আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

প্রাচ্য তাহেরের প্রবন্ধ ‘ঈশ্বর কণা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিশেবে যোগ দিয়েছেন ৩০ বছরের যুবক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। একদিন তিনি ক্লাসে মাক্স প্লাঙ্কের বিকিরণ তত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। মাক্স ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। তরুণ শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু খেয়াল করলেন, মাক্সের বিকিরণ তত্ত্বে কোথায় যেন একটা লুকোচুরি রয়েছে, ঠিকঠাক মিলছে না।

না মিললে তো চলবে না। সত্যসন্ধানী সত্যেন হাল ছেড়ে দেয়ার মানুষ নন। শেষমেষ তিনি নিজেই ওই ধাঁধার জবাব খুঁজে বের করলেন। তার এই পরিসংখ্যানই বিখ্যাত ‘বোসন কণা’। ৮৮ বছর আগে ঢাকায় আবিষ্কৃত এ তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় আজ খোঁজ পাওয়া গেছে ঈশ্বর কণার। সার্নের গবেষকেরা ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের কথা বিশ্বকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন। বোসন কণা, নাম বদলে যে হিগস-বোসন; সে-ই যে গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা, তার দেখা পাওয়ার কথা আজ প্রকাশ্যে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তরুণ শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে তত্ত্ব-কল্পনা আর গবেষণার বীজ বুনেছিলেন, পরবর্তী সময়ে যে গবেষণা ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ নামে বিশ্বজয় করেছিল, সার্নে আবিষ্কৃত কণাটি সেই গণনার নীতিই মেনে চলে। এ কারণেই হিগস কণাটি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামের ‘বসু’ অংশটি ধারণ করেই বসু কণা বা বোসন নামে পদার্থবিজ্ঞানে এখন পরিচিত।

বস্তুর ‘ভর’ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কণার ভর না থাকলে তা আলোর বেগে একাকী ছুটবে। ঘর বাঁধবে না কারও সঙ্গেই। অথচ বিশ্ব গড়েই উঠেছে কণার সমষ্টিতে, রূপ পেয়েছে পাহাড়, সমুদ্র, গাছ আমাদের শ্যামল পৃথিবী। ভর না থাকলে এর কিছুই থাকত না। বোসনসদৃশ এই ঈশ্বর কণাই অন্য কণাদের ভর জোগায়। সেই হিসাবে মানুষের মূলেও এই ভর।

১৯২১ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ৩০ বছরের তরুণ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। নতুন জায়গায় শিক হিসেবে এসে খানিক অস্বস্তিতে ভোগা সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা পৌঁছে কলকাতায় সতীর্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে চিঠিতে সে বিষয়ে লিখছেন, ‘কাজকর্ম এখনো শুরু হয়নি। যদিও এখানে অবহেলায় অগোছালো স্তূপাকার ঢের কাজ জমা হয়ে আছে। আমাদের এখানে বইপত্তর, জার্নাল একেবারেই নেই। অবশ্য কেনার জন্য কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। আলাদা একটি বিজ্ঞান পাঠাগারের বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে, আলোচনা চলছে।

চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে, খুব পরিপাটি কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন তিনি। তার চেতনায় প্রবল জ্ঞানতৃষ্ণা। নইলে বাক্স-পেটরা ঠিকঠাকমতো খোলাই হয়নি, এমন পরিস্থিতিতে বসে কেমন করে ভাবলেন, আলাদা পাঠাগারের কথা। খুঁজে বের করে ফেললেন যে, এখানে জার্নাল নেই! শুধু জ্ঞানতৃষ্ণাই নয়, জ্ঞান বিস্তার ও মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাই যে বিজ্ঞানের আলো সারা দেশে ছড়িয়ে দেবে; তার চেয়ে স্পষ্ট করে এ ভাবনা বোধহয় আর কেউই ভাবতে পারেননি।

তিনি বলেছিলেন, ‘যারা বলেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।’ অথচ ইংরেজি শিক্ষার চল তাদের পরিবারে তিন পুরুষের। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। পূর্বপুরুষের আদি বাস নদীয়া জেলায় হলেও কলকাতার গোয়াবাগানে বেড়ে ওঠা। ১৯০৯ সালে হিন্দু কলেজ থেকে পঞ্চম স্থান পেয়ে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে আইএসসি, ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্সসহ বিএসসি, ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে এমএসসি। তিন পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ যার সহপাঠী, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় যার শিক্ষক; সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে বোসনের জনক হবেন, তা যেন ভবিষ্যৎই ঠিক করে রেখেছিল।

স্বভাবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্ভবত বেশ নাছোড়বান্দাই ছিলেন, নইলে যে বোসন আর আজকের ঈশ্বর কণা অধরাই রয়ে যেত। ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক। এদিকে কয়েক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের নিভৃতে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের জন্য নোবেলজয়ী প্লাঙ্কের বিকিরণ তত্ত্বের হিসাব মেলাতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বারবার ভাবনায় পড়ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, এ হিসাবে কোথায় যেন খানিকটা লুকোচুরি রয়েছে, মিলছে না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো করে একটি পরিসংখ্যান বের করলেন ছাত্রদের পড়ানোর প্রয়োজনেই! এভাবেই অকস্মাৎ ‘বোসন কণা’ খুঁজে পেলেন তিনি।

১৯৭০ সালে জগদীশ মেহরাকে দেয়া সাাৎকারে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেন, আমার নিজস্ব পন্থাতেই আমি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতাম। কোনো শিক্ষকের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে নয়, বরং আমি নিজেই এ সমস্যার সমাধানে তা জানতে চেয়েছিলাম।

তার সেই জানতে চাওয়া আর নিজস্ব পন্থার ফলাফল নিয়ে চার পৃষ্ঠার এক গবেষণাপত্র লিখলেন বসু। নাম, ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য লাইট-কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস’। পাঠালেন লন্ডনে, ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনের দপ্তরে। যারা এর আগেও তার গবেষণাপত্র ছেপেছিল। কিন্তু এবার না ছেপে পাঠাল ফেরত। বুস এবার তা বার্লিনে পাঠালেন, আইনস্টাইনের কাছে। সে গ্রীষ্মে আইনস্টাইনের নোবেলপ্রাপ্তির তিন বছর হয়েছে। বার্লিনে, তার বাড়ির চিঠির বাক্স উপচে পড়ে গবেষণার অনুরোধ থেকে শুরু করে বিচিত্র ধরনের সব চিঠিপত্র, আবেদন-নিবেদন ভরা অসংখ্য কাগজে। সেগুলো থেকে বাছতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণাপত্রটির সঙ্গে পাঠানো চিঠিতে আইনস্টাইনের নজর আটকে গেল।

সে চিঠিতে আইনস্টাইনকে ‘শ্রদ্ধেয় গুরু’ সম্বোধন করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, ‘পর্যবেক্ষণ আর মতামতের জন্য আপনার কাছেই এ প্রবন্ধ পাঠালাম। পড়ার পর আপনি কী মনে করেন তা জানার জন্য তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে অপো করছি। লেখাটি জার্মানে অনুবাদ করার মতো যথেষ্ট ভাষাজ্ঞান আমার নেই। যদি মনে করেন এটি ছাপার যোগ্য, সেক্ষেত্রে এটি সাইট ফুইর ফিজিকে প্রকাশের ব্যবস্থা করলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। যদিও আপনার কাছে আমি অপরিচিত, তবু এ অনুরোধের জন্য আমার মনে কোনো দ্বিধা কাজ করছে না। কারণ আমরা সবাই আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু চিঠি শেষ করেছিলেন এর আগেও যে তিনি কলকাতা থেকে আইনস্টাইনের অনুমতি নিয়ে তার লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেনক, সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে। সম্ভবত চিঠির ভাষার তীক্ষ্ম সারল্য আর গবেষণাপত্রটির অভিনবত্ব আইনস্টাইনকে আকৃষ্ট করেছিল, ফল? মাস খানেকের মধ্যে আইনস্টাইনের হাতে সত্যেন্দ্রনাথের সে লেখাটি জার্মান অনুবাদে কাঙ্ক্ষিত সেই সাইট ফুইর ফিজিতে প্রকাশ। বসুর এ গবেষণাপত্রকেই কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিকসের প্রারম্ভ বা সূচনা বলে ধরা হয়।

অবশ্য আইনস্টাইনের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ শুধু সাইটসিফট্ ফর ফিজিকে তার লেখা প্রকাশ আর খ্যাতিই নয়; সত্যেন্দ্রনাথের কাছে আইনস্টাইনের হাতে লেখা একটি পোস্টকার্ডের কয়েকটি শব্দের কল্যাণে ইউরোপের দরজা খুলে গিয়েছিল তার সামনে। পেয়েছিলেন উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে দীর্ঘ আরাধ্য দুই বছরের ছুটি। তাকে আইনস্টাইনের লেখা সেই পোস্টকার্ড দেখিয়ে বিনে পয়সায় জার্মান ভিসাও পেয়েছিলেন বসু। আইনস্টাইনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাক্ষাৎ হয় ১৯২৫ সালের শেষের দিকে, বার্লিনে। এর মাঝে প্যারিসে মোরিস দ্য ব্রোগলির সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, মেরি কুরির সঙ্গেও তার গবেষণাগারে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কিছুদিন কাজ করেছেন বসু।

আইনস্টাইনের সঙ্গে কাজ করার তীব্র আগ্রহ থাকলেও শেষপর্যন্ত নিরাশই হতে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথকে। হয়তো এরই প্রভাবে দেশে ফেরার পর বাকি জীবনে খ্যাতি, সম্মান, ভারতের জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম প্রাপ্তি থেকে শুরু করে ভারত আর বাংলাদেশে তার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সব পদে অধিষ্ঠান করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ বিজ্ঞানী ‘বোসন’ কণার জনক হয়েছিলেন, আইনস্টাইনের কাছ থেকে শেষের দিকে একধরনের নির্লিপ্ত উপেক্ষার পরবর্তী সময়ে তিনি আর সেভাবে জ্বলে ওঠেননি! আইনস্টাইন তখন গূঢ়-জটিল গবেষণায় মগ্ন, তরুণ এই একলব্যের প্রতি তিনি আর নজর দেয়ার ফুরসত পাননি! সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৬ সালে ঢাকা ফেরার পর দীর্ঘদিন আর কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশে আগ্রহী হননি।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদার্থবিজ্ঞানের উঠোন ডিঙিয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দর্শনে, নৃতত্ত্বে, সাহিত্যে, সংগীতে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে একসময় অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বসু যেন স্বীকার করেই নিয়েছিলেন, আমি আর বিজ্ঞানের সঙ্গে ছিলাম না, আমি ছিলাম অনেকটা ধূমকেতুর মতো; যা আসে কেবল একবারই, আর কখনোই ফিরে আসে না।