বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও রিফাত চৌধুরীদের ফরিয়াদ
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০১৯
লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
বাংলা ভাষাতে আমি সবচেয়ে বেশি পড়ি, শুনি, বুঝবার চেষ্টা করি রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুকে। এ দুজনকে নিয়ে আমরা আলটপকা এটা ওটা বলে ফেলি। কারণ হুজ্জতি ও হিকমত উভয়তো দুজনই আমাদের ঘরোয়া ইশ্বরকনিকা। দৈনন্দিন আলটপকা থেকে নান্দনিক সুখবোধ্য মাপে এ দুজনকে নিয়ে আসতে হলে ব্যাপক পরিশ্রম দরকার, যা আমরা অনেকে করতে চাই না। আমার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ সংগ্রহ, বাংলা ভাষাপ্রমিতের নোম্যান্সল্যান্ডে বাংলা ভাষা অংশে আলোচনা করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের তাশের দেশের বিভিন্নভাষি মঞ্চায়ন, বাংলা ক্রিয়াপদের বিবর্তন, বাংলা ভাষার হুমকি। তৃতিয় অংশটি বেশ আগে বিডি, আর্টসে অন্যান্য লেখকদের সাথে আমার সাক্ষাতকারের অংশ, যেখানে উল্লেখ করেছিলাম, `বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন... আঞ্চলিক, কথ্য, শুদ্ধ, অশুদ্ধ তর্কের উর্ধ্বে মিথে পরিণত হয়।` (বাংলা ভাষাপ্রমিতের নোম্যান্সল্যান্ড, পৃ-৪৮)।
সতির্থ কবি বন্ধু রিফাত চৌধুরী তার আনুষাঙ্গিক আপন বলয়ে যেরকম তুমুলভাবে প্রিয়, সেরকম আমার কাছেও প্রিয়। কিন্তু তার সব বক্তব্যের সাথে, সেগুলোর ধরনধারনের সাথে সবসময় একমত হতে পারছি কই? বিশেষ করে কিছু বক্তব্য যখন বিভ্রান্তির সুজোগ করে দেয়! নিচে রিফাতের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য পড়া যাক, যাতে হরেদরে কয়েকশো লাইক পড়েছে। রিফাত লিখেছে, `জসীমউদ্দীন স্যারের কাছে বাংলা টিউশন পড়তাম। বাংলায় ওনার অগাধ জ্ঞান। সে প্রায় অনেকদিন হলো। বাংলা ভাষা যে ক্রমে মাজা-টাজা ভেঙে গিয়ে কালের গর্তে পড়ে গিয়ে প্রবল হাঁকুপাকু করেও আর ওঠার ক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না, তা আমরা বহুকালেই জানি। এমনিতেই বাঙালির কাছেই চিরকালই ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারাটা অন্যতম প্রধান প্রার্থিত গুণ। সেটি অবশ্যই অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু সমস্যাটি ইংরেজিকে আপন করতে চাওয়ার থেকেও অনেক বেশি লুকিয়ে আছে বাংলাকে কোঁৎ মেরে মেরে ভুলতে চাওয়ায়। এমন একটি জাত, যার পশ্চাদদেশে আচমকা লাথি মারলেও সে বলে ওঠে, ‘শিট’! এই স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম! তুমিই বলো বঙ্গবন্ধু!`
ওপরের বক্তব্যের শুরুতে স্যার, টিউশন ইংরেজি শব্দ, শিট যেরকম। ইংরেজ, এমেরিকান, কানাডিয়ানরাই এখন আর সম্বোধন অর্থে স্যার ব্যবহার করে না, কখনো সখনো বিদ্রুপ অর্থে ব্যবহার করে। মোঘলের কাছ থেকে আমরা ওস্তাদ পেয়েছি, ইংরেজ থেকে স্যার, পণ্ডিতকে আমরা অভিমানবশত হিন্দু শব্দ বলে পরিহার করে চলেছি। ইংরেজ, এমেরিকান কিন্তু এখন তাদের শিক্ষকদের নাম ধরে বলে, কিম্বা বলে প্রফেসর অমুক, তমুক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিল, আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে... ধরে নিতে পারি, ইংরেজ রাজ দরবারের দেয়া নাইট খেতাবের স্যার সম্বোধনটি আমাদের রিফাত তার প্রিয় শিক্ষক বা পণ্ডিত বা ওস্তাদকে রবীন্দ্র আহ্বানে বলিয়ান হয়েই বজায় রাখছে! রিফাত যখন কিছুদিন আগে হাত ভেঙে আমার ঘরের কাছে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য থেকেছে, তখনতো তাকে ঢাকা মেডিকেলই বলেছে! টিউশন শব্দের সামাজিক দৌরাত্ম তো ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়াবহ, সেটা নিয়ে আর বাড়ালাম না! তবে প্রসংগটি নিচে আরো বিস্তারিত করলাম।
বিশ্বে জনসংখ্যা চিনাদের সবচেয়ে বেশি, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ইংরেজি। এটা শুধু উপনিবেশিক কারনে নয়, কারন ইংরেজ সবার থেকে নিয়ে তার শব্দভান্ডার অনবরত বাড়িয়ে চলেছে। ইংরেজির তুলনায় বাংলার শব্দভান্ডার চার ভাগের এক ভাগ। ইংরেজি শব্দ ভান্ডার বেশি হওয়াতে আমরা ইংরেজি শব্দ বলি তা নয়, আমরা অনেক সময় চালু বাংলা শব্দকেও অনভ্যাসে, অলসতায় ভুলে যাই, মুখে বা লেখায় চলে আসে স্যার, আঙ্কেল ইত্যাদি। ইংরেজের লিখিত কোনো ভাষাই ছিল না, সে তার ইতিহাস পড়েছে ইটালিয়ান ল্যাটিনে, বিপুল শব্দভান্ডার নিয়েছে ইটালিয়ান, ফরাসি ও পরে ভারতিয় ভাষা থেকে। ইংরেজের চালু মার্জনাসূচক শব্দ পার্ডন ফরাসি শব্দ, আর অচালু বনেদি শব্দ সেরেন্ডিপিটি এসেছে ভারতিয় স্বর্নদ্বিপ থেকে। এরকম হাজারো শব্দ যাদের আমরা পাবো ইংরেজের অভিধানে তা এসেছে বিদেশি ভাষা থেকে। ইংরেজ এখানে জাত্যাভিমানের তোয়াক্কা করে নাই, কে কবে তাদের রোমান উপনিবেশের যাতাকলে হাজার বছর বেধেছিল তার ঐতিহাসিকতা বিচারের পরেও রোমানদের শব্দ, আচার নিয়েছে কাড়ি কাড়ি।
অন্য ভাষায় লিখলে, পড়লে, বললে নিজের ভাষার ভান্ডার কমে না, বাড়ে। ফরাসিদের প্রিয় কবি আপোলিনেয়ার কৈশোর অব্দি পোলিশ ভাষাতে কথা বলতো। আইরিশদের অন্যতম নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট তার নোবেল বিজয়ি গডোর প্রতিক্ষা নাটকটি প্রথমে লিখেছিল ফরাশি ভাষায়। স্প্যানিশ আধুনিক লেখালেখির পুরোধা জিমেনেথ বাংলা জানতো না, গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছিল ইংরেজি থেকে, সে অনুবাদ নিশ্চিতভাবে যথেষ্ট মর্মগ্রাহি হওয়াতে তা নেরুদাকে নিবিড়ভাবে প্রভাবিত করে। পাঞ্জাবি আবু সাইয়িদ আইয়ুব, অহমিয়া ভুপেন হাজারিকা বাংলা চর্চা করে তাদের ভাষাকেও সমৃদ্ধ করেছিল। আমরা এটা ওটা ইংরেজি, বাংলা মিশিয়ে কথা বলি, লিখেও ফেলি, কিন্তু আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের দারিদ্রের কারন আমাদের সাহিত্যিকদের দ্বিভাষি দারিদ্র, ফলে আমাদের পাঠও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান কোনরকম বিগট্রির ধার না ধেরে পাইকারি নিয়েছে ল্যাটিন, গ্রিক, সংস্কৃত থেকে। একটা স্থানিয় ভাষায় একটা পর্যায় অব্ধি আদিরস, পয়ার, স্যাটায়ার, ছড়া মুখেমুখে বা লিখে ছড়ানো যায়, কিন্তু তা থেকে ব্যাপকতর সাহিত্য হয় না। দ্বিভাষিক দুর্বলতায় আমাদের কবিতা, নাটক, সঙ্গিত, চারুকলা সবই দুর্বল থেকে দুর্বলতরো হচ্ছে, যেটা আর হাততালির শব্দে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। আর নতুনেরা বা প্রতিষ্ঠিতরা বা জনপ্রিয়রা প্লাজিয়ারিজম বা টুক্লিফাইও করছে ভাষাগত দুর্বলতা থেকে। কিছুদিন আগে একজন জানালো, কে য্যানো বাজারে `রিমান্ড, রিমান্ড` বলে একটা স্যাটায়ার ছেড়েছে, যা পড়তে আমার `জুলেখার জেরা পর্বের` মতো।
এবার বঙ্গবন্ধুর কাছে রিফাতের ফরিয়াদ প্রসঙ্গে আসি। এ ফরিয়াদ যে আন্তরিক এবং তার সাথে কোনো একাডেমির কর্নধার হবার স্বার্থবোধ জড়িত না তাও আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালির স্বাধিনতা, পরিচয়, ভাষা ও চেতনার বিস্তার চেয়েছিলেন, সংকোচোন নয়, সেখান থেকেই ৭২ এর সংবিধান। ৭ মার্চের ভাষন শাব্দিক বিন্যাসের দিক থেকে শুনলে বা পড়লে আমরা পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু বলছেন এসেম্বলি, ন্যাশনাল এসেম্বলি, একবারও সংসদ বলেন নাই। এছাড়া একই ভাষনে ভোট, মার্শাল ল’, মেজরিটি পার্টি, টেলিফোন, রেল, লঞ্চ, সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্ণমেণ্ট, টেলিভিশান, নিউজ ব্যবহার করেছেন। ওই শব্দগুলো ইংরেজি শব্দ না কি লাটিন, না কি ফরাসি তা নিয়ে ব্যাকরনগত আলোচনা হতে পারে, কিন্তু যা আলোচনার উর্ধ্বে উঠে মিথে পরিনত হয়েছে। তার মোদ্দা কথা হলো, ৭ মার্চের ভাষন আবশ্যকিয়ভাবে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির ম্যাগ্নাকার্টা, এ ভাষনের প্রত্যেকটি শব্দ উচ্চারিত বাংলা ভাষা। বিদেশি শব্দ এখানে আর বিদেশি থাকে না, রুপান্তরিত হয় আত্মস্থ ওঙ্কারে, অহংকারে:
কথ্য অকথ্য যন্ত্রণার জ্যমিতিপাঠ শেষে
গৃধ্রকুট পাহাড়ের পাদদেশে
নেমেছিল গোপনীয়তায় গোমরানো লাভা
৭ মার্চ ১৯৭১ আম্মার উঠানে মুজিবের সভা
যারা এসেছিল তারা স্বাগত
যারা আসেনি তারা বিগত
(রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ/সনেট ২২/চয়ন খায়রুল হাবিব)
মোদি দঙ্গলের অন্তরমুখো বর্নাশ্রমের প্রতিক্রিয়াতে আমরাও কি বাঙ্গালিয়ানাকে কুপমন্ডুকতায় নিক্ষেপ করবো? জানা দরকার যে, পশ্চিমের ১৫ বছর বয়সিরা এখন যে দ্বিভাষি পারঙ্গমতা অর্জন করছে, বিশ্ব সাহিত্যে স্কুলে যাদের পড়ছে, আমাদের স্নাতোকোত্তর পর্জায়েও ততটুকু পড়া হচ্ছে না। পরাজিতের অভিমান, আক্ষেপ আমাদের মানায় না। ১৯৭১ আমাদের বিজয় ও বিস্তারের। আঠারো ও উনিশ শতকের বাঙালির রেনেসাকে বিসর্জন দিলে আমাদের অপরাপর অর্জনগুলো আরো পেছাবে।