ফেব্রুয়ারির টেনশান

বিশ্যুধবারের মৌর্সিপাট্টা

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮

বিজি আছিরে ভাই, এরকমটা শুনলে আমার বিচ্ছিরি লাগে। বুঝে যাই, এদের সঙ্গে শ্রি, শ্রিমাভো নিয়ে তর্ক নিষ্ফল। ওরা ক্যাম্পাস হতে সদরঘাটে গেল, এরকমটা পড়লেও বিচ্ছিরি লাগে। বুঝি যে, ‘থেকে’ আর ‘হতে’র বিড়ম্বনাতে ভোগা এই লোকের সাথেও আসর ঠিক জমবে না। কেরদানির পাহাড়ের চাপে কেরদানিকারক যখন নিজেই ধরাশায়ী তখন তাকে দেখি কেরদানির ক্যনভাসে এই বেলা ডিলিট করছে ঠিকুজি, কুলুজি; ওই বেলা ঘোষণা করছে ধর্ষনকারীরাই আমাদের দাদু আর বড়আব্বা।

অনেক ভাইয়ের সংসারে লুকিয়ে লুকিয়ে পেটিকোট ও ব্রেসিয়ার শুকাতে শুকাতে বেড়ে ওঠা লিঙ্গ লুকানো মেয়েটিকে দেখি এক কুহেলিকাময়-সান্ধ্য-সাংকেতিক ভাষাতে; ব্রাভো, ব্রাভো, চালারে কাদিরার শোরগোলে বিষাদসিন্ধুর কসাইদের বাহবা দিচ্ছে সংসপ্তকের কীর্তনিয়া বলে। মহাবিচ্ছিরিরও একটা মহাছিরি থাকে! সেটা গের্নিকা! নৈঃশব্দ্যের পরান য্যামন শব্দময়: শব্দ এখানে ঠিক সংলাপ নয়। এই শব্দ চাপা, গোমরানো এবং ক্ষুধিত। ইতিহাসের শ্লোগন ও ইতিহাসের দায়হীন দুই রশিতে বেঁধেই  দেহছন্দের মুখ আর মুখোশগুলোকে শূন্যের কড়িকাঠে ঝুলতে দেখি। মেলা আর বটতলার মিশেলে দেখি গড়ে উঠেছে এক আদিভৌতিক জিঞ্জিরা কালচার। বুঝি যে, এই `কেরদানি`র উত্তর  `কেরদানি`র আসল-নকল কোনও এটিমোলজিতেই পাওয়া যাবে না।

প্রত্যেক ভাষাতেই কিছু শব্দ থাকে যার আক্ষরিক অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। শব্দটির ব্যাখ্যা নিয়েও এত দৃষ্টিকোণ থাকে যে, শেষমেষ তার ব্যবহারিকতা হয়ে দাঁড়ায় বিমূর্ত আর মূর্তের দৈনন্দিন যোগসূত্র। ব্যুৎপত্তিও এখানে পরাজয় বরণ করে চোয়াল ও নাকের অল্প একটু নদী বা খাল পারাপারের পার্থক্যে। বাংলা ভাষাতে ছন্দ, ইংরেজিতে সেরেনডিপিটি, আর গ্রিকদের ps কে এক অক্ষরে গেঁথে বানানো শব্দগুলো এ গোত্রের। ছন্দ প্রকরণের বেহুদা বিতর্ক এ রচনার উদ্দেশ্য নয়। বরং ছন্দের সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্ধগুলো সংখ্যালঘুদের কীভাবে ব্ল্যাকমেইল করে, তার ওপর আলোকপাতই উদ্দেশ্য। সেরেনডিপিটি ভারতীয় শব্দ স্বর্ণদ্বীপ থেকে এই সেদিন এলেও, এটিমোলজি অনুযায়ী যদি স্বর্ণদ্বীপের অনুবাদ এখানে বসিয়ে দেয়া হয়, সেটা নরোদম সিহানুককে নরোত্তম সিংহনায়ক ডাকবার শামিল।

সিহানুক সাহেব দমদম বিমানবন্দরে লাগেজ হারিয়ে মাথায় হাত দিয়েও উদ্ধার পাবেন না। নিজের নামের এটিমোলজি খুঁজতে তাকে রাচি বা পাবনাতে  যেতে হবে। সেখানে দেখা যাবে, রোমান হরফে লালিত ইংরেজ, ফরাসি যাজকদের অধঃস্তনেরা গ্রিক ps এর একত্র অক্ষর উচ্চারণে ব্যর্থ হয়ে মনস্তত্ত্বের এত শত পাঠশালা খুলে বসেছে যে, মনই উধাও! সিহানুকের কাছে তখন মনে হবে, পৃথিবির যে কোনও বিমানবন্দরে অবতরণের আগে গন্তব্যের শাখামৃগদের চোয়াল ও নাকের আদলে বাপের দেয়া নামটা বদলে ফেলাই ছিল প্রজ্ঞার পরিচয়। অনলাইনে টাইপ করার সময় আমার য্যামন `সিংঘ` কিংবা `সিঙ্ঘ` হয়। `সিংহ` করতে লাগে প্রায় মিনিট খানেক।

একই অবস্থা মুর্শিদাবাদে জন্ম নেয়া মুসিলিম পরিবারগুলোর। ঢাকার  জেনেভা ক্যাম্পের বিহারীদের। ধাঙরপট্টির উল্কিধারী জমাদার, শান্তিনিকেতনের সাঁওতালদের এবং ইত্যাকার দেশের ইত্যকার সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, চেচেন, চাকমা, গারো, উইগুর, তিব্বতি, কমিউনিস্ট, ন্যুডিস্ট, ফ্যাসিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট, সোশালিস্ট, ডাডাইস্ট, ইস্লামিস্ট, অকালিস্ট, হুদাইস্ট, হেনো, তেনো, হোমো, ব্যামো সাত সতেরোর। লাগেজ খুজে পাবার পর এই সংখ্যালঘুদের ভেতরেই যারা ভাগ্যবান, দ্যাখা যায় তারা অসাচ্ছন্দের চাকা ঘুরিয়ে সংখ্যালঘুদের কুচকাওয়াজে তালে তাল মিলিয়ে নতুন শেখা ছন্দবদ্ধ শব্দ, চরণ, কার্তুজ তাক করে বসে আছে সমাজের সবচেয়ে বেশি যে সংখ্যালঘু সেই `একলা` ব্যক্তির দিকে। বাংলাদেশের আক্ষরিক হিন্দু ব্রাক্ষ্মণেরা কলিম খান জাতীয় সজনিকান্তরা, ভারতের জর্জ ফার্নান্দেজ জাতীয় মার্ক্সিস্টেরা এমনটি করছে।

সেনানিবাসগুলোতে ঢুকলে দেখা যাবে, গাছগুলোকে পর্যন্ত শাদা চকখড়িতে ঢেকে স্পার্টান সমরকলায় ছন্দোবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। টিন ড্রামের শিশুটির তারস্বরে মাদল বাজানো ছন্দপতনে কান পেতে  শুনি, দেহছন্দের জন্মধ্বনি। আজম খানের গানে, হ্যাপি আখন্দের উচাটনে, আশির দশকের কবিতার মৌলিক পত্তনিতে। আজিমপুর পিলখানা রোডের শেষ মাথা থেকে ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তলদেশে গল্পের ভিতর গল্পের কথকতায়। হাঁটু অব্দি ঢিলাঢালা জোব্বা, সাদা চটের পাতলুন আর খড়ম পরা সাবদার সিদ্দিকীকে দেখি, নদীর অল্পতলে দলকল্মিতে জড়িয়ে স্মরণ করছেন কোলকাতার রায়টের বিভীষিকা। স্যাঙাৎ ভাস্কর রাশার পাশে পাটুয়াটুলির আবগারি জানজটে জড়িয়ে সাবদারেরই অবতার চেঁচাচ্ছে ইউরেকা ইউরেকা... পেয়ে গেছি দেহছন্দ। পেয়ে গেছি ভাঙা লিরিকের ম্যুরাল মোজাইক!

রাশা: দেহছন্দ কি রে দোস্ত?
সাবদার: যাহা অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের জোয়ালে বন্দি নয়।
রাশা: তাইলে তো সবকিছু।
সাবদার: ওই মানে ওই অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছাড়া।
রাশা: মানে আমার ভাস্কর্য?
সাবদার: হ।
রাশা: মানে তোমার কবিতা?
সবাদার: না, এইখানে খটকা।
রাশা: কে মিটাবে এই খটকা? কেউ পারবে?
সাবদার: ঢাকেশ্বরীর ওইখানে কয়েকটা ছোকরাকে দেখলাম তোমার ভাস্কর্যটাকে কবিতাতে এনে আরও বেশি বলে ফেলছে।
রাশা: কারা এরা?
সাবদার: কয়েকজনের নাম মনে আছে রিফাত, কচি, চয়ন।
রাশা: নামগুলা তো খাসা। জেন্ডার কি?
সাবদার: না, জেন্ডারের বাইরে। বলে, দেহছন্দের জেন্ডার নাই। বলে, দেহছন্দ নাকি জোনাকিদের ভিতরের জ্বালানি এবং জ্বলুনি।
রাশা: আরও কী জানি বলতে চায়...
সাবদার: হ্যাঁ, বলে যে, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতায়, য্যামন ১৯৭৫ এ, তেমন ২০০৮ এ পিলখানার বিডিআর এর হত্যাকাণ্ডে মার্ক্সিস্ট-সুন্নিদের এবং সুন্নি-মার্ক্সসিস্টদের ভূমিকা ছিল। এই পঞ্চম বাহিনীর হাতে আমরা এবং আমাদের ভাষাভাষি সবাই ব্ল্যাক্মেলের শিকার। যাবতীয় রুচি-বিকৃতি এবং নন্দনের একদেশদর্শী অবনয়ন ঘটেছে এদের হাতেই। বলে, দেহছন্দেই নাকি উদ্ধার। চারদিকে নাকি জংগল পোড়া গন্ধ। তার ভিতর ওরা ভাজবে... দাও হে কল্কিটা দাও।
রাশা: না হে, আমি বেশ মাছভাজার গন্ধ পাচ্ছি।
সাবদার: ওই ছোকরাগুলাকেই আমার মাছকুমারী মনে হয়েছে, দোস্ত।
রাশা: মাছকুমারীদের গোস্ত! দেহছন্দের কিবাব! খাশা...
রাশাঃ মাছকুমারিদের গোস্ত!দেহছন্দের কাবাব! খাশা হবে...
সাবদার: কিন্তু বাদ সাধছে PTS।
রাশা: ওটা কি?

গড়পরতা গদ্যে PTS সমীকরণ

আর তাবৎ সমাজের মতোই বাংলা ভাষায় অবতীর্ণ সামন্তবাদী বনেদি পরিবারগুলোতেও বেশ মজার মজার টোস্ট বিস্কুট আছে। মহাজ্ঞানী গোলাম মুর্শিদকে দেখা যাবে খুনে ছোটভাই গোলাম ফারুক অভির ব্যাপারে নিশ্চুপ। উদারপন্থী কবি বেলাল চৌধুরীর ভাই গিয়াস কামালকে দেখা যাবে, বেলালের ঠিক উলটো দিকের মঞ্চগুলোতে। বিপ্লব শেষ করেই হায়দর আকবর আর রাশেদ খান মেনন, জেনারেল জিয়ার উপদেস্টা-বড়ভাই এনায়েতুল্লার সাথে লন্ডনে উড়াল বাংলাদেশে ধরা পায়রাগুলো কভেন্ট গার্ডেনে ওড়াতে। পরিবারগুলোতে সময় সময় লোক দেখানো লাঠালাঠিও হয়। তাতেও তো হাস্যকরভাবে বিপ্লবী মেনন হেরে যায় কুলাঙ্গার অভির কাছে। ফেরদৌসী মজুমদার আত্মচরিতে চৌধুরী থেকে মজুমদারে রূপান্তরে দুই পরিবারের মুখ না দেখাদেখির ব্যাখ্যান পুরোপুরি এয়ারব্রাশ। কাউন্টার কালচারের কাচকলা কে যে কাকে দেখায়! এই যে পরিবারগুলোর আমরা-আমরা খেলা, তাতে কবির চৌধুরীদের সাথে নামহীন গোত্রহীন ছফাদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয় বিদেশি দুতাবাসগুলোর সাংস্কৃতিক সচিবেরা।

জাতপাতের ঠিকানাহীন লুম্পেনদের আরেক ডেটিং-নিকেতন প্রিন্সটনের থিওলজিক্যাল সেমিনারি বা PTS। এদের বাজেট প্রায় মার্কিন সরকারের মতোই। কোনটা যে মার্কিন, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আর কোনটা PTS ডিগ্রি, তা বোঝা মুস্কিল। পশ্চিমের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই PTS ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। PTS নিজের সনদকে বলে খ্রিস্টান মৌলবাদী সনদ, আর প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, যারাই একেশ্বরবাদের কথা বলবে তারাই PTS বৃত্তির দাবিদার। এখানেই ভারতীয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানি বামপন্থী শিক্ষকেরা ধরা। শুধু চোমস্কি করলে তো আর সব পেয়েছির দেশে যাওয়া যাবে না। তার সাথে দরকার PTS এর কাছ থেকে তহবিল পাওয়া স্থানীয় NGO গুলোর ছাড়পত্র। কাপিশ, পড়তে চাইলে পড়ো। না পড়তে চাইলে বাঈজীর খরচ যোগাবে ওই PTS। লাল ঝাণ্ডার পাশে শুধু ক্ষণে ক্ষণে লালসালুটার ইশারা দেখালেই হবে। PTS এর ব্যাক ট্রান্সলেটররা শ্যেন দৃষ্টি রাখছে তহবিল প্রাপ্তরা দেশে ফিরে নাফরমানি করছে কীনা। দুই দুগুণে চার। সামন্তবাদী পরিবারগুলোর হাতে একবার এবং PTS আশির্বাদপুষ্ট NGO গুলোর হাতে আরেকবার নাজেল হইলো সেকুলারিজম বিরোধী মার্ক্সবাদী-সুন্নি, মার্ক্সবাদী-হিন্দু কাউন্টার কালচার। দুই মাথাঅলা এই ছন্দনাশক-দানোরে এখন কোন ল্যাবিরিন্থে ঢুকাইবেন হে বৃত্তি-পরভূক-নপুংশকেরা!

এখন প্রায় সত্তর বছর বয়সী দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ লেখক আন্দ্রে ব্রিঙ্ক ১৯৬০ সালে প্যারিসে পড়াশোনার সময় সংবাদপত্রের পাতায় নিজ দেশের পুলিশকে কালোদের অহিংস মিছিলে গুলি চালাতে দেখে বলেছিলেন, সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের একজন হিশেবে নিজেকে চিন্তা করা কঠিন; তার চেয়েও মহাকঠিন নিজ সম্প্রদায়ের এই সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ কায়মনে প্রার্থনা করা। ব্রিঙ্কের পাশাপাশি পড়ছি, চল্লিশ বছরের ফরাসি লেখিকা ইমানুয়েল পাগানোর সাক্ষাৎকার। ইমানুয়েল হাসতে হাসতে জানালো, চুলে ফুল গুজে আমি লিখতে বসি না। মাংস কামড়াতে কামড়াতে আমি লিখি। এক জীবনে ছোট্ট ছোট্ট কিন্তু তীব্র আবেগী কিছু বিজয় আমার চলার পথকে অর্থবহুল করে।

সংস্কৃত যাজকের হাতে নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গের বা আরব্য রজনিতে নির্দেশনা খোঁজা বাংলাদেশের বাংলা ভাষার জয়কে আমার আর নিজের জয় বলে মনে হয় না। ব্যুৎপত্তি নয়, বিচ্ছিরি থেকে রক্ষা পেতে দেহছন্দের নতুন ছিরি-ছাদের সন্ধানে অভিনিবেশ করি।