ফাতিমা জাহানের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২৩
মৃত সমুদ্র
সমুদ্রও কি মরে যায়?
মরে গেল যে!
যতবার তুমি তাকে দেখলে
একবারও কি মনে হয়নি, প্রাচীন সাগরটা মরে যাচ্ছে?
তার প্রাণ ভোমরা কাকে দিয়ে এসেছ নীলাম্বর!
ঢেউ নেই, শব্দ নেই, তট নেই, নেই বালিরাশি
আছে গনগনে উত্তাপ, সেই উত্তাপে তুমি সাঁতরাতে চাইলে।
অবশ্য নিষেধ তুমি অমান্য করোনি।
সমুদ্রটা জল ঢালতে ঢালতে মরে গেল।
অন্যের জল সেচতে সেচতে তৃষ্ণায় কাতর রইল কিছুকাল।
তারপর তোমায় দেখার সাধ জাগল।
স্থিরের ডাক কখনো শুনতে পেয়েছ?
সাধ হয়েছিল তার তোমায় গোছাবার
অসীম সাধ তার, অনিমেষ অপেক্ষা।
অবশেষে পাহাড় ডিঙোতে না পেরে
তার মৃত্যু ঘটলো।
অচিন কায়া
দেয়ালের পলেস্তারার মতো কারো অভিমান যেন খসে যায়।
যা যায়, যায় শুধু দেয়ালের ছবিটা স্মৃতির দুর্বলতায়, দুর্বল চাউনির মায়ায়।
যায় উড়ে কয়েকশো জোড়া দোলনচাঁপা পাপড়ির ডানায়।
কারো অবয়বে ছেয়ে যায় ঘুমঘড়ির ইশারায়।
কিছু আহ্লাদ উড়ে যায় বর্ণহীন ধোঁয়ার মহিমায়,
কিছু রয়ে যায় রাজকীয় রূপের একাগ্রতায়।
জ্যামিতিক শাড়ির আঁচলপুর জুড়ে রয়ে যায় কিছু সদ্য ফোটা সবুজ ক্ষত।
তবুও সে চলে যায়
সঙ্গে তার অগাধ অচিন কায়ায়।
ঘুম
ঘুমঘড়ির ঘুমঘরে তার আগমন
তাকে পাহাড় দেখানোর সাধ আজন্ম।
ঘুমের এক চিলতে স্টেশনে তাকে দেখব বলেই
পায়ে হেঁটে পার হই হাজার মাইল,
বিদগ্ধ সমুদ্রস্নান শেষে ভাবি,
ঘুমে মিলিয়ে যাব সেই উপচে পরা সমুদ্রের আভায়।
রডোডেন্ড্রোন, ম্যাগনোলিয়া, বার্চ যে গুহার ঘুম ভাঙায়
তোমার সুদর্শনের মোহে।
জানো নিশ্চয়ই
ঘুমের প্রতিটি চিকচিকে কণা অপেক্ষারত
আর পাথুরে শহরের জাপানি পুতুলগুলো
আড়মোড়া ভাঙে সেই ঘুমে পৌঁছানোর তাগিদে।
একশো বছরের পুরনো স্যুটকেস আর
ততোধিক প্রাচীন হাসি মেখে হেঁটে যায় যৌবন।
হাজার ঘণ্টাধ্বনি গতিবেগ
যখন পেরোয় সবচেয়ে উঁচু পর্বত
শতাব্দীর জলছবি দেয়ালে তখনই পড়ে তোমার ছায়া।
কলকলিয়ে পার হয় একদল প্রাণ
প্রায়শই ঘুমে অদৃশ্য হবার তাগিদে।
অপেক্ষার ঘুম, চোখের আকুলতার ঘুম
সবুজ, বেগুনি, শর্ষে, খয়েরির ছোটাছুটির আঙিনায়
ছুটির চেয়ে অধিক প্রিয় সেই ঘুমপুরি।
চিঠিমালা
অভিযোগরা খাতাতেই পড়ে গুমরোল
তুমি তাদের ঘরে তুলে নিলে না।
কে জানে কোন খাতার ভাঁজে জলের নোনা দাগে
বা ছেঁড়া পাতার বেশে উড়ে যায়
সীমান্ত পেরিয়ে মরা নদীর দেশে।
সেখানেও তোমায় খোঁজাখুঁজি
সেখানেও রৌদ্র অবগাহন।
আজকাল তারা উড়তে শিখেছে।
তুমি বলেছিলে, খুঁজে না পেলে যেন কড়া না নাড়ি।
বলেছিলে, চিঠি লিখে পাঠালে
আরো কাছে পৌঁছানো যায়।
সেই কাল থেকে একাল অবধি নিয়মিত পাঠাচ্ছি
ঘুঙুর বাঁধা চিঠি।
চিঠিগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে পথ হারিয়েছে,
তোমায় হারিয়ে।
শব্দরাশি অংশুমালীর ছটা কব্জা করে
ধাক্কিয়েছে অনবরত।
বন্ধ শক্ত দরজায় কড়া নাড়া নিষেধ যে।
এত সহজে কেউ হারিয়ে যায়!
অভিযোগরা তাই আর নামেনি তোমার উঠোন থেকে,
গোলাপি আভা হয়ে ফুটে রোজ মিলিয়ে যাচ্ছে
মরা নদীর মোহনায়।
অঝোর
আজ তোমার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম,
যেখানটায় তুমি আমার জন্য ঠায় অপেক্ষায় আছো, সেখানটার খুব কাছে।
চার হাজার চারশো ছাব্বিশটি দীর্ঘদিন আর তমসার তৃষিত আঁখি,
তবুও হয় না দেখা তোমার আমার।
ক্ষণিকের অঝোর ধারায় হয় না ঝরা।
শুনেছি, তোমার হেলান দেবার জায়গাটায় লতাগুল্ম গজিয়েছে
লতাগুল্ম নাকি বৃক্ষ!
তারা কী জানে সেটা কাঁঠালি চাঁপাই হওয়া চাই।
পারোও তুমি থাকতে অপেক্ষায়
এক জায়গায় চুপটি করে।
আর আমি পর্বত, সাগর, নগর জয় করে ফিরে ফিরে আসি তোমার খুব কাছে, বারবার।
তবুও করি না দেখা
চার হাজার চারশো ছাব্বিশ দিন ধরে!