বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষার ইতিহাস

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মারাত্মক দুটি ত্রুটির একটি হচ্ছে, পরীক্ষাভীতি। আরেকটি হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যা। তিন নম্বর সমস্যার কথাটাও বলা দরকার, সেটা আসলে বাকি সমস্যার কারণ। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তৃতীয় ভয়াবহ দিকটা হলো বইয়ের বোঝা। যারা বলতে চাচ্ছেন, বর্তমান সময়ের বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম শিশুদের ওপর চাপ কমাবে এবং মুখস্থ বিদ্যা থাকবে না। পরীক্ষাও থাকবে না। বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম যদি সত্যিই শিশুদের ওপর লেখাপড়ার চাপ কমাতে পারতো এবং মুখস্থ বিদ্যা বাদ দিতে পারতো তাহলে কখনোই এই শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক হতো না।

শিশুদের ওপর পড়াশুনার চাপ কমানো গেলে এবং মুখস্থ বিদ্যার হাত থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করা গেলে বেশিরভাগ অভিভাবক খুশি হতেন। খুশি হতেন প্রকৃত শিক্ষাবিদরা। কিন্তু আসলে বিষয়টা তা হয়নি। বরং এই শিক্ষা কারিকুলাম পাঠ করে বুঝবার উপায় নেই যারা এটা প্রণয়ন করেছেন তারা আসলে কী চান। নিজেরাই তারা স্পষ্ট নন তারা আসলে কী বলতে চান। কথার মধ্যে রয়েছে নানা স্ববিরোধিতা। পরীক্ষা থাকবে না, এই কথাটা বোধগম্য নয়। পরীক্ষাভীতি দূর করা মানে পরীক্ষা বাতিল করে দেয়া নয়। পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি পাল্টানো। হতে পারে শিক্ষার্থী সম্পর্কে শিক্ষকরা সকলে নিজেদের কাছে একটি ধারণা তৈরি করে রাখলেন। বাংলার পাঠশালা শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষা বা টোলের শিক্ষায় বাৎসরিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু শিক্ষকের শিক্ষার্থীকে যাচাই করার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল।

জাতীয় শিক্ষাক্রমের বহর বিরাট। দাঁতভাঙা বাংলায় এমনভাবে লেখা, অনেক সময় মূলভাব অনুধাবন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাংলায় লেখা হলেও তার মাঝখানে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ও বাক্য। বুঝতেই পারা যায় অন্য কারো ইংরেজি থেকে বাংলা করা হয়েছে। কথার পর কথা সাজানো হয়েছে যা পাঠ করে কারো পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয় আসলে এই শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য কী, মূল লক্ষ্য কী। ঠিক আছে, সব কিছুর পরও ধরে নিচ্ছি এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষানীতি যা এ যাবৎকালে আর কেউ রচনা করতে পারেনি। ধরে নেয়া গেল, এই শিক্ষানীতির দ্বারা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে এবং রাষ্ট্র ইতিবাচক ফল লাভ করবে।

মূল বিতর্ক হলো, শিক্ষানীতি প্রয়োগ করার আগে কি বলা সম্ভব এর ফলাফল আসলে কী দাঁড়াবে? তবুও মানা যাক, এই শিক্ষানীতির ফলাফল শুভই হবে। কিন্তু এটা নিয়ে নাগরিকরা আলোচনা সমালোচনা করলে সঙ্কটটা কোথায়? এই শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? বিশ্ব সাহিত্যের এমন কোনো সেরা সাহিত্য আছে, যার সমালোচনা করা যাবে না? সাহিত্যকে কি ধর্মগ্রন্থ মনে করতে হবে? কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এই শিক্ষানীতি নিয়ে সংসদে আলোচনা করা হয়নি। তাহলে এটা প্রয়োগ করা হবে কিভাবে? কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এই শিক্ষানীতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে।

কৃষিমন্ত্রীর সমালোচনার কি সামান্য মূল্য নেই? তাহলে অন্যরা সমালোচনা করতে পারবেন না কেন? বর্তমান শিক্ষানীতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা বা অন্য কেউ কথা বলতে গেলেই ভয়ভীতি দেখানো বা হয়রানি করা হচ্ছে। কেন? যারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন তাদের দুর্বলতা তাহলে কোথায়? পৃথিবীর কোনো দেশের দলিলে বা বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও লেখা আছে, শিক্ষানীতির সমালোচনা করা যাবে না? বাংলাদেশের যারা এ শিক্ষানীতি রচনা করেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রমের নামে তারা কি কোনো ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছেন?

নাকি ধরে নিতে হবে, যারা এই জাতীয় শিক্ষাক্রম রচনা করেছেন তারা এতটাই বিজ্ঞ যে সব সমালোচনার ঊর্ধে? নাকি তারাই দেশের সবচেয়ে সেরা বিশেষজ্ঞ, যাদের সমালোচনা করার অধিকার কারোর নেই। বাংলাদেশে যারা শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেন, যাদের গবেষণা আছে এবং নিয়মিত লেখালেখি করেন তাদের সকলকে কি তাহলে এই শিক্ষানীতির ব্যাপারে মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে?

যারা কথায় কথায় এই শিক্ষানীতির পক্ষে বিদেশকে টেনে আনেন আমি সাধারণভাবে বুঝতেই পারছি না সেটার কারণটা কী? প্রথম প্রশ্ন: এই শিক্ষানীতির সঙ্গে বিদেশের কোন্ শিক্ষানীতির মিল আছে? বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ পাঠ করার পর বুঝেশুনে কি তারা এই কথা বলছেন? জাতীয় শিক্ষাক্রমের সবটা কি পাঠ করেছেন তারা? দ্বিতীয় প্রশ্ন: বাংলাদেশের শিশুদের জীবনমান কি সেই সব দেশের সমান যাদেরকে উদাহরণ হিসেবে টানা হচ্ছে?

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিদর্শনে গিয়ে একবার নিজে আমি দু’জায়গায় দুই শিশুর দেখা পাই। সেই শিশুদের একজনের বাবা গ্রামের চোর এবং অপর শিশুর মা দেহ বিক্রি করেন। যখন আমি না জেনেই শিশু দুটির কাছে তার বাবা-মা সম্পর্কে জানতে চাই, শিশু দুটি মাথানত করে রেখেছিল। যতক্ষণ আমি ছিলাম লজ্জায় মাথা তোলেনি। বাকি শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়ে হাসাহাসি করছিল। মমতাময়ী শিক্ষার্থী আমাকে পরে জানায় শিশু দুটি সম্পর্কে। বলেন, কতদিন এত অসম্মান নিয়ে এখানে পড়বে কে জানে!

শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য নীতিমালা লেখার আগে কতটুকু সব শিশুর পরিবেশ সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করেছি? বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে আমরা শিক্ষিতরা সবাই কি ভালোভাবে চিনি?প্রতিদিন শুনতে পাই, বাংলাদেশ নাকি ভিক্ষুক নেই। কিন্তু আমার বাসায় প্রতিদিন ভিক্ষুক আসে। ঢাকার গুলশানের মোড়ে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বহু ভিক্ষুক হাত পাতেন। কিন্তু আমরা ভিক্ষুক দেখতে পাই না। আমাদের কি চোখ আছে সবকিছু দেখার মতো?

বাংলাদেশের জন্য যাঁরা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবেন, তাদেরকে অবশ্যই ভারতবর্ষের আড়াই হাজার বছরের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বুঝতে হবে সঙ্কটের শুরুটা কোথায়। দুশো বছর আগেও বাংলার নিজস্ব শিক্ষাব্যব্যবস্থা ছিল পাঠশালা। ব্রিটিশ শাসনে সেই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়। ইংরেজদের লেখা থেকেই এসব জানা যায়। সেই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

তিনশো বছর আগেও বাংলার প্রতি তিনটা গ্রামের দুটি গ্রামে পাঠশালা ছিল। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হতো সেখানে, নিম্নবর্ণের সন্তানরা সেখানে পড়াশুনা করতো। মাদ্রাসা ও টোল শিক্ষার বিকল্প ধারা ছিল এটা নিম্নবর্ণের জন্য। শিক্ষকরা ছিলেন নিম্নবর্ণের। ফরাসি বিপ্লব তখনো হয়নি, না হয়েছে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের পরই ফ্রান্সে প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্ব পায়। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া  হয়। কারণ রুশোর তত্ত্ব মতো উচ্চশিক্ষা বাদ দিয়ে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব পায় প্রাথমিক শিক্ষা। বাংলায় তখন রীতিমতো খুব কার্যকর প্রাথমিক শিক্ষাই পাচ্ছে নিম্নবর্ণের ছাত্ররা।

কীভাবে সেই শিক্ষা ধ্বংস হলো ইংরেজ শাসনে সেটা না জানলে দেশের শিশুদের জন্য প্রকৃত শিক্ষানীতি চালু করা যাবে না। ভারতে ইংরেজদের শিক্ষানীতি কি ছিল? ইংরেজদের শিক্ষানীতি ছিল, ‘সবার জন্য শিক্ষা নয়।’ সাম্রাজ্যবাদী ভারতে এবং পরেও পাকিস্তানের শিক্ষানীতি ছিল, `উচ্চশিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষাকে নয়`। কারণ সকলে উচ্চশিক্ষার ভিতর দিয়ে তাদের দাসত্ব করার মতো কিছু আমলা পেতে চেয়েছিল। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চায়নি।

পাঠশালার কার্যকর শিক্ষাকে ধ্বংস করা হলো বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে। শিশুর ওপর অকারণ পড়াশুনার চাপ বাড়িয়ে দিয়ে। ভদ্রলোকেরা চাইছিল না নিম্নবর্ণের মানুষেরা আর অক্ষরজ্ঞান লাভ করুক। কারণ শিক্ষা পেলে ভদ্রলোকদের তারা আর মানবে না। কলকাতা শহরের নিম্নবর্গের বটতলার সাহিত্যে বাবুদের নিয়ে খুব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হতো। বাবুরা তাঁদের একপ্রকার ভয় পেতেন। সেই নিম্নবর্গের সন্তানরা যদি ফের আবার লেখাপড়া করে তাহলে চাষাবাদ ছেড়ে দেবে। ভদ্রলোকেরা তাহলে তো আর তখন নিজেরা নিজের জমিতে লাঙ্গল দিতে পারবে না।

শিক্ষানীতি তৈরি তাই কোনো গালগল্প নয়। দম্ভ করার ব্যাপারও নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট কোথা থেকে কিভাবে শুরু হয়েছে সেটা আগে অনুধাবন করতে হবে। বিদেশের দিকে তাকাবার আগে আমাদের কী সম্পদ ছিল সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। তিনশো বছর আগে বাংলায় পাঠশালা শিক্ষা চালু হয়েছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। চন্ডীদাস পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করেই কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক