কিন্তু সেদিন তাতে যোগ দেননি।
ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রভাবে, ইংরেজি বিদ্যালয়ের ঢংয়ে গড়ে ওঠা কলকাতা ও তার আশপাশের বাংলা বিদ্যালয়গুলিকে মোটেই গরীবের গণশিক্ষার ‘পাঠশালা’ বলে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের সন্তানকে মার্জিত বাংলা শেখানোর বিদ্যালয় ছিল এগুলি। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে ভদ্রঘরের ছেলেরা বাংলা প্রায় ভুলতে বসেছিল। মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে মধ্যে ‘ভয়াবহ’ বাংলা বলা অভিভাবকদের ভাবিয়ে তোলে। ভদ্রলোকদের কাছে বাংলা বিদ্যালয় সেই সমস্যা সমাধানের একটি উপায় হলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রভাবে সে বাংলা ছিল সংস্কৃত শব্দ দ্বারা ভরপুর সাধু বাংলা। কথ্য বাংলার বিরুদ্ধে বাবুদের খুব রাগ এবং ঘৃণা ছিল। কারণ তাঁদের মতে কথ্য বাংলা হচ্ছে ছোটলোকদের ভাষা। যাই হোক, উনিশ শতকের বড়ঘরের ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখানোর তাগিদে ইংরেজি ঢংয়ের বাংলা বিদ্যালয়গুলি খোলা হয়, এসব বিদ্যালয়ের সঙ্গে আগের বাংলা পাঠশালার অনেক ফারাক। পাঠশালাগুলিতে একেবারে নিচুতলা থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষের সন্তানরা পড়তে আসতো। লেখাপড়ার বিষয়ও ছিল সেই মতো। হিসাব শেখা, নানারকম কাজের চিঠি লিখতে শেখা; এইসব ব্যবহারিক বিদ্যার উপরই জোর ছিল বেশি। পূর্বের সেই ধারাটা এবার কিন্তু পাল্টে গেল। সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা সাহিত্যচর্চায় গুরুত্ব পেল ভদ্রলোকদের বাংলা বিদ্যালয়গুলিতে। চকচকে ধপধপে পোষাক, জুতা-মোজা পরিহিত সন্তানদের জন্যই নতুনভাবে বাংলা প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হলো।
শহরের ধনীক সম্প্রদায়ের গতর আয়েসী সন্তানদের জীবনের সাথে খাপ খায় এমন লেখাপড়াই হলো তখন আদর্শ। ইংরেজদের উদারতাবাদী শিক্ষার ধারায় মনের স্ফূর্তির জন্য ভাষা ও সাহিত্যচর্চা শুরু হলো। সারাদিন যাদের কোনো কায়িক পরিশ্রমে অংশ নিতে হয় না, দিনমান ধরে বিশ্বজ্ঞান ভাণ্ডার থেকে নানা কিছু আহরণ করা তো শুধুমাত্র তাদের পক্ষেই সম্ভব। সারাবিশ্বের কবিতা বা সাহিত্যের ভাণ্ডার মুখস্থ করতেই বা বাধা কোথায় তাদের! কিন্তু সারাদিন কায়িক পরিশ্রম করে যাদের বেঁচে থাকতে হয়, এই বিলাসী শিক্ষার সুযোগ কোথায় তাদের জীবনে? ভদ্রলোকের এই বিলাসী শিক্ষা বা সর্বজ্ঞান আহরণকে কোনো দোষই দেওয়া যেতো না যদি না তারা বাংলার নিম্নবর্গের সাক্ষরতা লাভের পাঠশালাকে ধ্বংস করতেন। গরীবের লেখাপড়া শেখার কথাটা এইসব দেশীয় সম্ভ্রান্ত এবং বিদ্যাসাগর কারো মনেই বড় একটা ঠাঁই পায়নি। বরং তাদের শিক্ষাদানের বিরুদ্ধেই তাঁরা সরব ছিলেন। টমাস মেকলের চুঁইয়ে পড়া শিক্ষানীতিকে তাঁরা সমর্থন জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এমন এক শিক্ষার প্রস্তাব তাঁরা রাখলেন বা এমন ধারার শিক্ষা চালু করলেন যার জন্য বিদ্যালয়ের বাইরে আবার গৃহশিক্ষক আবশ্যক হয়। তাঁদের দেওয়া পাঠ্যসূচী একজন গৃহশিক্ষক ছাড়া শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের শ্রেণীতে বসে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। স্বভাবতই ভদ্রলোকদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘গৃহশিক্ষক’ শব্দটি ঢুকে পড়লো। বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখের দেওয়া শিক্ষা প্রস্তাবের কারণেই বিদ্যালয়ের বাইরে বাড়তি খরচ হিসেবে একজন ‘গৃহশিক্ষক’-এর আবির্ভাব ঘটলো; যা দীর্ঘকালের জন্য বাংলার শিক্ষা ব্যাবস্থার আপদ হয়ে রইলো।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের সন্তান দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য দশজনের অধিক গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন সেই যুগে এবং রবীন্দ্রনাথের শিশু বয়সেই। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয় ‘শিশুশিক্ষা’ দিয়ে তারপর ‘বর্ণপরিচয়’, তারপরে ‘শিশুবোধক’। শিশুবোধকেই মূলপাঠসহ চানক্য-শ্লোকের পদ্যানুবাদ পড়তে হতো। এসব পড়তে গিয়ে শিশু রবীন্দ্রনাথের ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যতো পড়ি তার চেয়ে না পড়ি অনেক। সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত পড়াশুনার যাতাকল চলছেই। শিশু রবিকে ‘কুমারসম্ভব’ ‘ম্যাকবেথ’ পড়তে হয়েছিল শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে। ম্যাকবেথ পড়ে বাংলায় অনুবাদ করতে হতো। রামসর্বস্ব পণ্ডিত পড়াতেন সংস্কৃত। ব্যাকরণ পড়াতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ‘শকুন্তলা’ পড়াতে লাগলেন শিশু রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের নিজের জবানীতে রয়েছে, ‘নীলকমল ঘোষাল আমাদের পড়াতেন। সকাল ছটা হতে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাভার তাঁর উপর ছিল। চারুপাঠ, বস্তুবিচার, প্রাণিবৃত্তান্ত থেকে আরম্ভ করে মাইকেলের মেঘনাদবধকাব্য পর্যন্ত তাঁর কাছে পড়া।’ সকাল ছটার আগে ভোর অন্ধকার থাকতে উঠে লেংটি পড়ে প্রথমেই এক কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখা দিয়ে রবির পাঠ আরম্ভ হতো। কুস্তির পর মাটি ময়লা লাগা শরীরের উপর জামা পড়ে পদার্থ বিদ্যা, মেঘনাদবাধকাব্য, জ্যামিতি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল শিখতে হতো। বিদ্যালয় থেকে ফিরে অঙ্কন শেখা, তারপর জিমনাস্টিক। সন্ধ্যার সময় ইংরেজীতে পড়াতেন অঘোরবাবু। বরিবার সকালে বিষ্ণুর কাছে গান শিখতে হতো।
ব্যায়াম, মল্লযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্য, বিজ্ঞান সব বিষয়ে গৃহশিক্ষকরা শিশু রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর অন্যান্য সন্তানদের দেবেন্দ্রনাথ যেভাবে গৃহশিক্ষক রেখে পড়াতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রাথমিক শিক্ষাকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো সোনার চামচ নিয়ে যে বাংলার কৃষক সন্তানরা জন্মায় না সেটা দেবেন্দ্রনাথের মতো অনেকেই সেদিন বুঝতে চাননি। গ্রামের সাধারণ কৃষক সন্তানের কথা মাথায় থাকলে তাঁরা কেউই ঐ ধরনের পাঠক্রমের প্রস্তাব করতেন না। আসলে তখন ইংরেজদের মতো বাংলার অভিজাতরা মনে করতেন, শিক্ষা সর্ব সাধারণের ব্যাপার নয়। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তান রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র মানুষের শিক্ষার জন্য নিজেই বিদ্যালয় খুলেছিলেন কিন্তু তিনি কখনো সর্বসাধারণের সাক্ষরতার পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরেননি। তিনি সাধারণের শিক্ষার ব্যাপারে দরকার মতো সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি ইংরেজদের শিক্ষানীতি পছন্দ করেননি অাবার খুব জোরালো ভূমিকা নেননি পাঠশালার পক্ষে। ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ সুবিধাভোগীরা যেভাবেই বিষয়টা বিবেচনা করে থাকেন না কেন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের সন্তানের দিকে বা নিজশ্রেণীর প্রতি লক্ষ্য রেখেই তাঁরা বিদ্যালয়ে পাঠক্রম রচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইংরেজরা সেই পথ ধরেই এগিয়েছিল। দেখা যাবে ইংরেজ শাসনে এই ধরনের বিপুল পরিমাণ পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করায় দরিদ্ররা পাঠশালা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য। প্রায় শত বছর পরে যখন অমর্ত্য সেন বলেন ‘ভারতের সকল শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, আর ভিন্ন দিকে প্রথম হওয়া ছাত্রদের নিয়ে খুবই মাতামাতি করা হয়, বাস্তবিকভাবে সেটা হলো ইংরেজ শাসক এবং বাঙালী ভদ্রলোকদের শিক্ষানীতির সুদূর প্রসারী ফল।
বাংলার পাঠশালাসমূহের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাপ্ত অর্থভাণ্ডার অত্যন্ত সীমিত ছিল। পর্যাপ্ত অর্থভাণ্ডারের অভাবই প্রাথমিক শিক্ষা বা পাঠশালা উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যা পূর্বের পাঠশালা ব্যবস্থাকেও টিকতে দিলো না আবার নিজেদের মনগড়া ব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্তরায় হলো। ফলে বহু বালককে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। লক্ষ লক্ষ বালক-বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে পড়ে রইলো। নিরক্ষর অবস্থায় তারা বড় হতে থাকলো। পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, সরকার পাঠশালাসমূহের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করতে চাইলে শিক্ষাখাতে আরও তহবিল সঞ্চার করতে হতো। স্মরণ রাখতে হবে, সতেরশো সাতান্ন সালের পর থেকে আঠারশো একাত্তর সাল পর্যন্ত একশো বছরের অধিককাল পরেও শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ ছিল মাত্র এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নয়, সকল শিক্ষার জন্য। সরকারের এই অর্থ বরাদ্দ কতো ক্ষুদ্র ছিল তা বোঝা যাবে এটা বিচার করলে যে, আঠারশো শতকের শেষে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশের বাৎসরিক বেতন ছিলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। প্রমোদ সেনগুপ্ত এই খবরটি দিচ্ছেন। আর আঠারশো সাতান্ন সালে জেনারেল এনসনের বাৎসরিক বেতন ছিল এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। বাংলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বরাদ্দ ছিল সরকারের সামরিক বাহিনীর একজন প্রধান সেনাপতির বেতনের সমান।
বিদেশী শাসকরা সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে, এটাই তো কখনো ঘটা সম্ভব ছিল না। ব্যাপক মানুষের জন্য এর ফলাফল হয়ে দাঁড়িয়েছিল মারাত্মক। সরকারী সিদ্ধান্তগুলো বহুক্ষেত্রেই ছিল স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। আঠারশো উনসত্তর সালে ভারতের গর্ভনর জেনারেলের দায়িত্ব নেন লর্ড মেয়ো। তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারী ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বরঞ্চ সরকারী অর্থ পুরোটাই প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি মেকলে ও অকল্যান্ডের চুঁইয়ে পড়া শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেন এবং বলেন সরকার সর্বসাধারণের শিক্ষার জন্য কিছুই করেনি। তাঁর মতে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা নিজেরাই তাঁদের সন্তানের শিক্ষার ব্যয়ভার বহনে সক্ষম। কাজেই এই শ্রেণীর শিক্ষার জন্য সরকারী অর্থব্যয় অর্থহীন বলে তিনি বিবেচনা করেন। তিনি স্পষ্টতই জানান যে, বাবুরা যতো খুশি ইংরেজী শিক্ষা লাভ করুন। সরকার না হয় গরীবদের শিক্ষার জন্য কিছু চেষ্টা করুক। লর্ড মেয়োর এই মতের সমর্থনে বাংলার ছোটলাট ক্যাম্পবেল সর্বসাধারণের শিক্ষার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করেছিলেন।
ক্যাম্পবেল আঠারশো বাহাত্তর সালের ত্রিশে সেপ্টেম্বর একটি প্রস্তাব প্রণয়ন করেন যা পাঠশালাগুলোকে সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করেছিল। প্রস্তাবে বলা হয় যে, সরকারের একটি মূল উদ্দেশ্য হবে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা প্রদান। এ লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা উন্নয়নে চার লক্ষ রুপির বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বরাদ্দ ছিল পূর্বের এক লক্ষ ত্রিশ হাজারের অতিরিক্ত। হাজী মহম্মদ মহসীন হুগলী কলেজের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। ক্যাম্পবেল মহম্মদ মহসীনের বিপুল দান হুগলী কলেজের জন্য ব্যয় না করে দেশের মুসলমান সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উচ্চশিক্ষার আয়োজনকে সঙ্কুচিত করে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চান। ক্যাম্পবেল উচ্চ শিক্ষাখাতে ভর্তুকি কমিয়ে সেই টাকা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করার উদ্যোগ নিলে বাঙালী ভদ্রলোক সমাজ গেল গেল রব তুলে এই নীতির বিরোধিতায় আন্দোলন শুরু করে। সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ক্যাম্পবেলের উচ্চশিক্ষা সঙ্কুচিত করার নীতির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ইংরেজ শাসনে গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ কুটির শিল্প প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক অন্যদিকে আইন-আদালতের ভাষা হয়েছে ইংরেজী। ফলে দেশের চিরাচরিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য দেশবাসীর স্বাভাবিক আগ্রহ যথেষ্ট কমে গেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলস্বরূপ দেশে যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে তারা উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহশীল। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা পুনর্বাসনের অজুহাতে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্কুচিত করা ঠিক হবে না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা খাতে খরচ কমিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে সরকারী ব্যয়ের বিপক্ষে মত দিলেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন সরকারের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক। ক্যাম্পবেল দেখলেন, ঈশ্বরচন্দ্র, ভূদেব সহ সরকারের শিক্ষা বিভাগের বিদ্যালয় পরিদর্শকরা সকলেই প্রায় উচ্চশিক্ষার পক্ষে। ফলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ভিন্ন পথ নিলেন। ক্যাম্পেবেল শিক্ষা বিভাগকে এড়িয়ে জেলা প্রশাসনের হাতে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব দিয়ে দেন। এর সুফল পেতেও দেরি হলো না। ক্যাম্পবেল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সাহায্য দানের কথা বললেন এবং আঠারশো বাহাত্তর সাল নাগাদ প্রায় দুহাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সাহায্য দেওয়া হলো। ক্যাম্পবেল পুরানো গুরু ও সনাতন পাঠশালা ব্যবস্থা বজায় রাখার কথা বললেও পাশাপাশি শিক্ষক-প্রশিক্ষণের উপর জোর দেন। কারণ তাঁর পরিকল্পনায় নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও ছিল। ক্যাম্পবেলের চিন্তা কেবল প্রতিষ্ঠিত পাঠশালা নিয়েই ছিল না, যেখানে কোনো পাঠশালা নেই সেখানেও দেশীয় রীতিতে নতুন পাঠশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্যাম্পবেলের পূর্বের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগগুলো শুধুমাত্র কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। ক্যাম্পবেল সেরকম না করে সারা বাংলার জন্য তাঁর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
ক্যাম্পবেল প্রবর্তিত প্রাথমিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিল বিদ্যমান পাঠশালাসমূহের উপরই ভিত্তি করে। নতুন বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নতুন বিদ্যালয় গড়ে উঠলেও তা পুরাতন পাঠশালার আদলেই গড়ে উঠেছিল। ক্যাম্পবেল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত পাঠশালাসমূহে জনসাধারণের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এজন্যে সবচেয়ে ভালো পন্থা হিসেবে পঠন-পাঠনের যে রীতি প্রচলিত ছিল তাই বজায় রাখার তিনি সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষার্থীদের উপর পাঠ্যক্রমের বোঝা তিনি কমিয়ে দেন। পাঠশালাসমূহের গণচরিত্র বজায় রাখার কারণে তিনি শিক্ষা কার্যক্রমের মান উন্নয়নে তাড়াহুড়ো না করা এবং পুরাতন পাঠশালার শিক্ষাসূচি অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। তিনি মনে করতেন, পাঠশালাসমূহের উন্নতি প্রধানত মুদ্রিত পুস্তকের ব্যবহার প্রবর্তনের মাধ্যমেই আসতে হবে তবে তা ধীরে ধীরে। হঠাৎ করেই তিনি পুরানো ব্যবস্থার বাইরে যেতে চাননি। ক্যাম্পবেল প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছেন আবার একই সাথে তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা করেছেন। পশ্চাদপদ মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সুদিন চট্টোপাধ্যায় তথ্য দিচ্ছেন, স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল আঠারশো একাত্তর থেকে চুয়াত্তর সালের মধ্যে সাঁইত্রিশ মাসের জন্য বাংলার সরকার পরিচালনা করেন এবং আঠারশো চুয়াত্তর সালের নয়ই এপ্রিল রিচার্ড টেম্পল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। স্যার রিচার্ড টেম্পল বলেছিলেন, প্রতি হাজারে মাত্র নয় জন নিতান্ত মামুলি প্রাথমিক শিক্ষা পায় এদেশে। সমাজের দরিদ্রতম শ্রেণীর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের যে নীতি ক্যাম্পবেল প্রণয়ন করেন টেম্পল সাধারণত তা মেনে চলেন। ফলে দেখা যায় আঠারশো একাত্তর-বাহাত্তর সাল পর্যন্ত মাত্র একহাজার আটশো একটি পাঠশালাকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে উন্নয়ন করা সম্ভবপর হয়েছিল। সেখানে ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ হাজার সাতশো দুই জন। অথচ ঐ সময়কালে বাংলায় পাঠশালাগামী ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ লক্ষ। ক্যাম্পবেলের নীতিমালার ফলে তাঁর সময়কালের শেষ বছর আঠারশো তেয়াত্তর-চুয়াত্তর সালে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বারো হাজার দুশো উনত্রিশটিতে এবং ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ তিন হাজার সাঁইত্রিশ জনে। আর টেম্পলের সময় আঠারশো একাশি-বিরাশি সালে সাতচল্লিশ হাজার চারশো দুটি পাঠশালায় মোট ছাত্র ছিল আট লাখ ছত্রিশ হাজার তিনশো একান্ন জন। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা একটি সাফল্য। কিন্তু বাংলার সনাতন পাঠশালা ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে এই অগ্রগতি খুবই নগণ্য। ইংরেজ শাসনে পাঠশালা শিক্ষার যে ধ্বংস সাধন হয়েছে তার তুলনায় এই অগ্রগতি কিছুই না। কারণ এ্যাডামের প্রতিবেদনে আঠারশো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ সালে একলক্ষ সনাতন পাঠশালার কথা জানা যায়, সে তুলনায় ক্যাম্পবেলের এই অগ্রগতি ছিল সান্ত্বনারই নামান্তর। কিন্তু তবুও স্বীকার করতে হবে দুজনেই পাঠশালা শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। স্মরণ রাখতে হবে, ক্যাম্পবেল কিংবা টেম্পলের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছিল পুরানো পাঠশালাকে ঘিরে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, বাংলার ইংরেজ শাসকদের মধ্যে ক্যাম্পবেলের প্রচেষ্টাকে তবুও ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁর আন্তরিকতার জন্য। স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল আপন বুদ্ধিতে চলতেন এবং যে কার্য করা কর্তব্য ও সাধ্য বলে মনে করতেন কিছুতেই তা থেকে বিরত হতেন না। বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তৃতির জন্য তিনি নিজের বিবেচনা মতো কিছু ইতিবাচক কাজ করে গিয়েছিলেন। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, বাংলায় আঠারশো বাহাত্তর সালে লোকসংখ্যার তুলনায় ইংরেজ সরকারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রের অনুপাত ছিল শূন্য দশমিক তিন চার। আঠারশো একাশি বিরাশি সালে তা দাঁড়ায় এক দশমিক দুই পাঁচ। নিঃসন্দেহে সেখানে ক্যাম্পবেল সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন। গরীব শিক্ষার্থীর প্রতি তিনি নজর দিয়েছিলেন। ক্যাম্পবেলের কম খরচে বেশি ছাত্রের সাক্ষরতা লাভের শিক্ষানীতি কার্যকরী হলেও শেষপর্যন্ত তাঁকে বিদায় নিতে হয় বাঙালী ভদ্রলোকদের প্রতিবাদের চাপে। পরমেশ আচার্য দেখান যে, ভদ্রলোকরা ক্যাম্পবেলের শিক্ষানীতি মেনে নিতে পারেননি। অতিরিক্ত চার লাখ টাকা প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় না করে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যয় করলেই তাঁরা আর আপত্তি করতেন না। এই সময় বাংলার সব পত্র-পত্রিকায় ক্যাম্পবেলের শিক্ষানীতির বিরোধিতা চলতে থাকে। শুধু কলকাতায় নয়, জেলায় জেলায় ক্যাম্পবেলের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। ক্যাম্পেবেলের শিক্ষনীতি উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে জেহাদ হিসাবে আখ্যা পায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ক্যাম্পেবেলের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ভদ্রলোকদের বিরোধিতার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ক্যাম্পবেলের পক্ষে লেখেন, ‘রাজকোষ হইতে ধনীদের শিক্ষার জন্য অধিক অর্থ ব্যয় হউক, নির্ধনদিগের শিক্ষায় অল্প ব্যয় হউক ইহা ন্যায়বিহর্গিত কথা। বরং নির্ধনদিগের শিক্ষার্থ অধিক ব্যয়, এবং ধনীদিগের শিক্ষার্থ অল্প ব্যয়ই ন্যায়সঙ্গত; কেন না ধনীগণ আপন ব্যয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নির্ধনগণ, সংখ্যায় অধিক, এবং রাজকোষ ভিন্ন অনন্যগতি।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জর্জ ক্যাম্পবেলের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ভদ্রলোকদের প্রতিবাদের সমালোচনা করে আরো বলেন, ‘তিনি সাম্যবাদী, তিনি প্রজার কোনো মঙ্গলসিদ্ধ করে থাকুন বা নাই থাকুন, তিনি প্রজা হিতৈষী’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি ক্যাম্পেবেলের শিক্ষানীতির সমর্থনে যে-কয়েকজন কলম ধরেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাদ্রী লালবিহারী দে, ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেন। কিন্তু বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বাংলার জেলায় জেলায় সরকারী নীতির প্রতিবাদে যে-সব সভার আয়োজন করা হয় তা ছিল নিম্নবর্গকে শিক্ষা প্রদান না করারই নামান্তর। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বক্তারা এইসব সভায় সরকারী নীতির প্রতিবাদে জনমত সংগঠনের লড়াই চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত ক্যাম্বেলকে বিদায় নিতে হলো এবং সুরেন্দ্রনাথ দাবি করলেন, তাঁদের আন্দোলনের ফলেই ক্যাম্পবেলকে বিদায় নিতে হয়েছিল। বাংলার ভদ্রলোকরা কীভাবে সর্বস্তরে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিরুদ্ধে ছিলেন এইসব ঘটনা থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়।