বটগাছ, গ্রামোন্নয়ন এবং রাজনীতি
অমিতাভ পালপ্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৮
গ্রামের হাটের পাশে একটা বটচারার জন্ম হলো। গ্রামের সবাই খুব খুশি। গাছটা বড় হলে ছায়া দেবে, হাটুরেরা একটু শান্তি পাবে এর তলায় আশ্রয় নিয়ে, দূর থেকে গ্রামটাকে চেনা যাবে এই বটগাছটা দিয়েই। ফলে গ্রামের সবাই বটচারাটার বেড়ে ওঠার ব্যাপারে সচেষ্ট হলো। সবাই একে নজরে নজরে রাখে। ছোটরা সারাদিন পাহারা দেয় গরু ছাগল যাতে পাতাটাতা ছিঁড়ে না খায়। আর বয়স্করা গাছটার গোড়ায় জল দেয়, শুকনা গোবর দেয়, ইউরিয়া দেয় যাতে গাছটা বাড়ে তরতর করে। সবার আশা, সবার প্রত্যাশা, সবার সব ভবিষ্যত এখন গাছটাকে ঘিরেই। ফলে গ্রামের ঘরে ঘরে রান্নায় লবণের ঘাটতি দেখা গেল। ছেলেপিলেদের দাঁত হয়ে গেল হলুদ আর নোংরা জঞ্জাল জমলো যত্রতত্র। জমি ভরে উঠলো আগাছায়। শুধু সপ্তাহে দু’দিন যে হাটটা বসতো, এখন সেটা প্রায় প্রতিদিনই বসে। কারণ বটচারাটাকে নজরে রাখতে সবাই দুপুরের ভাত কোনোরকমে পেটে চালান করেই হাজির হয় হাটে। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নজরদারি। ভবিষ্যতের জল্পনা আর দড়ি দিয়ে একটু পরপর মেপে দেখে গাছটা বাড়লো কতটুকু।
পাঠক, চলুন এখন আমরাও বটচারাটার বড় হওয়ার অপেক্ষা করি।
দুই.
তারপর একদিন প্রাকৃতিক নিয়ম ও গ্রামবাসীদের নজরদারির ফল হিসাবে বড় হলো বটগাছটা। এখন সে অনেকটা জায়গাজুড়ে ছায়া দেয়। থাকার জায়গা দিয়েছে নানা গৃহহীন পাখি এবং পোকামাকড়কে। দড়ি ঝুলিয়ে দোলার সুযোগ করে দিয়েছে গ্রামের ছেলেপিলেদের আর হাটুরেদের দিয়েছে ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার বিলাসিতা। গ্রামবাসীরাও এইসব প্রাপ্তির কল্যাণে বটগাছটাকে শুধু ভালোই বাসে না, ধর্মীয় নম্রতার দৃষ্টিতেও দেখে।
দিন যায়, বটগাছটার প্রভাবও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে গ্রামবাসীদের মনে। এখন তারা বউ কিংবা গুরুজনদের কথার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করে বটগাছটাকে। নিজেদের বিভিন্ন প্রতিজ্ঞায় সাক্ষী মানে তাকে। ফলে গ্রামের যারা মাতব্বর কিংবা জনপ্রতিনিধি ছিল এতকাল, সবকিছুতেই নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত ছিল, তারা পড়লো মহা ঝামেলায়। বটগাছটা হয়ে উঠলো তাদের পরম শত্রু। আর এই শত্রুকে পরাজিত করে নিশ্চিহ্ন করতে তারা বাঁধলো জোট। রটিয়ে দিল, বটগাছটায় বাসা বেঁধেছে খুব বিপদজনক ধরণের একটা ভূত।
রটনাটা প্রথমে খুব একটা পাত্তা পেলে না। সহজাত যুক্তির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। ফলে তার কেন্দ্রীভূত শক্তি গেল কমে এবং ছোট টুকরাগুলি সুপ্ত বীজের মতো কোনোরকমে পড়ে রইলো অবহেলার মাটিতে। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেল রটনার ভেঙে যাওয়া ছোট টুকরাগুলি জায়মানতার গন্ধ পাচ্ছে নিজেদের শরীরে। কারণ গ্রামবাসীদের সহজাত যুক্তিবোধ চিন্তার সাহায্য না পেয়ে আর এগোতে পারেনি এবং হয়ে গেছে একটা বদ্ধ জলার মতো অসহায়। এখন সেখানে কেবল পাঁক আর দুর্গন্ধ— লোকজন এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে জলাটাকে। সুযোগটাকে পেয়ে রটনাকারীদের জোট আবার চাঙা হয়ে উঠলো। রটনার ভেঙে যাওয়া ছোট টুকরাগুলি নিজেদেরকে সম্মিলিত করে আবার বানিয়ে তুললো রটনার ভাস্কর্য। আর যুক্তির ধারা হারিয়ে ফেলা গ্রামবাসীরা নিজেদের মাথা নুইয়ে দিল সেই বিরাট ভাস্কর্যের কাছে।
এখন বটগাছটা ভুতুড়ে, হাটটা তার থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছে। বটের ছায়া তার সবটুকু হাত বাড়িয়েও স্পর্শ করতে পারে না হাট কিংবা হাটুরের দলকে। ছেলেপিলেদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে দড়ি ধরে ঝোলার আনন্দ। এখন আবার মাতব্বর কিংবা জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার ভূমিকা ফিরে পেয়েছে, এখন আবার তাদের বাড়ির উঠানে জমে ভুক্তভোগীদের ভিড়। এখন আবার তারা দাপটভরা।
তিন.
নিঃসঙ্গতায় ঝিম মেরে আছে বটগাছটা। আর স্বপ্ন দেখছে আবার সেই দিনগুলি ফিরে পাওয়ার। কিন্তু কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে? হঠাৎ দেখা গেল, ভরসা দেয়ার লোক এসে গেছে। সে এই গ্রামেরই এক তরুণ, যে পড়তে গিয়েছিল শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখন ফিরে এসে মনযোগ দিতে চাইছে গ্রামসংস্কারে। প্রথম কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরেই সে টের পেয়ে গেল বটগাছটাকে ঘিরে চলছে গ্রামের রাজনীতি এবং সংস্কারের জন্যও কাজে লাগাতে হবে এটাকেই। এরজন্য সে জোগাড় করলো নতুন সময়ের গন্ধ পাওয়া কিছু তরুণকে এবং তাদের লেলিয়ে দিল এতদিন ধরে একা পড়ে থাকা বটগাছটার গোড়া পরিষ্কার করার কাজে।
বটগাছটা এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এর তলায় বসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ তার সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনা করে, পরিকল্পনা করে এবং অন্যদেরও ডাক দেয় তার জমায়েতে। তার দুইটা উদ্দেশ্য— বটগাছে ভূত নেই এটা প্রমাণ করা এবং বটগাছটার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অন্যদের সহজ করে তোলা। তার এই উদ্যোগে গ্রামবাসীদেরও মনে পড়ে গেল অতীত দিনগুলির কথা এবং তারাও আবার আগ্রহী হয়ে উঠলো বটগাছটার বিভিন্ন অনুষঙ্গের প্রতি। আবার গমগম করে উঠলো হাট, ছেলেপিলেরা দোল খেতে লাগলো শরীর জুড়ানো বাতাসে, ছায়া হয়ে উঠলো আরো ঘন ও সুশীতল। বিষয়টা ভাবালো মাতব্বর ও জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু জনজোয়ারে ধসে গেল তাদের জোট এবং রাতের অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণটির কাছে তারা এলো আপোষরফার জন্য। তরুণটি জানতো গ্রাম সংস্কারে এদের সাথে পাওয়া জরুরি, তাই মাতব্বর ও জনপ্রতিনিধিরাও তার থেকে পেল আশ্বাস।
বটগাছটার ছায়ায় এখন গ্রামসংস্কারের অফিস। সারাদিন তাতে তাবেদার ও ভুক্তভোগীদের ভিড়। হাটও সপ্তাহের প্রত্যেকদিন রমরম করে। তরুণের এখন দম ফেলার ফুরসত নাই।
চার.
হঠাৎ দেখা গেল বটগাছটা ভরে গেছে কাকের বাসায়। সারাক্ষণ তাদের ঝগড়া ও চিৎকারে এলাকা সরগরম। সেইসাথে ভুক্তভোগী ও তাবেদাররাতো আছেই। তবে কাকেরা শুধু চিৎকার আর ঝগড়াতেই থেমে নেই— তারা যেকোনো সময় হামলা চালায় হাটে, তুলে নেয় মাছ ও বিভিন্ন খাবার দাবার, অতিষ্ট করে তোলে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই দলকেই।
এদিকে বটগাছটার পিছন দিকটায়, যেদিকে প্রাকৃতিক প্রয়োজনেই যায় মানুষজন, দেখা গেল সেখানে পড়ে থাকছে বিভিন্ন গৃহপালিত জন্তুর ভুক্ত-অভুক্ত দেহাবশেষ। এর কারণ অনুসন্ধানের কোন প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করলো না কেউ। ফলে বটগাছের ভূতের গল্পটা আবার জেগে উঠলো রমরমিয়ে। তবে গ্রামসংস্কারের অফিস ঘরটা থাকায় এবার আর পরিত্যক্ত হলো না বটগাছটা। বরং ভূত, কাক আর সমস্ত উপদ্রব নিয়ে সে আরো জাঁকিয়ে বসলো গ্রামবাসীদের যুক্তিহীন অন্ধকার মনের গভীরে। এখন গ্রামবাসীরা ভূতকে মানে, কাককে ট্যাক্স দেয় আর সবকিছু হারিয়ে ফেলা মানুষের মতো মাথা নিচু করে হাঁটে।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সেই তরুণ, যে গ্রাম সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল গ্রামবাসীদের— মাতব্বর আর জনপ্রতিনিধিদের বাড়ির কাচারিঘরে বসে দেদার চা-সিগারেট খায় এবং নতুন নতুন পরিকল্পনা করে গ্রামোন্নয়নের।