স্বাধীন খসরু

স্বাধীন খসরু

বাংলাদেশে থাকতে হলে চোখ কান মুখ তালাবন্ধ রাখতে হবে

স্বাধীন খসরু

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪

এবারের অমর একুশে বইমেলায় ড. আমিনুল ইসলামের লেখা ১০১ ইন্ট্রোডাকশন টু বাংলাদেশ বইটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশন। রায়হানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে। বাবা-মার কাছ থেকে সবসময় সে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা শুনে বড় হয়েছে। কিন্তু তার কখনো বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি। বাবা-মার ইচ্ছে, শেষ বয়সে তারা লন্ডনে থাকবেন না, দেশে ফিরে যাবেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছেন, রায়হানকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ যে বিদ্যাপীঠ, সেটাতে ভর্তি করাবেন। যে বিদ্যাপীঠ মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দুজনই পড়েছেন।

কারণ হচ্ছে, রায়হান যেন আগে থেকেই বাংলাদেশের জীবনধারার সাথে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বাবা-মার স্বপ্ন ও ইচ্ছেতে রায়হানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভর্তি করানো হয় তাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসল গল্প শুরু হয় এখান থেকেই। রায়হান লন্ডনে বেড়ে ওঠার সময় স্কুল-কলেজ বা রাস্তাঘাটে অনেক ধরনের বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যাওয়ার পর প্রতিনিয়ত যে ধরনের বর্ণবাদী আচরণ, অসঙ্গতি, বৈষম্য, আঞ্চলিকতা, হীনমন্যতা, সর্বক্ষেত্রে দ্বিচারিতা, তা কোনো—ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

মেলানোর চেষ্টা করছে বাবা-মায়ের দেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে সেই সুন্দর সুন্দর কথা। তাতে কোনো মিল নেই, আকাশ পাতাল তফাৎ। দেশে শিক্ষা, সাস্থ্য, ধর্ম আর রাজনীতি পুরোপুরি পুঁজিহীন ব্যবসা। সবকিছু সম্ভব যদি পেছনে বড় ভাই, মামা-চাচা থাকে। তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে এখন আর চিঠি লেখার অভ্যাস তেমন কারো নেই। মায়ের আবদার, বাংলাদেশের জীবনধারা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যেন মায়ের কাছে চিঠি লেখে। তাই রায়হান মাকে এক লম্বা চিটি লিখছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, অনিয়ম, সমাজের অসঙ্গতি, বর্ণ বৈষম্য ও দ্বিচারিতা নিয়ে।

খুব আগ্রহ নিয়ে আমি এই বইটি পড়ে শেষ করলাম এক সপ্তাহ আগে। আমার জীবনের সাথে অনেক মিল খুঁজে পেলাম। কারণ আমার জন্ম না হলেও আমার বেড়ে ওঠা লন্ডন শহরে। বড় হয়েছি মিশ্র সংস্কৃতি, মিশ্রভাষী, মিশ্র বর্ণের মানুষের সাথে। অনেকবারই বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছি। সব সময় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে ভয়ংকর বর্ণবাদ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ, যা চোখে দেখা যায় না, প্রমাণ করাও কঠিন।

আমার ইচ্ছেতেই কোনো এক সময়ে আমি লন্ডন থেকে ঢাকা চলে যাই। আমিও প্রতিনিয়ত এসব বাংলাদেশে দেখেছি, শুনেছি, কখনো কখনো প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা কি বদলানো সম্ভব? তেমন কারোরই কথায় বা কাজে কোনো মিল নেই। সবাই যেন স্বেচ্ছাচারী শিক্ষক। শুধু শুনতে হয়েছে না না না না। তুমি/আপনি কথা বলবে না, বুঝবে না। বুঝতে হবে এই দেশে এটা চলে না, এটা ইংল্যান্ড নয়, এটা বাংলাদেশ। আমরা এটা করি না, আমরা ওটা বলি না... শুধু আমরা আমরা, আমি আমি আমি!

যদিও ওই দলে আমি যুক্ত হতে পারিনি, তবে এটা বুঝতে পেরেছি, বাংলাদেশে থাকতে হলে চোখ কান আর মুখ একদম তালাবদ্ধ করে রাখতে হবে। যেমন দেখেও দেখিনি, শুনেও শুনিনি। কথা বলা যাবে না, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। শুধু শুনতে হবে বস্তা পচা গল্প, উপদেশ, দেখতে হবে দ্বিচারি মন-মানসিকতা আর দ্বিচারিসুলভ আচরণ।

ঢাকার ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। একবার বাংলামটর সোনারগাঁ রোড ট্রাফিক মোড়ে আমার গাড়ির চালক ভুল করে চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়। ট্রাফিক সার্জেন্ট আসলেন, চালকের লাইসেন্স কাগজপত্র চাইলেন। আমি কথা বলতেই, শুনতে হলো আপনাকে কিছু বলতে হবে না। তার আগে কিন্তু আমার চালকও আমাকে বলে দিয়েছে, স্যার আপনি কোনো কথা বলবেন না। যা বলার আমি বলবো।

দু’পক্ষই যখন বলেছে কিছু না বলতে, আমি দেখছি, চুপ করে বসে আছি। ট্রাফিক সার্জেন্ট কাগজপত্র দেখে আমাকে বললেন, আপনাদের মতো মানুষ কি করে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী একজন চালককে নিয়োগ দিতে পারেন। উনি কিন্তু আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছেন।

আমি বললাম, এক বছর ধরে সে আমার সাথে আছে। কতবার তাকে ট্রাফিক সিগনালে বা চেকপয়েন্টে থামতে হয়েছে। কাগজপত্র প্রতিবারই দেখাতে হয়েছে। আপনাদের ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স চিনতে যদি এক বছর লাগে, তো আমাদের মতো মানুষের কত বছর লাগা উচিত?

সার্জেন্ট লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছেন, চালককে বললেন আগামীকাল অফিসে যেতে। জিজ্ঞেস করলাম, তার লাইসেন্স নিচ্ছেন নেন কিন্তু আমার গাড়ির কাগজ নিচ্ছেন কেন? বললেন, গাড়ির কাগজ সাথে না নিলে সে অফিসে আসবে না। দাই লাইসেন্স নিয়ে যাচ্ছি।

চালকের সাথে আমার কথা হলো। কঠিন করে জিজ্ঞেস করলাম, লাইসেন্স ভুয়া কিনা। প্রতিবারই তার উত্তর, লাইসেন্স ভুয়া না। সে আমার এখানে আসার আগে বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করেছে। এরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়নি কোনো দিন। আমাকে বুঝালো, সার্জেন্ট টাকা খেতে চাচ্ছে। টাকা দিলে সে ঠিকই সব কাগজপত্র ফিরিয়ে দেবে। বললো, কাল অবশ্যই সে অফিসে যাবে। প্রমাণ করবে তার লাইসেন্স জেনুইন। আমাকে সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছে, স্যার আপনি চিন্তা করবেন না। কালকে আমি লাইসেন্স আর আপনার গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে আসতেছি।

সেই যে গেল, কাল আর কোনো দিন আসেনি। চালকও ফিরে আসেনি। পরে আমি নিজে বেইলি রোডে ট্রাফিক অফিসে গিয়ে কিছু টাকা জরিমানা দিয়ে আমার গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে আসি। জানতে পারি, ঘুষ দিয়ে এই ধরনের ভুয়া লাইসেন্স করা হয়, আবার ধরলে টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দেয়া হয়।

পরিশেষে ১০১ ইন্ট্রোডাকশন টু বাংলাদেশ বইটি পড়ার পর আমার শিশুসুলভ একটি আকাঙ্ক্ষা উৎপাত করছে মনের মধ্যে। যদি পারতাম এই বইটিকে বাংলাদেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা আর বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে। যদি পারতাম সকল নেতা-নেত্রী, শিক্ষক, ডাক্তার, সকল সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী এবং ধর্মব্যবসায়ীদেরকে এই বইটি পড়াতে। আফসোস!

লেখক: অভিনেতা

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
লন্ডন