ফিনকি দিয়ে উঠছে পৃথিবীর সব উল্লাস!
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০১৯
দালাল শুধু গাবতলি বাসস্ট্যান্ডেই থাকে না, মধুমতি পারের কালনার ঘাটেও থাকে সমান সমান। আর তারা এগিয়ে এসে সন্ধ্যার অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে তোলে। ভয় দেখিয়ে জানায় যে, এখনতো ইতনা বাজারে যাওয়ার কিছুই পাবেন না। আপনাকে যেতে হলে লেগুনা একটা রিজার্ভ করেই যেতে হবে। এবং তিনশো টাকার কমে কেউ যাবে না।
বলে কি মানুষগুলো! অধ্যাপক সবুজ শামীম আহসান তো বলেছিল দশ-বিশ টাকার ভাড়াতেই হয়ে যাবে। অবশ্য সবুজ সাহেবের কথামতো আমি ভাটিয়াপাড়া থেকে ইতনা ঘাটে পৌঁছাতে পারিনি, চলে এসেছি কালনার ঘাটে, ভাটিয়াপাড়ার কয়েকজন মানুষের পরামর্শে। তারা আমাকে মিসগাইড করেছে যে, ইতনা ঘাটের রাস্তাটা ভালো না। যা হোক, এই বিপন্নতায় আমি সবুজ সাহেবকে কল দিই। তিনি আর কল কিছুতেই ধরেন না। ওদিকে সন্ধ্যা রাত হওয়ার তর্জনী দেখাচ্ছে। এই অজানা জায়গায় আমি এখন কি করবো। ড্রাইভার আরো ঘাবড়ে দিয়েছে এখান থেকে ইতনা বাজার যেতে নাকি পাক্কা একঘণ্টা লাগবে!
অগত্যা আর কি! ওঠে বসলাম লেগুনাতে! তিনশো টাকার চুক্তিতেই। ঘন গাছপালা ঘেরা পথ দিয়ে চলতে শুরু করলো লেগুনা। পাঁচ মিনিট পরই নির্জন জঙ্গলমতো জায়গায় থেমে গেল যানটা। ড্রাইভার লাফিয়ে নেমে দূরের একটা দোকানের দিকে যেতে যেতে বললো, মোবাইলটা চার্জ দিতে হবে। রেখে আসি। যেতে যেতে দেখলাম সে যেন কার সঙ্গে কথাও বলছে! মোবাইল কি দুটো? কার সঙ্গে কথা বলছে? এই অন্ধকার নির্জনতায় যদি আমাকে ঠ্যাক দিয়ে বসে? গা ভয়ে কেঁপে উঠলো আমার। এ রাস্তায় তো জীবনেও কখনো আসিনি। যদি জায়গামতো পৌঁছে না দেয়। আর দেখো, রাজ্যের চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগলো। ঘ্যাচ করে পেটের ভেতর ছুরি… মাগো! আমি দিশেহারা হয়ে লেগুনা থেকে নেমে পড়ি। ড্রাইভারটা দোকানদারের সাথে কি এতো গল্প করছে? আমার ভয় কেবল বাড়তেই থাকে। তখনই মুনলাইট সোনাটার মতো তরঙ্গিত বেজে ওঠে এক সুরেলা কণ্ঠ, স্মাইল!
আমি এবার পেছনফিরে মধুমতিমুখী আকাশের দিকে তাকাই। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আবারো সেই সুরেলা কণ্ঠ, স্মাইল! কুল…কুল। বলছি না সবসময়ই হাসিমুখে থাকবা। এত টেনশন কিসের?
দেখছো না কী বিপদে পড়তে যাচ্ছি। কী যে হয়! বেজে ওঠে আমার আর্তস্বর।
কিসসু হবে না। আমাকে অভয় দেয় চন্দ্রভানু। তোমাকে বলছি হাসিমুখে থাকতে, হাসিমুখে থাকবা।
ওদিকে তখন ড্রাইভার কাছাকাছি চলে এসেছে। ড্রাইভারকে দেখেই কিনা চন্দ্রভানু একখণ্ড মেঘের ভাঁজে মুখ লুকাল।
ড্রাইভার লেগুনায় ওঠতে না ওঠতেই বেজে ওঠলো মোবাইল ফোন। অধ্যাপক সবুজ আরো ঘাবড়ে দেয়, করেছেন কি? আপনি এ পথে এলেন কেন? তিনশো টাকার কথা শুনে তার আফসোস আরো বাড়ে। ঠিক আছে! আসেন! বলে সে কলটা কেটে দেয়। তখনই আবারো কানের কাছে চন্দ্রভানুর সুরেলা কণ্ঠ বেজে ওঠে, বলছি না হাসিমুখে থাকতে। আমি রীতিমতো ধমকে ওঠলাম, ধ্যাত! কী যে বলো! আমার এখন মরণদশা!
দুমিনিট পরই আবার বেজে ওঠলো মোবাইল ফোন। অধ্যাপক সবুজ জানতে চাইলেন, আপনি কি লোহাগোড়ার মোড় পার হয়ে গেছেন? আমি ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে নিয়ে বলি যে, এখনো পার হইনি। অধ্যাপক সবুজ বললেন, ড্রাইভারকে বলবেন, ওখানে রাখতে। সাত আট মিনিট পরই ড্রাইভার বললো, এটাই লোহাগোড়ার মোড়!
তখনি দেখি সামনে এসে দাঁড়ালেন অধ্যাপক সবুজ। নামেন নামেন। আমরা এখানে একটু চা খাব। তিনিই ড্রাইভারকে একশোটাকা দিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করলেন। শুধু কি অধ্যাপক সবুজ! ঝিকরগাছার কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল, চুয়াডাঙ্গার কবি অমিতাভ মীর, কলকাতার আবৃত্তিকার কবি সেলিম দুররানি বিশ্বাস আর বর্ধমানের সর্বপ্রিয় গবেষক খোকন কুমার বাগ! আর সঙ্গে রাজাভাইয়ের মেয়ে ঝিলিক। তারা যশোর থেকে ফিরছিলেন মাইক্রোতে রাজাভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে, যাওয়ার পথে আমাকেও উদ্ধার করে নিলেন।
সবাই যেন কতদিনের চেনা। ধরে বেঁধে এক চায়ের দোকানে বসালো। গাভির দুধের সঙ্গে খেজুর গুড় মেশানো চা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যখন আহ বলতে যাব তখনই কানের কাছে শুনতে পেলাম চন্দ্রভানুর স্বর, স্মাইল! স্মাইল! সত্যি হাসি ফুটে উঠলো। আমি যেন ঝিলিকের কথা শুনে হাসছি এমন একটা ভাব দেখালাম সবাইকে। খুব দেখতে ইচ্ছে করলো চন্দ্রভানুকে।
মাইক্রোবাসে ওঠার আগে প্রাকৃতিক কর্ম করার ছলনায় একটু গাছপালা ঘেরা নির্জনতায় সরে গিয়ে চাঁদের দিকে তাকালাম। ও যেন এ মুহূর্তটুকুরই অপেক্ষায় ছিল। যেন একটা খুব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে এমন ভাব নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সে হাসি আমাতেও সংক্রমিত হয়। ক্রমশ বাড়ে। শব্দমাধুর্যতা খুঁজে পায়। হাসতে হাসতে চন্দ্রভানু বলে, তোমাকে বলেছি না সবসময় হাসিমুখে থাকতে! টেনশনে তো মরেই যাচ্ছিলে। আমি আর ওর কথার কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কীভাবে উত্তর দেব। ভেতর থেকে হাসির এমন উচ্ছসিত ঝর্ণাধারার স্রোত ভেসে আসছিল যে, কথা বলা আর কিছুতেই সম্ভবপর হয় না। চন্দ্রভানুও দেখি হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠলো। জোছনার এমন বিচ্ছুরিত আলো আর কখনো দেখিনি! ফিনকি দিয়ে উঠছে পৃথিবীর সব উল্লাস!
লেখক: কথাসাহিত্যিক