ফৌজিয়া সামিরের গল্প ‘ঝগড়াটে বুড়ি’
প্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২৪
কিপটে বুড়ি, আমি আর কাজ করবো না তোমার বাড়িতে । হাড়-মাস জ্বালিয়ে খেল, নতুন বছরে দুশো টাকা মাত্র বোনাস চাইছি, তাও দেবে না ! ওই টাকা নিয়ে তুমি কি স্বর্গে যাবে? তিন কূলে তো কেউ নেই? কী করবে ওই টাকা দিয়ে তুমি!
দরকার হলে, রাস্তার ভিখিরিদের দান করে দেব, তবু এগারোশো টাকা মাইনের এক পয়সা বেশি পাবি না, এই বলে রাখলাম।
এই শেষ, নাক-কান মুললাম, তোমার বাড়িতে যদি আর কাজে আসি তবে নাম বদলে দিও। চললাম আমি।
এই নিয়ে প্রায় বার চল্লিশেক কাজ ছেড়েছে টুম্পা। প্রত্যেক বারই আর না আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে চলে গেছে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর, খুব বেশি হলে দুপুর ছেড়ে বিকেল, এই হলো তার রাগের সীমারেখা। বহু চেষ্টা করে একবার সন্ধে ছয়টা অবধি আসেনি সে। কিন্তু সাড়ে ছয়টায় মৃণালিনী দেবীর একটা ওষুধ আছে। তাই আবার সে ছুটতে ছুটতে গ্যাছে। ওই ওষুধ না খেলে বুড়ি সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারবে না।
মৃণালিনী ভবনের এই মস্ত প্রাসাদের মতো বাড়িটার বিশাল গেটটা ঠেলে প্রতিদিনের মতো ভিতরে ঢোকে টুম্পা। তার শরীরে সকালের ঝগড়ার কোনো রেশ নেই আর। ঘরে ঢুকেই একেবারে দিদিমনির কায়দায় শাসন শুরু করে দেয় সে, এই বুড়ি, দুপুরে খেয়েছো?
না খেয়ে কি তোর জন্যে বসে থাকবো মুখপুড়ি? আসতে এত দেরি হলো যে? সিরিয়ালের প্রথম পার্টটা তো হয়েই গেল।
সে হোক গে, ওষুধ খেয়েছো?
না।
দেখলে, একদিন একটু দেরিতে এসেছি অমনি অনিয়ম শুরু।
এই, মেলা জ্ঞান দিস না তো। বকবক না করে মুড়ি-চানাচুরটা মেখে নিয়ে আয় দেখি। কুচি কুচি করে পিঁয়াজ দিস আর হ্যাঁ, একটা কাঁচা লঙ্কা চিরে আনবি।
খালি হুকুম আর হুকুম । এই নাও ওষুধ, গিলে আমায় শান্তি দাও।
হুম, আমি গেলে তুই তো শান্তিই পাস। বুড়ি মরলে তোকে দেখবে কে রে মুখপুড়ি?
ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, আমাকে দেখার লোক অনেক আছে।
কেন রে, প্রেম টেম করছিস নাকি? বলিস নি তো!
থামবে তুমি?
চলতে থাকে তাদের আবোলতাবোল বকবক। প্রতিদিন প্রায় এভাবেই সন্ধে কাটে দু’জনের। দিন শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে, শেষও হয় ঝগড়া দিয়ে। মাঝে লেগে থাকে একরাশ অভিমান, আবদার, অভিযোগ আর খুনসুটি। দুজনের বয়সের পার্থক্য কম করে হলেও পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে। অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, দুই বান্ধবী বসে ছেঁড়া পুতুলের মুণ্ডু নিয়ে ঝগড়া করছে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! দুজনের ভাগ্য বোধহয় ঈশ্বর একই কলমে লিখেছিলেন। টুম্পার স্বামী বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাকে ছেড়ে সৌদি আরব চলে যায়। আজ প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে আর ফেরেনি। কয়েক বছর হলো টুম্পা অপেক্ষা করাও ছেড়ে দিয়েছে। উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে `গুতেল মুন্সি` নামের এক দূর সম্পর্কের কাকু তাকে কলকাতায় নিয়ে আসে মাত্র দুই বছর বয়সে। তাই উত্তর প্রদেশের গ্রামের বাড়ি অথবা তার নিজের মা-বাবার মুখও মনে নেই তার। এবং না থাকাটাই স্বাভাবিক।
গুতেল মুন্সি মদ খেয়ে খেয়ে নিজের শরীরটাকে শেষ করে ফেলেছিল। তাই কেউ আর তাকে কাজে নিতে চাইতো না। খুব ছোট বয়স থেকেই এর ওর বাড়িতে কাজ করে, দু’দুটো পেট চালাতে হতো টুম্পাকে। তারপর হঠাৎ একদিন রাত তিনটের দিকে খবর এলো তার ভিটেমাটির একমাত্র সাক্ষী, তার ওই গুতেল কাকু মদ্যপ অবস্থায় লরির নিচে পড়ে পার্থিব কষ্ট থেকে মুক্তিলাভ করেছে। খুব কেঁদেছিল সেদিন টুম্পা। যাও বা কিছু মাত্র শিকড় ছিল তাও সমূলে উপড়ে গেল। এবার সে সম্পূর্ণ উদ্বাস্তু হয়ে গেল। উত্তর প্রদেশের কোথায় তার বাড়ি? কে তার মা-বাবা? কিছুই যে জানে না সে।
অপর দিকে মৃণালিনী দেবীর স্বামী এলাকার বিখ্যাত উকিল উপেন স্যান্যাল। অগাধ সম্পত্তির মালিক। কিন্তু ভগবান সবদিক থেকে দু’হাত ভরে দিলেও মৃণালিনী দেবীর কোল ফাঁকা করে রেখেছিলেন। পার্কে বা স্কুলের সামনে সব মায়েদের তাদের নিজের বাচ্চাদের আদর করতে দেখলে তার বুকটা হু হু করে উঠতো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। জরায়ূতে টিউমার অপারেশনের সময় ডাক্তার বলেই দিয়েছিলেন সেই নির্মম সত্যটা। তারপর জীবনের একমাত্র সঙ্গী এই বৃদ্ধ বয়সে এসে, তার হাত ছেড়ে দিয়ে আকাশের বুকে জায়গা করে নিলো তা আজ প্রায় তিন বছর।
যৌবন তাও বা কেটে যায় নেশায় নেশায়, বার্ধক্যের ব্যালকনিতে এলে প্রকৃত ভালোবাসার যে অর্থ উপলব্ধি করা যায়, তা তিনি প্রতিটা রাতেই ওপাশের ফাঁকা বালিশটাতে হাত বুলিয়ে অনুভব করতেন। এভাবেই জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে দুই পথ হারানো নাবিক, দিকশূন্য সাগরের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপ খুঁজে নিয়েছে নিজেদের জন্য।
শোনো বুড়ি, বেশি রাত অবধি বই পড়ো না কিন্তু। ঘুম ঠিক করে না হলে কাল সারা দিন কিন্তু মাথাব্যথা করবে, বুঝলে?
হুম বুঝেছি, অনেক রাত হয়ে গেল, যা এবার বাড়ি যা।
ধুর-র কোথায় রাত? সবে সাড়ে নটা বাজে। যাই হোক শোনো, টেবিলের উপর ওষুধ রইলো রাতের, ঘুমাবার আগে খেয়ে নিও। আর গরম জল করে ফ্ল্যাক্সে রেখে গেলাম। ঠাণ্ডা জল খেয়ে আবার সর্দি বাঁধিয়ে বসো না কিন্তু।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, প্রতিদিন একই কথা মুখস্থের মতো আওড়িয়ে যাস। আমার কথা তো আর শুনবিও না।
তোমার আবার কী কথা?
কত করে বলি, রাতটা এখানেই থেকে যা। না, রাতে তারকা রাক্ষসীর ঝুপড়িতে না গেলেই নয়। এই কে আছে রে তোর বাড়িতে?
দেখো বুড়ি...
এই থাম থাম! আবার জ্ঞান দেবে। যা তুই যেদিকে মন চায়, কাল সময় মতো চলে আসিস।
প্রতিদিনই রাতে গেট দিয়ে বেরোনোর সময় ভীষণ খারাপ লাগে টুম্পার। একা বয়স্ক মহিলা এত বড় বাড়িতে থাকে, রাত বিরেতে কিছু হয়ে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। সত্যিই একদিন তেমনটাই হলো। রাতে উঠে বাথরুমে গিয়ে আর শোওয়ার ঘরে ফেরা হলো না মৃণালিনী দেবীর। পরদিন সকালে কাজে এসে টুম্পাই প্রথম জানতে পারে। যেদিন গুতেল কাকু মরে গেল সেদিনও এতটা কষ্ট হয়নি তার, যতটা আজ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, ঈশ্বর যেন তার বুকের বাঁদিক থেকে একটা বড় অংশ কেটে নিয়ে গেলেন। মাকে পায়নি সে, কিন্তু ভগবান মা হারানোর কষ্টটা তার ভাগ্যের খাতায় সন্তর্পণে লিখতে ভুল করেননি।
আজ যেন সম্পূর্ণ অনাথ হলো টুম্পা। সময়ের কাটা থেমে থাকেনি। চোখের জলের রেখাও বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো। বিশাল প্রাসাদের মতো সাদা ওই বাড়িটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। গেটে তালা ঝোলে, ওপাশে কেউ নেই, এপাশের মানুষটাও কেমন যেন পাথর হয়ে যায় দিন কে দিন।
হঠাৎ একদিন বস্তির মোড়ে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো আর তার থেকে নেমে এলো কোট-টাই পরা এক ভদ্রলোক। বস্তিতে কোনও বড় গাড়ি দেখলে এমনিতেই সকলে ভিড় করে দাঁড়ায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। লোকটি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সোজা টুম্পার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইরের চেঁচামেচি শুনে টুম্পাও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। লোকটি জিজ্ঞেস করলো, আপনি মিস টুম্পা সরকার?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, আপনার ভোটার অথবা আধার কার্ডটা একবার একটু দেখতে পারি?
হ্যাঁ, কিন্তু.....মা...মা নে...আমি তো আপনাকে চিনি না আর টিভিতে যে বলে অচেনা কাউকে দরকারি কাগজপত্র কিছু দিতে নেই।
না না, আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি আমার পরিচয় বলছি। আমি স্বর্গীয় মিস্টার উপেন স্যান্যালের স্ত্রী স্বর্গীয়া মিসেস মৃণালিনী স্যান্যালের উকিল ছিলাম। আসলে মৃণালিনী দেবী নিজের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে আপনাকে মনোনীত করে গেছেন। এখন আপনাকে এখানে একটা সই করতে হবে আর সেজন্যই একটা প্রমাণ থাকা তো জরুরি যে আপনিই আসল টুম্পা সরকার। ও হ্যাঁ, এর সাথে একটা চিঠিও রেখে গিয়েছেন।
কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা ধরলো টুম্পা। আগে হলে হয়তো এটা পড়ার সাধ্যি তার হতো না, কিন্ত মৃণালিনী দেবী তাকে পড়তে শিখিয়েছেন, পনের দিনে একটা গল্পের বই পড়তে হতো তাকে। তারপর তার থেকে মৃণালিনী দেবী প্রশ্ন করতেন। এইসব পুরোনো কথা মনে পড়লেই টুম্পার চোখের জল কোনো বারণ না শুনেই অবাধে নেমে আসে। চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলো সে:
শোন মুখপুড়ি, তোর দায়িত্বে সব রেখে গেলাম। জানি তুই হেলায় নষ্ট করার মতো মেয়ে নোস। তবু মনে রাখিস, আমি আর উনি কিন্তু ওপর থেকে সব দেখছি। আমার বাড়িটা আজ থেকে তোকে দিলাম। আগের মতোই গুছিয়ে যত্ন করে রাখিস। আর শোন, আবার একটা বিয়ে করিস। একা একা সারা জীবন বেঁচে থাকা যায় না। ঝগড়া করারও একটা লোক চাই। আজ তো এই বুড়িটাও নেই যে গাল ফুলিয়ে সকাল সন্ধ্যে ঝগড়া করবি। ভালো থাকিস, নিজের একটু যত্ন নিস, চলি রে।
ইতি,
তোর ঝগড়ুটে বুড়ি
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপর বসে পড়ে টুম্পা। প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়েও নিজেকে তার পৃথিবীর সব চাইতে নিঃস্ব ব্যক্তির থেকেও নিঃস্ব মনে হচ্ছিল ।
তিন তিনটে বছর কেটে গেছে তারপর। এখন মৃণালিনী ভবন শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি একটি বৃদ্ধাশ্রম। এখানে টুম্পা মৃণালিনী দেবীর মতো এমন পঁয়ত্রিশ জনকে নিয়ে এসেছে যাদের সমাজ, পরিবার এমন কী ঈশ্বরও দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাদেরই দু’হাতে বুকে টেনে নিয়েছে টুম্পা। জায়গা করে দিয়েছে মৃণালিনী ভবনে যাতে শেষ কটা দিন তারা যেন একাকিত্বে না বাঁচেন। টুম্পা যেন একা না থাকে, একটা ঝগড়া করার লোক খুঁজে নেয় এই তো ছিল মৃণালিনী দেবীর শেষ ইচ্ছে। সেটাই খুঁজে নিয়েছে সে, একটা দুটো নয়, পঁয়ত্রিশটা ঝগড়ুটে বুড়ি। এখন সারাটা দিন মন খুলে সে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে।