বর্ধমানের জোড়বাংলা মন্দির

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত : এপ্রিল ২২, ২০১৯

অবিভক্ত বঙ্গদেশের কথা যদি ভাবি, তাহলে সারা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে, একেবারে পুরুলিয়া জেলা থেকে শুরু করে অধুনা বাংলাদেশের যশোর পর্যন্ত দেখা যায় অসংখ্য পোড়ামাটির মন্দির। বঙ্গদেশ পলিমাটির দেশ। সুতরাং এখানকার মন্দিরশিল্প যে পাথরের পরিবর্তে পলিমাটি দিয়েই গড়ে উঠবে, একথা বলা বাহুল্য।

বর্তমান বাংলাদেশের কথা এখানে বাকি থাক। এই বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলি। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলী, বীরভূম, ২৪ পরগণা ইত্যাদি প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি টেরাকোটা মন্দির গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরগুলি তার গঠনশৈলী ও টেরাকোটা টালির অনুপম কারুকার্যের জন্য দেশে-বিদেশে সম্মানলাভ করেছে, এ আমরা সকলেই জানি।

এই সব জেলার মন্দিরগুলির গঠনশৈলীতে নানান রীতি দেখা যায়। একরত্ন, পঞ্চরত্ন, রেখদেউল, পীঢ়া দেউল, একচালা, দোচালা ইত্যাদি। এই সকল প্রচলিত রীতির গঠন ছাড়াও টেরাকোটা মন্দিরের আরও একটি বিশেষ রীতি দেখা যায়, জোড়বাংলা। কাকে বলে জোড়বাংলা রীতি বা শৈলী?

সারা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই আছে বেশ কয়েকটি জোড়বাংলা মন্দির। বাংলার মন্দির নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন। তিনি জানাচ্ছেন, জোড়বাংলা রীতিটি অধুনা বাংলাদেশ, যশোর অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়, তবু সারা বাংলায় পুরুলিয়া থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত (অখণ্ড বাংলা) প্রায় সব জায়গাতেই এক বা একাধিক মন্দির আছে। সাধারণভাবে বাংলার সর্বত্র একচালা বা চারচালা রীতির মাটির গৃহ দেখতে পাওয়া যায়। দুইদিকে ঢালু ছাদ, মাঝখানটি উঁচু। সাধারণভাবে দেয়াল হয় মাটির, বাঁশ বা কঞ্চি অথবা খড়ে ছাওয়া ছাদ। দুই দিক থেকে ঢালু হয়ে নেমে আসায় মাঝখানটি মন্দিরের মতো উঁচু দেখায়। ছাদে যাতে জল না জমে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এই রীতিটিকে বলা হয় দোচালা বা একবাংলা রীতি। পাশাপাশি দুটি একবাংলাকে জুড়ে দিয়েই জোড়বাংলা। টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্যে যা অনন্য সাধারণ এক দৃষ্টান্ত।

বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর এলাকায় রয়েছে তেমনই একটি জোড়বাংলা মন্দির। বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর একসময় অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল। বর্ধমান রাজাদের প্রথম রাজগৃহটি এখানেই গড়ে উঠেছিল। কাঞ্চননগরের ছুরি-কাঁচিও বিশেষ প্রসিদ্ধ। রাজাদের প্রাসাদ, বড় বড় রাজকর্মচারীদের আবাস, মহাজনদের বাসস্থান সংলগ্ন অঞ্চলে মন্দিরও গড়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে মন্দিরটি ভগ্ন, অবহেলিত, অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে বর্ধমান শহরের বুকে প্রায় অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে আছে।

ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন তার বইতেও মন্দিরটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানাননি। শুধুমাত্র কাঞ্চননগরে একটি জোড়বাংলা মন্দির আছে, এইটুকুই উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান লেখক যখন এর হদিশ পান, তখন সেটি একটি গরুর গোয়াল হিসেবে ব্যবহৃত। চারিদিকে ঘুঁটের প্রলেপ, কাঠকুটো, ঘুঁটে ও খড় বোঝাই। মন্দিরটি যে এখন গরু-বাছুর বাঁধার জায়গা, বোঝাই যায়। গরু-বাছুরের প্রস্রাব ও গোবরে পরিপূর্ণ, দুর্গন্ধযুক্ত। চারিদিকে বাঁশ টাঙানো, সেখানে শতচ্ছিন্ন কাপড় মেলা।

মন্দিরটি কোন পরিবারের কার জায়গার উপরে অবস্থিত, কোনো কিছুর উত্তরই পাওয়া যায়নি। এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা, কিন্তু তিনিও এর কোনো জবাব দিতে পারেননি। এ ঘটনার প্রায় দুবছর পর গিয়েও একই অবস্থা দেখে এসেছি। তখন শুনেছিলাম, ‘বেঙ্গল হেরিটেজ’ এর দায়িত্ব নিয়েছে, সংস্কার হবে, কিন্তু তখনও সেই একই দুর্গন্ধযুক্ত, গরু-বাছুরের গোয়াল হিসাবেই দেখেছি।

কিছুদিন আগে আবার গেলেও, তার সন্ধান করতে পারিনি। বর্তমানে সেটি আছে, না সংস্কার সত্যিই হয়েছে জানি না। নাকি একেবারেই উধাও, তাও জানি না।