বাংলাদেশের নাট্যচর্চা, নাট্য আন্দোলন ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২২
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দশ বছর পর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যখন জন্ম নেয় তখন বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলা থেকে ছেচল্লিশটি নাট্যদলের প্রতিনিধি ফেডারেশানের উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে। সে সময় সারা বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্যভুক্ত দলের সংখ্যা ছিল ৬৭টি। ঢাকা মহানগরের নাট্যদলেরই সংখ্যা ছিল ১৭টি। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৭১টিতে। নাট্য আন্দোলনের জন্য সংখ্যাটি খুব উল্লেখযোগ্য নয়।
১৯৮৫ সালে থিয়েটার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা খুবই সীমাবদ্ধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঢাকার বাইরের নাট্যদলগুলো বছরে তিন চারটি প্রদর্শনী করে কোনোভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ঢাকার বাইরের নাট্যানুষ্ঠান আয়োজনের মূল সমস্যা দর্শক পাওয়া যায় না। নাট্যদলগুলোও সুসংগঠিত নয়। যা প্রমাণ করে ঢাকার বাইরে নাট্য আন্দোলন তখনো সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। মানে নাট্য আন্দোলন বলে সত্যিকার অর্থে কিছুই দাঁড়ায়নি। যা আজকের জন্য আরো বড় সত্য।
বর্মান ফেপারেশান তো আন্দোলন করতেই চায় না, বরং ঠিক তার উল্টোটাই করতে চায়। থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য দলগুলি সারাদেশে নাট্যচর্চায় কী ভূমিকা রাখছে তার খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, মন্ত্রণালয়ের এর পেছনে টাকা ঢালার যুক্তি আছে কিনা। বরং যারা সত্যিকারের নাট্যচর্চা করছে, সারাদেশের হাতেগোনা সক্রিয় দলগুলিকে টাকা বরাদ্দ করাটাই কি লাভজনক নয়? বিষয়টা গুরুত্ব পাওয়া দরকার।
বাংলাদেশে আশির দশক থেকে প্রথম জেলা শহরগুলোতে নাটক মঞ্চায়ন কমে আসতে শুরু করে, পরবর্তীতে ঢাকা শহরেও। রামেন্দু মজুমদার পঁচাশি সালের মার্চ মাসে থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখছেন যে, ‘রাজধানী ঢাকাতে আজ একাধিক মঞ্চে প্রতিদিন নাটক হয় এবং তা দর্শকদের আনুকূল্য লাভ করে। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য শহরের এ চিত্র ভিন্ন। গ্রুপ থিয়েটার চর্চা সেখানে বড়ই সীমাবদ্ধ। চুয়াত্তরের দিকে সর্বত্র একটা জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে গেছে।’
চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশজুড়ে সত্তর দশকের শুরুর দিকে নাট্যজগতে যে উদ্যম দেখা গিয়েছিল, দশ বছরের মাথায় তা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে আসে। ১৯৮৯ সালে গ্রুপ থিয়েটারের এক বিশেষ বুলেটিন সংখ্যায় দেখা যায়, সারাদেশে গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৪টি। তার মধ্যে ঢাকা মহানগরীরই দলের সংখ্যা ৩২। ৩২টি দলের মধ্যে ১৬টি দল ছিল কমবেশি সক্রিয়। সেই বুলেটিনে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দলগুলোর এক বছরের নাট্য প্রদর্শনীর একটি তালিকাও প্রদান করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ১৯৮৮ সালের পহেলা এপ্রিল থেকে ১৯৮৯ সালের একত্রিশে মার্চ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর ১৬টি দলের নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যা ছিল ৩২২টি, ঢাকার বাইরের ৪০টি দলের মোট প্রদশনীর সংখ্যা ছিল ২০৭টি। বাকি অনেক দলের তথ্য পাওয়া যায়নি। স্বভাবতই নিষ্ক্রিয় দলগুলি তথ্য পাঠাতো না। ১৩৪টি দলের মধ্যে মাত্র ৪০টি দলের প্রতিবেদন পাঠানো বাকি দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের তালিকাভুক্ত দলগুলোর বড় একটি অংশ যে কোনোরকম কার্যক্রম ছাড়াই নামসর্বস্ব হয়ে টিকে ছিল এর থেকে বোঝা যায়। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সত্যিকারের শক্তি, কর্মধারার ব্যাপকতাও এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য সংখ্যা ১৯৯২ সালে ১৩৪টি থেকে কমে দাঁড়ায় ১২২টিতে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলনে ফেডারেশানের সদস্যভুক্ত দলের সংখ্যা দেখা যায় একশো ১৭৫টি। নামেই মাত্র এ তালিকা বৃদ্ধি হয়েছিল, নাটক মঞ্চায়নের দিক দিয়ে নয়। ঢাকা মহানগরের নাট্যদলের সংখ্যাই সেখানে দাঁড়িয়েছিল ৫৯টি। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দশ বছরে ঢাকা মহানগরের বাইরে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১৪টি। ঢাকা মহানগরে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ২৭টি। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে পাঠানো বিভিন্ন দলের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বাইরের ফেডারেশান ভুক্ত ৪১টি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা ৪৩৮টি। আর ঢাকা মহানগরীর ১৫টি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা ৩২৮টি। ১৯৯৮ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে একত্রিশে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বাইরের ফেডারেশান ভুক্ত ৪৭টি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা ৪৫৩টি। ঢাকা মহানগরীর ২১টি দলের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা ৩৩৯টি। বাকি দলগুলো তথ্য পাঠায়নি। ঢাকার বাইরের নাট্য দলগুলোর পাঠানো তথ্য কতোটা সঠিক সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। বিভিন্ন দলগুলো অনেক সময়েই নিজেদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে দেখাবার জন্য প্রদর্শনীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাতো। বিভিন্ন দলের পাঠানো তথ্য সঠিক ধরে নিলেও জেলা শহরের নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যা তেমন উৎসাহ সৃষ্টি করে না।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান দলভুক্ত গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চার ফলাফল তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? সারা বছরে সকল দলগুলির মিলিত প্রদর্শনী সংখ্যা বছরে পাওয়া যায় ৬০০ থেকে ৮০০র মধ্যে। ফলাও করে সেটাকেই বলা হচ্ছে, নাট্যচর্চা। যাদের মঞ্চে নাটক নেই, নাট্য প্রদর্শনী নেই, ঘটা করে বলা হচ্ছিল সকলেই তারা গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য। সদস্যদের মুখের নানা হাকডাক, সেটাই নাকি নাট্য আন্দোলন। ঢাকার বাইরে সারা বাংলাদেশে সেখানে সক্রিয় পাওয়া যাচ্ছে না ৫০টি দল। কিন্তু জেলার সংখ্যা ৬৪টি। ভিন্ন দিকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতেন ঠিকই বিরাট সংখ্যক প্রতিনিধি এবং তারা মিলে নির্বাচিত করতেন পরবর্তী পরিষদের সদস্যদের। খুব হাস্যকর ছিল না কি এইসব সাংগঠনিক প্রক্রিয়া? নাটক নেই, দলের অস্থিত্ব নেই, কিন্তু প্রতিনিধি সেজে ভোট দিচ্ছেন। কারা এগুলি হতে দিয়েছিলেন? কেন হতে দিয়েছিলেন? বিশেষ করে নাট্য আন্দোলনের জায়গা থেকে দেখতে গেলে যা লক্ষ্য করা যাবে তাহলো, ঢাকা মহানগরীর বাইরে বাংলাদেশের কোথাও নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর ধারা গড়ে ওঠেনি। ঢাকার বাইরের কয়েকটি দলের মোট প্রদর্শনীর সংখ্যা উল্লেখ করলে সেটা বুঝে নেয়া সহজ হবে।
বরিশালের ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার’ খুবই পুরানো সংগঠন। ১৯৬৯ সালে এই সংগঠনটির জন্ম। স্বাধীনতার পর খেয়ালী তার নামের শেষে গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি সংযুক্ত করে। মফস্বলের দলগুলোর মধ্যে খুবই কর্ম তৎপর এই দলটি। স্বাধীনতার পরের ২৪ বছরে তারা ৫০টির মতো নাটকের প্রযোজনা করে, যা বাংলাদেশের বা ঢাকা শহরের কোনো নাট্যদলই করতে পারেনি। কিন্তু দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চব্বিশ বছরে তাদের ৫০টি নাটকের মোট প্রদর্শনী সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০টি। এই সবগুলো প্রদর্শনী মঞ্চের নয়, ৩০০টির মধ্যে বহু পথ নাটকও রয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দলটি সারা বছরে ১২টি প্রদর্শনী বা গড়ে প্রতি মাসে ১টি করে প্রদর্শনী করতে পারেনি। চুয়াডাঙ্গা জেলার ‘অরিন্দম’ ১৯৮৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত এগারো বছরে ১৪টি নাটকের মাত্র ৩৩টি প্রদর্শনী করেছে। যার অর্থ বছরে গড়ে তিনটি করে প্রদশর্নী। চুয়াডাঙ্গার ‘চুয়াডাঙ্গা থিয়েটার’-এর এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালের জুন মাস থেকে ১৯৯৮ সালের মে মাস পর্যন্ত তারা মঞ্চে তাদের ৭টি নাটকের মাত্র ১৬টি প্রদর্শনী করে। বছরে দলটির গড় মঞ্চায়নের সংখ্যা দাঁড়ায় চারটি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে মঞ্চায়িত নাটকগুলোর দর্শকের সংখ্যাও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আর টিকেট কেটে নাটক দেখার দর্শক সংখ্যা আরো কম। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের শর্তে ছিল সদস্য দলকে অবশ্যই দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন করতে হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরে তেমন উদাহরণ ছিল হাতে গোনা। ঢাকাতে নাট্যচর্চা বা নাটক মঞ্চায়ন নিয়ে যতোই হৈ চৈ হোক না কেন, মফস্বল শহরের নাটকগুলোর এক রাতে মৃত্যু ঘটে, কম সংখ্যক নাটকই বারবার মঞ্চায়িত হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের আর কোথাও দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়িত হয় না। বিভিন্ন স্থানে চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অল্প কয়েকদিন পরই আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। খুলনা, ঠাকুরগাঁও, বরিশাল, বাগেরহাট, যশোর, দর্শনা, বগুড়া, ইত্যাদি শহরের বিভিন্ন সংগঠন নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলনটা দাঁড়ালো কোথায়? নাট্যচর্চাই তো ছিল না তো আবার নাট্য আন্দোলন?
বিপুল সমারোহে বা ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে যে-সকল নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল রাজধানী কিংবা বিভিন্ন শহরে, তা মূলত ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাভোগীদের জন্যই। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতার পর দু-ক্ষেত্রেই কথাটা সমানভাবে সত্য। বাংলাদেশের যে নাট্য আন্দোলন তা মূলত রাজধানী কেন্দ্রিক হলেও রাজধানীতেও নাট্য আন্দোলন তেমন কোনো ব্যাপক দর্শক তৈরি করতে পারেনি। জিয়া হায়দার লিখছেন, ‘মনে রাখতে হবে, রাজধানীর লোকসংখ্যা প্রায় পৌনে এক কোটি, মাত্র এক শতাংশ লোকই ঢাকার গ্রুপ থিয়েটারের দর্শক তা’ও যেসব নাটক সহজ জনপ্রিয়তায় বিখ্যাত, সেগুলির’। জিয়া হায়দারের বক্তব্য মতো ঢাকায় নাটকের দর্শক সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ। সে সংখ্যাটাও কিন্তু যথেষ্ট বিতর্কিত। ঢাকার যে দুটি মঞ্চে সাধারণত তখন নাটক হতো, তাহলো মহিলা সমিতি ও গার্লস গাইড মিলনায়তন। সেখানে এক সাথে চারশো দর্শক নাটক দেখতে পারে। যদি কোনো নাটকের মঞ্চায়ন পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ন্যূনতম দুশো পঁশিশটি হয় তাহলেই একলক্ষ দর্শক পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের মঞ্চে খুব কম নাটকই পঞ্চাশটির বেশি প্রদর্শনী করতে পেরেছে। দুশো প্রদর্শনী করেছে এমন নাটকের সংখ্যা ছয় সাতটির বেশি নয়। সব প্রদর্শনী আবার সব সময় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে হয় না। বহু মঞ্চায়নেই মিলনায়তন ফাঁকা থাকে। ফলে ঢাকা শহরে নাটকের এক লক্ষ দর্শক তখনো ছিল কি না সেটা ভেবে দেখবার বিষয়। ফলে সত্যিকার অর্থেই এটা কি কোনো নাট্য আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে?
বিশ শতকের পরিসংখ্যান দেয়া হলো। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বিগত বিশ বছরের পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাক সারাদেশে বছরে কতোগুলি নাট্যদল কতোগুলি প্রদর্শনী করেছে। মুখে বুলি আওড়ালেই নাট্য আন্দোলন হয় না। বাংলাদেশে চারশো পঁচানব্বইটি উপজেলা, সেখানে গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য দলের সংখ্যা নেই চারশো, তবুও এটা নাকি একটা আন্দোলন। গ্রুপ থিয়েটারের যে সদস্য সংখ্যা, তাদের মধ্যে সক্রিয় দল কয়টি? বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রে আছে একটি দল বছরে চারটি মঞ্চ নাটকের কিংবা দশটি পথ নাটকের প্রদর্শনী করতে পারলেই গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্যপদ ধরে রাখতে পারবে। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাবার জন্য এটা ছিল একটি আপসমূলক রফা। সারা বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের ভিতরে চারটি প্রদর্শনী করলেই একটি দল যে নাট্যচর্চা করছে সেটা কি প্রমাণিত হয়? নাট্যচর্চা করা মানে কি বছরে মঞ্চে মাত্র চারটি প্রদর্শনী করা বা দশটি পথনাটক করে বেড়ানো? লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, নাট্যচর্চার চেয়ে মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ। নাট্য মঞ্চায়নের চেয়ে দলের সংখ্যাটা বাড়িয়ে দেখানোতে আগ্রহ ছিল সকলের। রাজধানী ঢাকার নাট্যজগতের নেতাদের না হলে নিজেকে সারা দেশের নাট্যজগতের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব ছিল না।
বাংলদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের লিখিত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী ছিল? সেখানে বলা এগারোটা লক্ষ্যের মধ্যে তিনটি হলো: নাটককে ব্যাপক সামাজিক ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা। আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে নাটককে মুক্ত করা। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। গত দশ বছরের নাট্যচর্চায় এ ব্যাপারে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভূমিকা কী? বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গত দশ বছরে নাট্যচর্চাকে কোনো সামাজিক ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করেছে কিংবা কালাকানুন-বিরোধী কোনো আন্দোলনে অংশ নিয়েছে? গঠনতন্ত্র মেনে সংগঠনটি আদৌ পরিচালিত হয়নি। সংগঠনের নির্বাচিত পরিষদগুলির মেয়াদ হলো দু বছরের, স্পষ্ট বলা আছে বৈশাখ-চৈত্র। কখনো কি সেভাবে মেনে প্রতিষ্ঠানটি চলেছে? লিয়াকত আলী লাকি কতোবছর ধরে পদ ধরে রেখেছেন? লিয়াকত আলী পরপর তিনবার চেয়ারম্যান হিসেবে কতো বছর পার করেছেন? তিন বছরে যদি ছয় বছর পার করার কথা হয়ে থাকে কতোদিন ধরে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন বা আছেন? নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই ক্ষমতার অপব্যবহার বহুদিন ধরেই চলছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিগত ত্রিশ বছরে কখনো ঠিক দু বছরের মাথায় ক্ষমতা ছেড়ে নতুন সম্মেলন ডেকেছেন এমন উদাহরণ নেই। ক্ষমতায় বসার পর তিন চার বছর পার করে তারপর নতুন পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন দিয়েছেন। নিজেরাই তারা এমন কত অনিয়ম করে বসে আছেন।
মঞ্চনাটক দীর্ঘ সময়ের পথযাত্রায়ও ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারেনি। ঢাকা বা বিভিন্ন অঞ্চলে নাটকের যে দর্শকদের দেখা পাওয়া যায় স্বভাবতই সেই দর্শক মধ্যবিত্ত দর্শক। সেই মধ্যশ্রেণীই যেমন নাটক প্রযোজনা করছে, দর্শকও তেমনি মধ্যশ্রেণী। বাংলাদেশের নাটক শুরুই হয়েছিল মধ্যবিত্তকে নিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত নাটককে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যারা সে সময়কার নাট্যচর্চাকে নাট্য আন্দোলন বলতে চাননি তাদের মূল যুক্তিটি ছিল দর্শকের স্বল্পতা। দর্শকদের সংখ্যার প্রশ্নেই অনেকে এই নাট্যচর্চাকে নাট্য আন্দোলন বলে স্বীকৃতি দেননি। আবার অনেকে একই সাথে নাটকের বক্তব্যের প্রশ্ন তুলেও এ ধারাকে নাট্য আন্দোলন হিসাবে মেনে নেননি। বাংলাদেশের ত্রিশ বছরের নাট্য ইতিহাস প্রমাণ করে এ নাট্যধারা শুধু রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং যে মধ্যশ্রেণীকে নিয়ে মধ্যশ্রেণীর জন্য নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল, সেই মধ্যশ্রেণীর গণ্ডী বাংলাদেশের নাটক কখনো ভাঙতে পারেনি। বাংলাদেশের নাট্যপ্রযোজনার ক্ষেত্রে যদিও তা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, তবে বিশশতক পর্যন্ত সে পরিবর্তন সবসময় আশানুরূপও ছিল না। যেমন আটাত্তর সালে রামেন্দু মজুমদার লিখছেন, ‘বাংলাদেশে বিরাট একটা নাট্যান্দোলন সংঘটিত হয়ে গেছে বলে অনেকে চূড়ান্ত রায় দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যা কিছু হয়েছে তা নিয়ে সত্যিকারের সৎ নাট্যকর্মীদের আত্মতৃপ্তির অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। এখনো আমরা আমাদের নাটক বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌঁছাতে পারিনি।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘প্রসঙ্গ: গ্রাম থিয়েটার’ প্রবন্ধে একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি দেখতে পাওয়া যায়। আশির দশকে ঢাকা থিয়েটার গ্রাম থিয়েটার গড়ে তোলে ঢাকার নাট্য আন্দোলন রাজধানীর সীমিত দর্শকদের মধ্যে আটকে ছল বলে। আশির দশক পর্যন্ত নাটকের এই যে রাজধানীর মধ্যে আটকে থাকা সেটা সত্যিকার অর্থে কোনো নাট্য আন্দোলন ছিল না বলে তিনি মনে করেন। তিনি লিখছেন, ‘উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা ভোগ বিলাসী ও সুবিধাবাদী। শুধুমাত্র তাদের সামনে নাটক করে সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তা কখনও সফল হতে পারে না।’ মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রভাব ও স্বচ্ছ চিন্তার অভাবের কারণেই প্রথম থেকেই দেখা যাবে নাট্য আন্দোলন নানা বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে। নাট্য আন্দোলনকে কখনো একটি স্থির লক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে দেখা যায়নি। ঢাকা মহানগরীর বাইরে যেমন, ঢাকা শহরেও তেমন নাটক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে। ১৯৯৯ সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের মহাসচিবের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মঞ্চ-নাটক সম্পর্কে লেখা হয়, ‘বলতে দ্বিধা নেই সারা দেশের মঞ্চ নাটক এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত’। তিনি আরো বলেন, ‘মঞ্চ-মিলনায়তনের অভাব তো আমাদের নাট্যচর্চার পুরাতন সমস্যা। তারই সাথে যুক্ত হয়েছে দর্শক সংকট। মানুষকে নাটকের প্রতি আকৃষ্ট করাটাও এক সমস্যা।’ আতাউর রহমান লিখছেন, ‘দেশের নাট্যস্রোত এখন ভীষণ শীর্ণ, কালে-ভদ্রে ভাল নাটক প্রযোজিত হয়, সত্তর-আশির দশকের নাট্যচর্চার সে রমরমা দিনগুলো আজ পলাতক। নাট্য প্রযোজনার মান বর্তমানে নিম্নগামী, সুরুচি, নান্দনিক বোধ ও সুষ্ঠু নাট্য বুদ্ধির দুর্ভিক্ষ দেশের নাট্যাঙ্গনকে গ্রাস করেছে।’
নানা স্ববিরোধিতার মধ্যেই বাংলাদেশের নাটক বেড়ে উঠেছিল। স্ববিরোধিতার জন্যই তারা নিজেদের ঘোষিত বিশেষ কোনো একটি নাট্যধারাকেও চূড়ান্ত সাফল্যের জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। নাটক সম্পর্কে নিজেদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব থেকেই এসব ঘটেছিল। জনগণের নাটক বা শ্রেণীসংগ্রামের মতো মতবাদটিকে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে ব্যবহার করেছিল। দরকার মতো আবার সে অবস্থান থেকে সরেও দাঁড়িয়েছিল। মধ্যবিত্তরা এ ধরনের একটি নাট্য আন্দোলনে যতোখানি প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশে নাট্যকর্মীরা সেটুকু পর্যন্ত পারেননি। অথচ পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্তদের দ্বারাই ব্যাপক রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের সূচনা হয়, সে নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো শ্রমিক-কৃষকদের নিয়েই। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তরা যা পেরেছিল বাংলাদেশ তা পারেনি শুধুমাত্র স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় চরিত্রের অভাবে। মূল কথা হলো, নাট্যকর্মীদের শ্রেণীচরিত্র ও সমাজবিজ্ঞান চেতনার অভাব থেকেই এসব হয়েছে। নাট্যকর্মীরা যে মধ্যবিত্ত মানসিকতার মধ্যে বড় হয়েছেন, তার থেকে মুক্ত না হয়ে তাঁদের পক্ষে কোনো সুস্থ রাজনৈতিক আন্দোলন তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এই মানসিকতার দ্বারা তারা এমন নাট্য আন্দোলনে গড়ে তুলতে পারলো না যা মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতাকে পার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নাটক তাই সামনে আগাতে পারলো না বলেই পিছিয়ে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধারার সাথে মিশে গেল। নাট্য আন্দোলনের শেষ পরিণতি হলো সরকারের লেজুরবৃত্তি করা।