প্রিয়াংকা আচার্য্যর প্রবন্ধ ‘প্রক্ষিপ্ত চিন্তা’
প্রকাশিত : মে ০২, ২০২৩
আদি মানবের গুহা থেকে ঠিক কী করে আমরা এই মানবসভ্যতার পথ রচনা করলাম তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এমনকি ‘সভ্য’ শব্দটি বিচারে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ডও নেই। অন্যদেশের কথা বাদ দিলাম, এদেশেই মুরং নামে এক জাতি আছে, তারা শরীরের ঊর্ধ্বাংশে কোনো পোষাক পরে না। তাহলে আমরা কি তাদের অসভ্য বলতে পারি? রীতি-নীতি ও আদর্শের ব্যাখ্যা সমাজ থেকে সমাজে ভিন্ন।
তাহলে ঠিক কীসের ভিত্তিতে আমরা গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে লড়াই করি? সত্য, ন্যায়, অধিকার নাকি নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায়? ক্ষমতা... সভ্যতা ক্রমবিকাশের অন্যতম পাথেয় এ ক্ষমতা। ক্ষমতার আগ্রাসন। মানুষের চিন্তার শুরু থেকেই দার্শনিকেরা চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করতে, উৎস-গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে। বিংশ শতকের সাড়া জাগানো সার্ত্রে, রাসেল, ফুকো ‘ক্ষমতা’ নিয়ে অনেক বিস্তৃত কাজ করেছেন, যা আমাদের চিন্তায় ভিন্নমাত্রার গতিসঞ্চার করে। আবার সিমোন দা বুভোয়ারা কাজ করেছেন সামাজিক অধিকারের পাশাপাশি নারীর অধিকারের লক্ষ্যে। মহাশ্বেতা দেবীদের মতো অনেকে কাজ করেছেন আদিবাসীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে।
পরিবার, সমাজ, দেশ, মহাদেশ সর্বত্র ক্ষমতার অসমপ্রয়োগ। দ্বিতীয় বিশ্বহীন উদ্ভুত এক তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক আমরা। প্রথম বিশ্বের ক্ষমতা প্রদর্শনের এমনই দাপট। একইসঙ্গে বিস্ময়করভাবে প্রথমবিশ্বই আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে শাসন করে যাচ্ছে। অথচ শরীরের রং কালো-সাদা নিয়ে তারা অবলীলায় মানুষ হত্যা করছে। মধ্যাপ্রাচ্যে চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, লাখো শরণার্থী সব কিছু ফেলে চলছে অজানার পানে। আবার উত্তর আমেরিকাতে অস্ত্র বিক্রির ওপর ন্যূনতম নিষেধাজ্ঞার ফলে স্কুলগুলোতে চলছে অবাধ শিশু নিধন। যারা মানবতার কথা বলছে, অস্ত্র ব্যবসার রগরগে প্রদর্শনে তারা বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠাচ্ছে, যুদ্ধ করছে। তারা বলে, War For Peace! আবার রোহিঙ্গাদের সঙ্কটকে এড়িয়ে যেতে চাইছে কৌশলগত অজুহাতে। যেখানে আজকে বুদ্ধের বাণীও হার মানছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভিক্ষুর মারণমন্ত্রের কাছে। যে জার্মানির ফ্যাসিষ্ট শক্তি কোটি কোটি ইহুদি নিধন করেছে, কোটি রাশিয়ানকে হত্যা করেছে, জিপসি, সমকামী, মানসিক রোগিদের হত্যা করেছে, জার্মান সুপিরিয়ার রেইসের অজুহাতে পোলিশদের, রুমানিয়ানদের, বুলগেরিয়দের আনুষ্ঠানিকভাবে তেলাপোকা, ইঁদুর, আরশোলা নাম দিয়েছে, বিশ্বযুদ্ধ, শীতল যুদ্ধ ও বার্লিনের দেয়াল ভাঙার পরের উত্তর আধুনিক সেই জার্মানি আশ্রয়ের কোল বাড়িয়ে দিয়েছে অন্য ধর্মের, অন্য সংস্কৃতির লাখো লাখো সিরিয় শরণার্থীর দিকে।
প্রথম বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব, ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার যেরকম আছে, সেরকম আমাদের সচেতন হওয়া দরকার যে, এসব একাডেমিক বিশ্লেষণে স্থানীয় এবং ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব আড়ালের অজুহাত তৈরির অবকাশ আছে। এসব বিশ্লেষণে বিভিন্ন তত্ত্ব ঢুকিয়ে ঘৃণার বাস্প বাড়িয়ে দেয়া যায়, আবার সে ঘৃণাকে পুঁজি করে, পর সম্পদ অপহরণে বিভিন্ন সংঘাতকে উস্কে দেয়া যায়।
শান্তির জন্য যুদ্ধ! এও সম্ভব! সবাই বধির, মুক ক্ষমতার চপটেঘাতে। কাল থেকে কালে মানুষ যুদ্ধ করেছে। মহাভারতে অর্জুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন তার শিক্ষক, আত্মীয়-পরিজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে অপারগতা জানায় তখন তার বন্ধু ও রথের সারথী শ্রীকৃষ্ণ তাকে বোঝান যে, এ যুদ্ধ না হলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে না। অস্ত্র তাকে তুলতেই হবে। এরপরও তিনি অস্ত্র নিতে আপত্তি জানালে তিনি অর্জুনকে ত্রিকালের দর্শন দেন। পৃথিবীতে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কেই এমন বলা আছে যে, নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে দাবি করে ত্রিকালের দর্শন করান। সৃষ্টির আদি-অন্ত, মহাবিশ্বের অযুত নিযুত ছায়াপথ, নক্ষত্রের উত্থান-পতনসহ সকল জ্ঞান তিনি তার মুখের ভিতর দিয়ে অর্জুনকে প্রত্যক্ষ করিয়ে তাকে যুদ্ধের ময়দানে নামান। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ ও সৈনিকদের রক্তের বিনিময়ে কৌরববংশ নিশ্চিহ্ন হয়। এরপর কি পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অন্যায় হয়নি? পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে কৌরবদের অর্থাৎ ভাইয়ে ভাইয়ে জমি নিয়ে বিরোধ-হত্যা এখনও প্রতিদিনকার গড়পরতা খবর। তাহলে কেন যুদ্ধ? ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায়...! পৃথিবীকে একযোগে শাসন করতে থাকা মহাক্ষমতাবান ব্রিটিশদেরই এক কবি ম্যাথিও আর্নোল্ড আঠারোশ শতকে লিখে গেছেন:
Ah, love, let us be true
To one another! for the world, which seems
To lie before us like a land of dreams,
So various, so beautiful, so new,
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain;
And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and flight,
Where ignorant armies clash by night.
সম্রাট অশোক ঠিক এ কারণেই অনেক বেশি মানবিক। কলিঙ্গের যুদ্ধে ১০০ ভাই হত্যা এবং লাখো মানুষের মৃত্যু তাকে বোধিপ্রাপ্ত করে। একমাত্র তিনিই ক্ষমতার চূড়ায় গিয়ে তা ত্যাগ করতে পারার মতো মহানুভবতা দেখিয়েছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে সদা নীরব গৌতম বুদ্ধ আমার ভাবনাকে তাড়িত করে সবসময়। তিনি বলেছেন, আগে ভোগ করো, পরে ত্যাগ। যে ভোগের মর্ম জানে না, তার ত্যাগের মাহাত্ম্য নেই। ত্যাগ... মানুষ আসলে কতটুকু ত্যাগ করতে পারে? মারিও পুজো ‘গডফাদার’ উপন্যাসে লিখেছেন: ‘I will make him an offer he can`t refuse.’
সুতরাং আমাদের চারপাশের পরিবেশটা আসলে বৃত্তাকার। ইলেকট্রন-প্রটোনের মতো যে যার বলয়ে ঘুরপাক খাওয়া কেবল। গত শতকে লাল কেতাবের ছোবলে হাজারো তরুণ নিঃসঙ্কোচে প্রাণ দিয়েছে। শ্রেণিবিভেদহীন-অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্ত সমাজের মোহ দেখিয়ে কত বিভ্রান্ত বিপ্লব হয়েছে। হয়েছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ। ভাজা মুরগি, গণতন্ত্র এবং ভালোবাসা এ শতকের শুরুতে এখন পর্যন্ত বিক্রির শীর্ষে। তবুও মানুষ ভালোবাসে। ভালোবাসা...
Love looks not with the eyes, but with the mind;
And therefore is wing`d Cupid painted blind
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের এমন উক্তি মিছে নয়। প্রেম অন্ধ। ভালোবাসার জন্য চোখের দরকার নেই, প্রতিদিন দেখা হওয়ারও দরকার নেই। চোখের আড়াল হলে কখনও মনের আড়াল হয় না যদি সে মনে প্রেম থাকে। ইংল্যান্ড বা ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের উত্থানকাল এই শেক্সপিয়ারের আমল থেকেই শুরু। আর এর পেছনেও ছিল ‘ভালোবাসা’। রাণী প্রথম এলিজাবেথের বাবা রাজা অষ্টম হেনরি ভালোবেসে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কঠিন কিছু প্রথা ভেঙে দেন। খ্রিস্টধর্মে দ্বিতীয় বিয়ের প্রথা ছিল না তাই ধর্মীয় সকল রীতি তিনি নিজের মতো করে সাজান। সেসময় কট্টর ক্যাথলিকদের সঙ্গে তার এমন বিরোধ হয় যে অনেক চার্চ তিনি উঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মজার বিষয় সেসকল চার্চ বিল্ডিংগুলোতেই প্রতিষ্ঠিত আজকের অক্সফোর্ডের মতো বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অষ্টম হেনরির শাসনামলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদরতায় গোটা ইউরোপে শিল্প-সাহিত্যে রেঁনেসা যুগের অবতারণা হয়।
ভালোবাসার নারীকে নিয়ে জীবন পাড়ি দেয়ার আকাঙ্ক্ষাই যে পরবর্তীতে ইউরোপের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেবে তা হেনরি কোনো দিনও জানতে পারেননি। হেনরি শুধু তার নারীকে কামনা করেছিল। এ কামনার ফলশ্রুতিতে ক্যাথলিক চার্চের বিবাহবিচ্ছেদ বিরোধী অকাট্য নীতি থেকে বেরিয়ে যেরকম ইংলিশ প্রোটেস্টান্ট চার্চের শুরু হয়, সেরকম একইভাবে হেনরির শাষণে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতারও চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখা যায়। যাকে কামনা করে বিভিন্ন ছলচাতুরিতে হেনরি রানি বানাচ্ছে, আবার সামান্য অজুহাতে জনসমক্ষে তাকে কতল করতেও হেনরি পেছাচ্ছে না। রানি এলিজাবেথের মা আন বয়লিনকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল হেনরি। সে কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় প্রথম স্ত্রী স্পেনের রাজকুমারী ক্যাথরিনের সাথে। কয়েক বছর যেতে না যেতে হেনরি আন বয়লিনকে সন্দেহ করা শুরু করে। তারপর আগে থেকে নির্ধারণ করা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বিচারিক আয়োজন করে এবং আনকে পরিশেষে কতল করে। যে সংস্কার হেনরি তার ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে করেছিল। ব্যক্তির জন্য তা না করলেও, ইংল্যান্ডসহ গ্রেট ব্রিটেনের অন্যান্য রাজ্য ও উপনিবেশে যে কামজ সম্পর্কে, বিবাহে, বিবাহ বিচ্ছেদে যে তা প্রভাব ফেলেছিল, তা লেখা বাহুল্য।
বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, ‘মানুষ তার কাম দ্বারা তাড়িত।’ কাম এক ভয়ংকর সত্তা যা নিয়ন্ত্রণে রাখা ব্যক্তির কঠিনতম প্রয়াস। পুরাণে বলা হয় স্বর্গের একমাত্র সুখ কামের ভিতর দিয়ে মানুষকে ভোগ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। শরীরের ছন্দে ছন্দে দোলে অলীক সুখ। ভাঁজে খাঁজে কর্ষণে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোমন্থন, স্পন্দন, আলোড়ন। সেই আদিকালে বাৎসায়ন এমন আনন্দ পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার বিজ্ঞানসম্মত শাস্ত্রীয় বিধান রচনা করে গেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ভারতীয়রাই কাম নিয়ে পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রের জন্ম দিয়েছে। যদিও শিল্পচর্চায় আদিরসের ব্যবহার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। গ্রীক-রোমান মিথলজি, আরব্য রজনী এমনকি রামায়ণ-মহাভারতে আদিরসের ছড়াছড়ি। এতে স্পষ্ট যে, শুরু থেকেই সাধারণ মানুষকে নীতিকথা শোনানোর জন্য কামের রগরগে ব্যবহার হয়ে আসছে। গুহা মানবের চিত্রকর্ম, প্রাচীন মূর্তি, অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহ মন্দিরের শিল্পকর্ম সবই কামনির্ভর। নারী-পুরুষের কামের পূর্ণতায় জন্ম হয় নতুন প্রাণ। জন্ম, জন্মের পর পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে বেড়ে উঠতে সবচেয়ে বেশি সময় নেয়। জিনের গতি ও অভিজ্ঞতায় ধীরে ধীরে সে বেড়ে ওঠে। মাতৃজঠরের স্মৃতি মানুষকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই জন্মমুর্হূত বা সে দিনটির খুব গুরুত্বের। ব্যক্তির কাল নির্ধারণের নিক্তি এই জন্মতারিখ। অধিকাংশ ব্যক্তি বা তার পছন্দের মানুষেরা তাই বছর বছর দিনটি উদযাপন করতে পছন্দ করে। আপন মানুষদের কাছ থেকে অভিনন্দিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে। মৃত্যুর পরে মহান ব্যক্তিদের জন্মদিবস তাই আড়ম্বরে পালিত হয়। সবাইকে শুভ জন্মদিন!