বই কেন্দ্রিক সামাজিকতার জাগরণ জরুরি
এস এম মুকুলপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৮
মানসিক প্রশান্তির জন্য বই সর্বোত্তম বন্ধু। শব্দহীন নির্মল বিনোদনে বই-ই হতে পারে একমাত্র সহচর। সন্তানেরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লে আমাদের সমাজে অনেক অভিভাবক রাগ করেন। তাদের ধারণা, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। বইয়ের বিকল্প শুধু বই-ই হতে পারে। এক সময়ে মানুষ অবসর কাটাতো বই পড়ে। গল্প-গুজবে, আড্ডায় ছিল কবিতা আর গল্পের চরিত্র নিয়ে মুখরতা। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সব। প্রযুক্তির অবগাহনে বই পড়ার জায়গা টেলিভিশন, কম্পিউটার আর স্মার্ট ফোন কেড়ে নিয়েছে। তা’বলে কী বইয়ের চাহিদা কম্পিউটার, মোবাইল বা টেলিভিশন দ্বারা পূরণ করা সম্ভব? ভেবে দেখার উপযুক্ত সময় এখন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সর্বোত্তম জায়গা পরিবার। সেখান থেকেই তৈরি হওয়ার কথা বইপড়ুয়া প্রজন্ম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে আমরা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এ সুযোগে অপসংস্কৃতির ভর আমাদের মননে ভাঙন শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে ফুলেফেঁপে উঠছে অস্থিরতা। শূন্যতা, হাহাকার ধ্বংস করতে বসেছে আমাদের সৃজনী-ক্ষমতা আর মানবিক মূল্যবোধকে। আমরা অনেকভাবেই নিজেদের পরিবারের মাঝে বই পড়া, সংগ্রহ করা এবং বই উপহার দেয়ার রীতি চালু করতে পারি। সামাজিক কোনো প্রতিক্রিয়ার দিকে না তাকিয়ে আমরা ঘর থেকেই শুরু করবো বই পড়া আন্দোলনটি। প্রথমে পরিবারের সদস্যদের বিয়ে, জন্মদিন, বিশেষ সাফল্য অর্জন, বিদেশযাত্রা, বিশেষ দিবসে অন্য গিফটের পরিবর্তে বই কিনে দিতে পারি। সামাজিক কারণে আমরা বিয়ে বা জন্মদিনে দাওয়াতে বিশেষ কিছু উপহার দিয়ে থাকি। আমরা যদি এসব ক্ষেত্রে বই উপহারকে বেছে নিই তাহলে এটাও একটি চর্চা চালু হবে। সমাজে এ প্রচলন ছড়িয়ে দিলে সারা দেশব্যাপী বই পড়া আন্দোলন জোরদার হবে, সন্দেহ নেই। ঘড়ে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হবে পারিবারিক পাঠাগার। আর এর মাধ্যমে মেধায়, মননে ও সৃজনশীলতায় আমাদের প্রজন্ম গড়ে উঠবে পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে। বইয়ের প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। বিশেষত আমাদের শিশু-কিশোরদের মাঝে শৈশব থেকেই এ বোধ জাগিয়ে দিতে হবে। কারণ বিদ্যালয়ে যে পুঁথিগত জ্ঞান শিশু-কিশোরেরা লাভ করে তাতে মেধার তেমন বিকাশ ঘটে না। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। আমরা অনেকভাবেই নিজেদের পরিবারের মাঝে বই পড়া, সংগ্রহ করা এবং বই উপহার দেয়ার রীতি চালু করতে পারি।
সারা বছরের উপহারের জন্য বই কিনুন। নিজে পড়ার জন্য বই কিনুন।
পারিবারিক সদস্য ও প্রিয়জনদের জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী, ভালো ফলাফলে, সাফল্যে-সন্তুষ্টিতে, ঘরোয়াভাবে সৃজনশীলতা ও মেধা প্রতিযোগিতার আয়োজনে অনুপ্রেরণা যোগাতে পুরস্কার হিসেবে বই দিন।
প্রবাসী স্বজনদের জন্য বই উপহার পাঠান। তারা দেশে এলে অথবা দেশের স্বজনদের মাধ্যমে বেশি বেশি বই কিনুন।
বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য উপহারের পাশাপাশি বই উপহার দিন। এখন গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা ছাড়াও রান্না, পুষ্টিতথ্য, স্বাস্থ্য সচেতনতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-চর্চা, ধর্ম-দৃষ্টিভঙ্গীসহ অনেক বিষয়ভিত্তিক বই প্রকাশিত হচ্ছে। যা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
শিশু-কিশোরদের জন্মদিনে খেলনা, মোবাইল ও ট্যাবের বদলে বই দিন। এতে তার মননশীলতা বৃদ্ধি পাবে। সুন্দর জামা-কাপড়ের পাশাপাশি সন্তানের হাতে পোশাকের মতোই প্রয়োজনীয় মনে করে বই তুলে দিন।
সমাজে যারা বিত্তবান, তারা নিজেদের ও স্বজনদের পরিবারে বেশি বেশি বই উপহার পাঠান। প্রত্যেকের নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার গড়ে তুলুন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বনভোজনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে গৃহসামগ্রীর বদলে অনুগ্রহ করে বই দিন।
বাণিজ্যমেলার মতো বইমেলার জন্যও পারিবারিক বাজেট রাখুন। আপনার সংসারের প্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রীর চেয়েও সন্তানের মানবীয় বোধের জাগরণে বই পড়া খুবই জরুরি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও বিশ্লেষক