ফার্নান্দো পেসোয়া
ফার্নান্দো পেসোয়ার একগুচ্ছ কবিতা
বাঙলায়ন: রথো রাফিপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০২০
জানি না আমার কতশত আত্মা
আমি জানি না আমার কতশত আত্মা।
মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছি আমি।
অচিন পথিক মনে হয় আমাকে সর্বদা।
আমারই দেখা আমি পাইনি কোনোদিন।
এতকিছুর পরও, আমার শুধু আত্মাই আছে।
আর আত্মা আছে যার, সে তো অস্থির।
যে দেখে, যা দেখে, সে তো তা-ই।
যে অনুভব করে, যা অনুভূত হয়, সে তা নয়।
যা আমি, যা দেখি, তাতে নিবিষ্ট হয়ে
আমি তারাই হয়ে উঠি, থমকে যায় আমি হওয়া।
আমার প্রতিটি স্বপ্ন, প্রতিটি বাসনা
শুধু তারই, যার তা ছিল, আমার নয়।
আমি শুধু আমারই ভূগোল,
নিজেকেই ঘুরতে-ফিরতে দেখি—
বিচিত্র, চলন্ত, আর একা।
এইতো এখানে আমি, নিজেকে যে অনুভবে অক্ষম।
তাই আমিও, অচেনা পথিকের মতো, পাঠ করি
আমার অস্তিত্ব, যেন অগণন পৃষ্ঠারাশি।
কী আসবে সামনে না জেনেই
আর যা পার হয়ে গেছে তা ভুলে গিয়ে
আমার পাঠের মার্জিনে টুকে নিই
কী ভাবলাম আমি, আর কী অনুভব করলাম।
ফের পড়ে চমকাই: `আরে, তা কি আমি ছিলাম?`
ঈশ্বরই জানেন ভালো, কারণ এ তো তারই লেখা।
রাখাল ১
কখনও ভেড়ার পাল চড়াইনি আমি,
কিন্তু মনে হয় আমি তাদের খেয়াল রাখতাম।
এক রাখালের মতোই আমার আত্মা,
যে চেনে বাতাস ও সূর্যকে
আর সে ঋতুর সঙ্গে হাত ধরে চলে,
অনুসরণ করে ও দেখে চলে।
লোকবিহীন প্রকৃতির সমস্ত শান্তি
আসে আর বসে আমার পাশে।
কিন্তু আমার বিষাদ লাগে
যখন আমাদের কল্পনায় সূর্যটা ডুবে যায়
যখন তা ঠাণ্ডা হয়ে আসে সমতল মাঠে
আর আপনি টের পান জানালা দিয়ে
রাত্রি নেমে আসে একটা প্রজাপতির মতো।
কিন্তু আমার বিষাদ বড়ো শান্ত
কারণ তা প্রাকৃতিক আর তা-ই ঠিক
আর আমার আত্মায় যা থাকা দরকার এ তা-ই
যখন এটা ভাবে এর অস্তিত্ব আছে
আর আমার হাত ফুল তোলে
আর আমার আত্মা তা জানে না।
পথের বাঁকের চেয়ে দূরে
গরুর গলার ঘণ্টির শব্দের মতো
আমার ভাবনাগুলো শান্তশিষ্ট।
তারা শান্ত জানায় দুঃখিত আমি
কারণ আমি যদি তা না জানতাম,
শান্ত ও বিষণ্ণ হওয়ার পরিবর্তে,
সুখি ও শান্ত হতো তারা।
ভাবাভাবি অস্বস্তিতে ফেলে আপনাকে বৃষ্টিতে হাঁটার মতোই
যখন বাতাসের শক্তি ক্রমে বাড়ে আর মনে হয় বৃষ্টি বাড়বে আরও।
আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা নেই।
কবি হওয়া আমার আকাঙ্ক্ষা নয়,
আমার একা হওয়ার উপায় মাত্র।
আর কখনও কখনও আমি যদি
কল্পনা করতে চাই আমি একটা ভেড়া
(কিংবা ভেড়ার গোটা পাল
পাহাড়ের সারাগায় চড়ে বেড়াচ্ছি
যেন একইসময়ে প্রচুর সুখের জিনিস হতে পারি আমি)।
এর একমাত্র কারণ সূর্যাস্তের সময় যা লিখি তা আমি অনুভব করি,
কিংবা একখণ্ড মেঘ যখন আলোর গতরে হাত বুলায়
আর বাইরে বিস্তীর্ণ ঘাসের উপর নীরবতা ছুটে বেড়ায়।
যখন আমি বসি আর লিখি কবিতা
কিংবা, সড়ক বা ফুটপাত ধরে হেঁটে বেড়াই,
আমার ভাবনার কাগজে কবিতা লিখি,
আমার হাতে একটা বস্তু টের পাই,
আর একটা গোল টিলার ওপর
আমার ছায়ামূর্তিকে দেখতে পাই,
আমার ভেড়ার পালের যত্নআত্তি নিয়ে আর আমার ভাবনাগুলো লক্ষ্য করে
কিংবা আমার ভাবনাগুলোর যত্নআত্তি নিয়ে ও আমার ভেড়ার পালের দিকে চেয়ে,
আর উটকো হেসে কারো মতো যে কিনা বোঝে না কেউ তাকে কী বলছে
কিন্তু ভাব ধরার কসরত করে সে বোঝেছে।
যে পাঠ করে আমাকে আমিও তাকে উপহার দিই,
আমার বড় টুপিটা তাদের দিয়ে দিই
যখন তারা আমাকে দেখে আমার দরজায়
স্টেজকোচ আমার পাহাড় চূড়ায় আসার সাথে সাথে।
আমি তাদের উপহার দিই আর তাদের জন্য সূর্যালোক কামনা করি,
কিংবা বৃষ্টি, যখন বৃষ্টি দরকার,
আর তাদের ঘরে ঘরে যেন একটা আয়েসি চেয়ার থাকে
যাতে বসে তারা পড়বে আমার কবিতা
কোনো জানালার পাশে।
আর আমার কবিতা পড়বে যখন, আশা করি তারা ভাববে
আমি প্রাকৃতিক কিছু—
ধরা যাক, একটা প্রাচীন গাছ,
যার ছায়ার নিচে বসতো তারা ধম করে
ছিল যখন শিশু
খেলে খেলে ক্লান্ত আর মুছতো ঘাম
তাদের তপ্ত ভুরু থেকে
তাদের ডোরাকাটা জামার হাতার কুচি দিয়ে
রাখাল ২
আমার দৃষ্টি সূর্যমুখির মতো স্পষ্ট।
আমার স্বভাবই পথে পথে হাঁটা আর
ডানে বামে তাকানো
আর কখনো পিছনে ফিরে দেখা
আর প্রতিটি মুহূর্তে আমি তা-ই দেখি
আগে যা কখনও দেখিনি,
আর খেয়াল করার ক্ষেত্রে আমি বেশ দক্ষ।
একটি নতুন শিশু যেমন অনুভব করে
সে যদি খেয়াল করে যে সে সত্যি বাস্তবেই জন্ম নিয়েছে
আমিও সেই একই বিস্ময় অনুভবের সামর্থ রাখি।
আমি প্রতিটি মুহূর্তেই অনুভব করি মাত্রই জন্ম নিয়েছি আমি
সম্পূর্ণ এক নতুন পৃথিবীতে...
আমি যেমন ডেইজি ফুলকে বিশ্বাস করি
তেমনি করি এ পৃথিবীকে।
কারণ আমি তাকে দেখেছি। তবে তা নিয়ে আমি ভাবি না।
কারণ ভাবা মানেই কোনো কিছু বুঝতে না পারা।
আমাদের ভাবনার বিষয় করে সৃষ্টি করা হয়নি বিশ্বকে
(ভাবা মানে এমন চোখের অধিকারী হওয়া, যা ভালো নয়)
করা হয়েছে তার দিকে তাকাতে আর তার সঙ্গে একমত হতে।
আমার কোনো দর্শন নেই, আমার শুধু ইন্দ্রিয় আছে...
আমি যদি প্রকৃতি নিয়ে কথা বলি, এর মানে নয় একে জানি আমি
বরং আমি তাকে ভালবাসি বলেই আর সেই কারণেই বলি,
কারণ যারা ভালোবাসে তারা কখনও জানে না কী ভালোবাসে তারা
কিংবা কেনই বা ভালোবাসে তারা, কিংবা ভালোবাসা কী।
ভালোবাসা হলো শাশ্বত নিষ্পাপতা,
আর একমাত্র নিষ্পাপতা হলো না-ভাবা...
রাখাল ৬
ঈশ্বরকে ভাবা মানে ঈশ্বরকেই অমান্য করা
কারণ ঈশ্বর চান না তাকে আমরা জানি,
সে কারণেই নিজেকে তুলে ধরেন না আমাদের সামনে...
আমাদের উচিত সরল আর শান্ত হওয়া,
ঝর্ণা আর গাছপালার মতো,
তাহলে গাছপালা ও ঝর্ণার মতো সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করে
ঈশ্বরও আমাদের ভালোবাসবেন
আর তার ঝর্ণাধারায় আমাদের দেবেন সজীবতা
আর আমাদের সময় ঘনালে একটি নদী দেবেন চলে যেতে...
রাখাল ৭
এ পৃথিবী থেকে
যতটা দেখা যেতে পারে ততটাই আমি দেখি এ বিশ্বকে,
আর আমার গ্রামও যেকোনো শহরের মতো বড়ো,
কারণ, আমি যা দেখি, আমিতো তারই সমান
কখনও আমার এ দৈহিক উচ্চতার নয়...
এখানে পাহাড় চূড়ায় আমার বাড়ির তুলনায়
এসব শহরে জীবন বড়ো ছোটো।
শহরের বড়ো বড়ো দালান দৃশ্যকে বন্দি করে ফেলে
তারা দিগন্তকে লুকিয়ে ফেলে, উন্মুক্ত আকাশ থেকে
আমাদের দৃষ্টিকে তাড়িয়ে দেয় বহু দূরে।
তারা আমাদের ছোট বানিয়ে ফেলে, কারণ যেই বিশাল বিস্তৃতি
আমাদের চোখ দেখতে পারতো, তা তারা কেড়ে নেয়,
আর তারা আমাদের গরিব বানিয়ে ফেলে, কারণ আমাদের একমাত্র সম্পদ এই দেখা।
রাখাল ৯
ভেড়ার রাখাল আমি
আর ভাবনাগুলোই আমার ভেড়ার পাল
আর প্রতিটি ভাবনা একেকটি সংবেদন
আমি ভাবি আমার চোখ ও কান দিয়ে
আর আমার হাত ও পা দিয়ে
আর আমার নাক ও মুখ দিয়ে।
ফুল নিয়ে ভাবা মানে দেখা ও গন্ধ শুঁকা
আর ফল খাওয়াই হলো এর অর্থ বোঝা।
সে কারণেই গরমের দিনে
একে খুব উপভোগ করি যখন বিষাদ লাগে আমার,
আর ঘাসের মাঝে শুয়ে থাকি আমি
আর আমার কোমল উষ্ণ চোখ দুটি বুজে থাকি,
তখনই আমি অনুভব করি গোটা শরীর আসলে ঘাসের মাঝে শোয়া,
আর তখনই আমি সত্যটা জানি আর আমি খুশি।
রাখাল ১৩
ধীরে, ধীরে, বড়ো ধীরে
বড়ো মৃদু বাতাস বয়ে যায়,
আর তা দূরে যায় ধীরেই,
আর জানি না কি ভাবছি আমি,
আর চাই না জানতেও।
রাখাল ১৪
ছন্দ নিয়ে ভাবি না আমি। দুটি গাছ
একটির পাশে আরেকটি, মিল বড়ো দুর্লভ,
ফুল যেভাবে রঙ পায় আমি ভাবি আর লিখি সেভাবেই,
তবে যেভাবে নিজেকে করি প্রকাশ নয় ততটা নিখুঁত
কারণ আমার নেই ঐশ্বরিক সরলতা
তা কেবল আমার বহির্সত্তা হতে হয় বলেই।
আমি তাকাই আর আমি প্রভাবিত হই,
ভূমি ঢালু হলে যেভাবে জল গড়ায় সেভাবেই প্রভাবিত হই আমি,
আর আমার কবিতাও প্রাকৃতিক যেমন বাতাসের আলোড়ন।
রাখাল ৩৩
কেটেছেঁটে পরিপাটি করা বাগানের ফুলতলায় বেচারি ফুল।
তাদের দেখে মনে হয় পুলিশের ভয়ে কাতর জড়োসরো…
কিন্তু তারা এতটাই সত্যনিষ্ট যে, হুবহু সেই আগের মতোই ফোটে
আর সেই প্রাচীন রঙেই সাজে
প্রথম পুরুষের প্রথম দৃষ্টির জন্য তাদের সেই বুনো উন্মাদনায় যে রঙ তারা খুঁজে পেত
যে কিনা তাদের দেখে চমকে যেত আর আলতোভাবে ছুঁয়ে ফেলতো
যে কারণে সে নিজের আঙুল দিয়েও নিশ্চিত তাদের দেখতে পেত।
রাখাল ৪৯
আমি ভেতরে যাই আর জানালা বন্ধ করে দেই
আনা হয় প্রদীপ আর বলা হয় আমাকে শুভরাত।
আর আমার কণ্ঠও প্রশান্ত স্বরে বলে, শুভ রাত।
এ হোক আমারই জীবন, এখন ও চিরকাল:
দিনটি উজ্জ্বল কিংবা বৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট
কিংবা ঝড়ো যেন পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছিল,
সন্ধ্যাটা শান্তশিষ্ট, আর আমার চোখ আমার জানালার
পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের দিকে মনোযোগী,
আমার শেষ বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি শান্তসমাহিত গাছগুলোর দিকে যায়,
তারপরই জানালাটা বন্ধ হয় আর প্রদীপ জ্বালানো হয়
পড়া নয়, ঘুম নয় আর কিছু নিয়ে চিন্তাও নয়,
জীবন আমার মাঝে বইছে দুই তীরের মাঝে নদীর মতো অনুভব করা
আর বাইরে পীনপতন নীরবতা দেবতার মতো যে কিনা ঘুমিয়ে আছে
শেষ কবিতা
মৃত্যুদিনে অনুলিখিত
হতে পারে জীবনের শেষদিন আজ।
ডান হাত তুলে সূর্যকে সালাম জানালাম,
আসলে সালাম দিইনি, কিংবা বিদায়ও জানাইনি তাকে।
শুধু বোঝাতে চাইলাম, তাকে দেখে আগেও খুশি হয়েছি। এর বেশিকিছু নয়।
ফার্নান্দো পেসোয়ার পুরো নাম ফার্নান্দো অ্যান্তোনিও নগ্যুয়েরা পেসোয়া। ১৮৮৮ সালের ১৩ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন কবি, লেখক, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, প্রকাশন ও দার্শনিক। একবিংশ শতাব্দির অন্যতম সেরা পর্তুগিজ কবি হিসেবে তাকে উল্লেখ করা হয়। ১৯৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।