প্রয়োজন ফুরাইলে মমতা নিজেই সরি বইলা নিবেন

সাদ রহমান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০২৪

১৯৯৯ সালে বিজেপি আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে দাঁড়াইয়া অটল বিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা করছিলেন, বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ করা হোক।

বাজপেয়ীর দিক থেকে এই ঘোষণা ছিল সরাসরি ‘হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি’কে স্পষ্টভাবে গ্রহণ কইরা নেওয়ার পদক্ষেপ। এর আগপর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান ইনক্লুসিভনেসের ভদ্র ইমেজটা ধারণ করতেন। মানে খুল্লামখুল্লা ‘হিন্দুত্ববাদ’ করতেন না।

বিজেপির অন্যান্য শীর্ষ নেতারা, যেমন এল. কে. আদভানি, মুরলী জোশী, বা উমা ভারতী— এরাই মূলত বাবরি মসজিদ কেন্দ্রিক ‘হিন্দুত্ববাদে’র রাজনীতিটা আগাইয়া নিয়া যাইতো। কিন্তু এইভাবে হঠাৎ তাদের কাতারে বাজপেয়ীও যোগ দেওয়ার ফলে বাস্তবেই তখন বিজেপি ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী নেতারা চমকাইছিলেন।

ইফতার অনুষ্ঠানে দাঁড়াইয়া বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের আহ্বান করতে পারেন বাজপেয়ী—এইটা তাদের কাছে এক্সপেক্টেড ছিলো না। এই ঘটনাকে কেন্দ্র কইরা তখন ভারতের ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতিতে নতুন একটা ধাক্কা লাগছিলো।

একদিকে যেমন প্রমাণ হইছিল, খুল্লামখুল্লা হিন্দুত্ববাদ ছাড়া বিজেপির আর কোথাও যাওয়ার নাই, তেমনই ভারতের কপালেও লেখা হইয়া গেছিলো— ‘হিন্দুত্ববাদে’র এই চোদন ভারতকে সামনের দিনে আরও ভালোমতো খাইতে হবে।

২.
অটল বিহারি বাজপেয়ীর `হিন্দুত্ববাদী` আগমনের ঘটনাকে কংগ্রেসের নেতারা তো বটেই, অন্যান্য অঞ্চলভিত্তিক নেতারাও তখন সেকুলার ভারতের জন্য হুমকি হিসাবে দেখছিলেন। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হইলো, একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই তখন বাজপেয়ীর এই বক্তব্যকে অসুবিধাজনক মনে হয় নাই।

বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরি করার কথা বাজপেয়ী বা বিজেপি বলতে পারে— তিনি এই দাবি করছিলেন। অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুকে সম্ভবত চিনেন। নাইড়ু প্রথমে বাজপেয়ীর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্টে দিছিলেন। কিন্তু মমতা সেই নাইড়ুকেও নিয়া বাজপেয়ীয় সঙ্গে জোটে ঢুকাইছিলেন।

১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চন্দ্রবাবু নাইড়ু উভয়ই জোট কইরা নির্বাচন করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট না করলে অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্য জেতা কঠিন হইতো। হয়তো সম্ভব ছিল, কিন্তু মমতার ভূমিকাটা ক্রুশিয়াল ছিল সেখানে। ফল স্বরূপ, বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হইছিলেন।

এর দুই বছরের মাথায় মমতা যদিও দ্বন্দ্ব কইরা বিজেপির জোট থেকে বাইর হইছিলেন, কিন্তু ২০০৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবার বিজেপির সঙ্গে জোট কইরা নির্বাচন করছেন। এইসব তথ্য দেওয়ার কারণ একটাই, মমতার রাজনৈতিক চরিত্র ক্যামন— তা একটু পরিষ্কার করা। বাস্তব কারণেই আমাদের এইখানে মমতার রাজনৈতিক চরিত্র কী, তা পরিষ্কার থাকার কথা না।

মমতার কোন লিবারেল প্রতিশ্রুতি নাই। কখনো ছিলেও না। ‘হিন্দুত্ববাদে’র সঙ্গে মিলা যাবে না ধরনের কোন লিবারেল পজিশন তিনি নিজের জন্য রেডি রাখেন নাই। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে বসার দরকার হইলে বসছেন, বিজেপির সঙ্গে বসার দরকার হইলে বসছেন। তার প্রয়োজন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে শক্তি নিয়া দাঁড়ানো। এর জন্য সবরকম পদ্ধতিই তিনি ব্যবহার করছেন।

আল্টিমেটলি, বিজেপি ও মমতা উভয়ই উভয়েরটা খাইছে। আবার, ২০০৯ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট কইরা তিনি দ্বিতীয়বার রেলমন্ত্রীও হইছেন। তিনি এইরকম। শুনছেন নিশ্চয়ই, আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, মমতার বাংলাদেশে শান্তিবাহিনী পাঠানোর আবদারটা একটা ‘মমতা-মার্কা’ আবদারই হইছে। তিনি ভুল কিছু বলেন নাই।

৩.
বাংলাদেশকে নিয়া এইরকম মন্তব্য কইরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চিতভাবেই গর্হিত কাজ করছেন। এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আমলে রাখার মতো বিষয় হইলো, এই মন্তব্য কইরা মমতা আসলে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া অন্যভাবে বাংলাদেশের জন্যই কিছুটা সুফলের ব্যবস্থা করছেন।

পশ্চিমবঙ্গে কোনভাবে বিজেপি ঢুকলে বাংলাদেশের জন্য তা ভালো খবর না। মানে মমতার হাতে পশ্চিমবঙ্গে থাকার চাইতে সেটা খারাপ কিছুই হবে। ফলে বাংলাদেশকে অপমান করার মধ্য দিয়া হইলেও বিজেপিকে ঠ্যাকানো গেলে তার সুফল বাংলাদেশের পক্ষে যায়।

৪.
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গতকালকের বক্তব্যের ব্যাপারে আমাদের দুইটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার। এক, ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস স্বাধীনভাবে পশ্চিমবঙ্গে হাতে নেওয়ার পর—মমতার প্রধান ও একমাত্র শত্রু হইলো বিজেপি। কমিউনিস্ট পার্টি দিনে দিনে ঝইরা গেছে। আর কংগ্রেসেরও এইখানে মমতার বাইরে আলাদা কোন পরিকল্পনা নাই।

পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার পাঁয়তারা শুধুমাত্র বিজেপিরই আছে। ‘বাংলাদেশ’কে ইস্যু কইরা এখন বিজেপি যা করতেছে, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের অনেক ভোট মমতার কাছ থেকে সইরা যাওয়া স্বাভাবিক। আমি-আপনি যেটাকে ডিসইনফরমেশন বলি, সাধারণ বলদ মানুষদের কাছে তা ইনফরমেশনই। ফলে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে রাখতে হইলে মমতা এখন এই ডিসইনফরমেশের বাইরে আলাদা কোন পজিশন নিতে পারবে না। তাতে তার ভোটে বড় ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা আছে।

ফলে নিজের স্বভাবজাত ক্ষমতায় তিনি বিজেপির চাইতেও আরো বড় বিজেপি হিসাবে হাজির হওয়ার লাইন নিছেন।

দুই, কিন্তু খেয়াল করবেন—ভোট নিরাপদ করার জন্য মমতা আবার এমন এক লাইনে গেছেন যা বাস্তব অর্থে বাংলাদেশের জন্য কোনরকম থ্রেটই না। কংগ্রেসের নেতা শশী থারুর বিষয়টা স্পষ্টও করছেন। তিনি বলছেন, মমতা হয়তো জানেন না জাতিসংঘের শান্তি মিশনের কাজ কী। বিষয় হইলো—মমতা ঠিকই জানেন শান্তি মিশনের কাজ কী। আর জানেন বইলাই এইরকম একটা নন-ইফেক্টিভ রেটোরিক তিনি ব্যবহার করছেন ।যেখানে বাংলাদেশের বাস্তব কোন ক্ষতি নাই, কিন্তু কাজটা ঠিকই হাসিল হবে। যে-কারণে নরেন্দ্র মোদী নিজেও দেখবেন মমতার কথা শুইনা বেক্কল হইয়া গেছে।

জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে আছে এইটা যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানে, তেমনই জাতিসংঘও জানে ভারত হান্ড্রেড পার্সেন্ট ডিসইনফরমেশনের উপরে দাঁড়াইয়া এই হিন্দু-মুসলিম প্রোপাগান্ডাটা চালাইতেছে। এর কোনদিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কিছু নাই।

৫.
কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের প্রসঙ্গটা উঠলো বইলা একটু যোগ করি। শশী থারুর আরেকদিকে আবার মমতাকে টিটকারি কইরা কথা বললেন ক্যানো, ধরতে পারছেন?

প্রথমত, মমতার বক্তব্যটা যে বেইজলেস এই ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশের মানুষদের কাছে একটা অভয়-বার্তা পৌঁছাইছেন।

দ্বিতীয়ত, যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি খেয়াল করেন তারা জানেন—পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে একটা লোকদেখানো দ্বন্দ্ব চলে। সেই কাজটাও এই ফাঁকে শশী থারুর কইরা নিছেন।

গত নির্বাচনেও মমতা ও আর কংগ্রেস জোট না কইরা আলাদা-আলাদা ভোট করছে। এইটা হইলো আলাদা আলাদা ভাবে বিজেপির ভোট কাটার ব্যবস্থা। জোট করলে, আলাদা আলাদা কারণে ভোট কাটার পথটা সংকুচিত হইয়া যায়।

মমতার গতকালকের মন্তব্যের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা ও উদারচিন্তার মানুষেরা যেনো শাস্তি দেওয়ার জন্য বিজেপিকে ভোট দিতে না যায়, তার আগেই কংগ্রেসকে অপশন হিসাবে পায়—এই টিটকারিটা কইরা শশী থারুর তা নিশ্চিত করলেন।

বিষয়টা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হইলেও সত্য, বাংলাদেশকে নিয়া এই খারাপ রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপাতত কইরা যাইতে হবে। এর প্রতিউত্তরে আমরা যদি মমতাকে গালিগালাজ, তাতেও মমতার আসলে লাভই হবে। ফলে আমাদেরও।

৬.
যাই হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য নিয়া লেখার ইচ্ছা ছিল না। তবে লেখলাম—‘অপু’স কার্টুনে’র আজকের কার্টুনটা দেইখা। মোদী আর মমতা দুজন পাশাপাশি দাঁড়াইয়া গোলাপ ফুল রূপী হাসিনার স্মেল শুকতেছেন, অপু বিষয়টাকে এইভাবে দেখাইছেন। ঠিকই দেখাইছেন, আর কার্টুনটা বেশ ভালোই হইছে।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—এই দুইজনের স্মেলিংয়ের কারণ যে সর্বাংশে একই রাজনীতি না, কিছু ব্যতিক্রমও এর মধ্যে আছে সেইটা একটু স্পষ্ট কইরা রাখা দরকার মনে হইলো।  সেইজন্যই এই লেখা। ধারণা করি, এই খারাপ রাজনীতির প্রয়োজন ফুরাইলে মমতা নিজেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে সরি বইলা নিবেন।

লেখক: কবি