প্রবহমান মানুষের চেনা গল্প ‘ঘুমঘরের সুখ-অসুখ’
মেহেদি ধ্রুবপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০১৯
এই সময়ের গল্পকার সাদিয়া সুলতানার ‘ঘুমঘরের সুখ-অসুখ’ গল্পগ্রন্থ পাঠ করে পাঠক একবারও বলবেন না, ‘ধুর, বেহুদা সময়টা নষ্ট হলো’, বরং পাঠক একটা তৃপ্তি পাবেন, কোনো কোনো গল্পের বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবতে বসবেন আর মনে মনে বলবেন, ‘আরে, এই গল্প তো আমিও জানতাম।’ অর্থাৎ এই গ্রন্থের গল্পগুলোর বিষয়-ভাবনা, পরিবেশ-বিন্যাস ও পাত্র-পাত্রী মানুষের পরিচিত ভূগোলে বিরাজমান, চোখ মেললে হয়তো আশপাশে দুয়েকজনকে পাওয়াও যেতে পারে। ফলে গল্প পড়া শেষে মনে হয়, ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’
গল্পের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে হয়তো নতুন কোনো শৈলী নির্মাণের চেষ্টা, নতুন কোনো বাঁকের সন্ধান কিংবা নতুন কোনো ইজম প্রয়োগের প্রয়াস পাওয়া যাবে না; কিন্তু এই বিষয়ে গল্পকার অবগত আছেন বলেই মনে হয়; বোধকরি গল্পকারের প্রধান অন্বিষ্ট গল্পের ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষা নয়; বরং বাস্তব অভিজ্ঞতায় জারিত চেনা মানুষের যাপিত-জীবন ও তাদের বিচিত্র সংকটকে ভাষারূপ দেয়া। গল্পকার দেখাতে চান, চেনা-জানা গল্পের মধ্যেও যে অভিনবত্ব আছে, ঘটে চলা ঘটনার মধ্যেও যে জাদু আছে, প্রচলিত শৈলীর মধ্যেও যে চমক আছে, পরিচিত ঘটনার মধ্যেও যে গতি আছে, সাদামাটা কথার মধ্যেও যে কৌতূহল আছে তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের নামই আর্ট। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ ও সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল করে উপস্থাপন করা মহৎ আর্টের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই আর্ট তরল নয়, ধীর নয়, স্থির নয়, বরং তা গভীর, গতিময় ও চঞ্চল।
‘ঘুমঘরের সুখ-অসুখ’ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘তিরু, তোর জন্য’ একটি হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে রাধার আত্মকথনে বর্ণিত। এই গল্পের ঘটনা-বিন্যাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় বোন রাধা পড়ালেখায় অধিক মনোযোগী হলেও ছোট বোন তিরু, যে দেখতে অত্যধিক সুন্দর, যাকে পরিবারের সবাই প্রশ্রয় দেয়, স্নেহ করে, যে সবাইকে প্রাণবন্ত করে রাখতে পারে সে-ই যখন রাতের আঁধারে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় তখন তার পরিবারে নেমে আসে মারাত্মক দুর্ভোগ। এই পুরুষশাসিত অর্ধ-শিক্ষিত সমাজ-ধর্মে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাবার আগে ছোট বোনের পালিয়ে যাবার মতো ভয়াবহ ঘটনায় একটা পরিবার সামাজিকভাবে কতটা অপদস্থ, কতটা অপমানিত ও কতটা বেকায়দার মধ্যে পড়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও গল্পের শেষে আপাতত দৃষ্টিতে দেখা যায় তিরু সুখেই আছে, কিন্তু এই সুখে আছে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ, ব্যক্তিস্বার্থের অদৃশ্য কৃমি, যে কৃমি মগজে বসে থেকে ঘৃণার জন্ম দেয়; যেকারণে গল্পের বড় বোন রাধা বা তার পরিবারকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায় না; উল্টো রাধার মনে হয়েছিল, বরং আমাদের বুকের অতলে ক্রোধের এক অদ্ভুত বোধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
‘ভদ্রলোক’ গল্পের বিষয়-আশয়ও ‘তিরু, তোর জন্য’ গল্পের মতো পরিবার-সমাজের চেনা-জানা ভূগোল থেকে নেয়া, আশেপাশে বসবাসরত পরিচিত মানুষকে নিয়ে লেখা, যে মানুষ ভদ্রলোকের মুখোশ পরে দিনানিপাত করে। গল্পকার মধ্যবিত্তের আত্মিক সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ‘ভদ্রলোক’ শব্দটিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার মধ্য দিয়ে, যেখানে শেষ পর্যন্ত প্রধান হয়ে উঠে বর্তমান প্রযুক্তি-নির্ভর পৃথিবীতে বদলে যাওয়া মূল্যবোধে বিশ্বাসী স্বাধীনচেতা মানুষের একাকিত্ববোধ, নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ববোধ ও পলায়নপর মনোবৃত্তিকে। গল্পে দেখা যায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হায়দার নরকের মতো দাম্পত্য জীবন থেকে রেহায় পেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করলেও অসুখী মনে হয় না, কিন্তু তার মনের গহিনের মানবিকতার শেষ সুতোটুকুর প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে হায়দারের জীবনের কষ্ট ও হাহাকার প্রকাশ পায় উচ্চবিত্তের এক পার্টিতে গিয়ে, যে পার্টিতে এক উচ্চবিত্তের স্ত্রী তার শরীর স্পর্শ করে, কামের জন্য আহ্বান করে, কিন্তু দ্বিধাজর্জরিত হায়দার হ্যা বলতে পারে না, বরং সে হয়ে ওঠে অস্থির, কোনোদিন মাতলামি না করলেও সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হায়দারের হৃদয়ের আর্তি ও নিঃসঙ্গতা পাঠককে চমকে দেয়; সেই সঙ্গে বাঙালি সমাজের ভদ্রলোকদের প্রতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ লক্ষ করা যায়; গল্পের এক জায়গায় হায়দার মাতাল হয়ে বলে, ‘ভদ্রলোকেরা কখনো মাতলামি করে করে না’; এই সংলাপের মধ্য দিয়ে নামধারী ভদ্রলোকদেরকে চূড়ান্তভাবে বিদ্রূপ করা হয়েছে।
‘মৃত্তিকা মানুষ’ মুক্তিযুদ্ধের গল্প হলেও পূর্ববর্তী গল্পগুলোর মতো এই গল্পটিতেও চিরায়ত মধ্যবিত্তের ছক থেকে গল্পকার বের হতে পারেননি কিংবা বের হতে চাননি। গল্পকার দেখাতে চান যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও সরকারি চাকরিজীবীদের একটা অংশ অবস্থানগত কারণে বা স্বার্থের কারণে বা সাহস কম থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেনি, কিন্তু তাদের এই অংশগ্রহণ করতে না-পারা তাদেরকে স্বস্তি দেয়নি; বরং পদে পদে আত্মগ্লানিতে ভুগিয়েছে। এই গল্পের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নিজামউদ্দিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি, কিন্তু তারই চোখের সামনে তারই অধীনে চাকরিকরা নিম্নবিত্ত কেয়ারটেকার লতিফ পেরেছিলো। ফলে গল্পের নিজামউদ্দিন তার অক্ষমতা ও ব্যর্থতার কথা ভুলতে পারেন না, তার স্মৃতি-বিস্মৃতিতে লতিফ ঘুরে ফিরে আসে, তার চেতনায় বারবার অনুরণিত হয় লতিফের যুদ্ধে যাবার মুহূর্তে বলা কথাগুলো, ‘স্যার, মইরা লাভ কী? যাই মাইরা আসি।’
‘মেহেরুন ও অনন্ত ঘুমকাল’ গল্পটিও মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প, যে গল্পের কেন্দ্রে আছে উচ্চশিক্ষিত মেহেরুন নামের এক মেয়ে; যে ভাগ্যের কাছে পরাজিত, যে জীবনের কাছে পরাজিত, যে ডানাভাঙা পাখির মতো তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যায়। এই গল্পে পূর্ববর্তী গল্পগুলোর তুলনায় কাহিনি বিস্তার বেশি, যেখানে মেহেরুনের জীবনের ট্রাজেডি দেখাতে গিয়ে নিশি নামের এক পতিতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যে পতিতা আবার মেহেরুনের বাবাকে বিয়ে করে ধন সম্পত্তির লোভে এবং পরিকল্পনামতো মেহেরুনের পরিবারের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়। পতিতাকে বিয়ে করা এবং সেই পতিতার ছলা-কলায় সর্বস্ব হারানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের আত্মিক ও মনস্থাত্ত্বিক সংকটের চূড়ান্তর রূপ পরিলক্ষিত হয়।
‘সমুদ্রডাকিনী’ গল্পটিতে মধ্যবিত্তের পারিবারিক ও সাংসারিক সংকটের বিপরীতে চিত্রা নামের এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমণীর জীবনের গল্প প্রতিভাত হয়; যে রমণী শিশু কাল থেকে মৎসকন্যার গল্প শুনে মৎসকন্যা হতে চেয়েছে, যে রমণী শৈশব থেকে জেনে এসেছে তার মতো সুন্দরী, রূপবতী দ্বিতীয়টি নেই। ফলে তার মনস্তত্ত্বে যে দম্ভ সৃষ্টি হয়েছে সে মনস্তত্ত্ব সে দম্ভ শেষ পর্যন্ত তাকে নিঃসঙ্গ করেছে। গল্পের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নয়ন, সবুজ ও সৌরভ নামের তিনটি পুরুষ তার জীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে। ছাত্রজীবনে শত শত তরুণের হার্টথ্রব বনে যাওয়া চিত্রা সহপাঠী নয়নের প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে নয়ন আত্মহত্যা করে, কিন্তু এই আত্মহত্যা চিত্রাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি; বরং তার দম্ভ ও অহংকার বেড়ে যায়, তার মনে হয়েছে ছেলেরা তার জন্য আজকাল আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। নিজের রূপ যৌবন নিয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী চিত্রা কর্মজীবনে বিয়ে করেছে সহজ-সরল ও হৃদয়বান সংসারী ছেলে সবুজকে; কিন্তু এখানেও চিত্রার স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্চাবিলাসী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়, বিয়ের এক বছরের মাথায় সবুজকে ডির্ভোস দেয়, কিন্তু তারপরও তার জীবনে স্থায়ী শান্তির প্রমাণ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত সৌরভ নামের একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়; কিন্তু অচিরেই সেই সম্পর্কের অবসান চিত্রাকে অনুশোচনা ও ভাবনার মধ্যে ফেলে। কারণ, বুদ্ধিমান সৌরভ চিত্রার ছলনাময়ী চরিত্রের সন্ধান পায়, ফলে চিত্রার জীবন থেকে সরে যায় সৌরভ। চিত্রা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, তার বারবার মনে পড়ে নয়ন কিংবা সবুজের কথা, বারবার মনে হয় কেউ এসে বলুক ‘চিত্রা ওঠো, চিত্রা! চলো গান গাই। চলো সমুদ্রতীরে যাই।’ পারিবারিক প্রশ্রয় ও সঠিক শিক্ষার অভাবে একটা মেয়ে কীভাবে নিজের শারীরিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে স্বেচ্ছাচারি ও হৃদয়হীনা হতে পারে, কীভাবে সেই স্বেচ্ছাচারি মনোভাব একসময় তাকে অনুশোনার আগুনে পোড়াতে পারে, কীভাবে নিঃসঙ্গবোধ ঘিরে ধরে, কীভাবে স্মৃতিরোমন্থনে অতীতকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে তার শব্দায়ণ লক্ষ করা যায়।
‘আশার মতো মিথ্যে নেই’ গল্পটিতেও মধ্যবিত্তের গার্হস্থ্য জীবন নেই, বরং একজন পুরুষের প্রতিবাদী চেতনা ও নাছোড়বান্দা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়; এই রকম চরিত্রের জন্য এলাকার মানুষ তাকে ‘ঠ্যাটা ইলিয়াস’ নামে ডাকলেও অকৃতদার ও প্রতিবাদী ইলিয়াস আয়নামতি নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু তার আশা শেষ পর্যন্ত নিরাশায় রূপ নেয়, কেননা রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করে। গল্পের শেষ পরিণতি প্রমাণ করে, মানুষের বিবেকহীনতা ও স্বার্থান্বেষী মনোভাব কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
‘শব্দবাজি’ গল্পটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত হলেও গল্পের ভেতরের গল্পে বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মিক সংকট প্রাধান্য পায়। আলোচ্য গল্পটি একজন লেখকের বয়ানে বর্ণিত, যেখানে প্রথমেই লেখকরাজনীতি ও পুরস্কার বাগিয়ে নেবার প্রসঙ্গ এসেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখকের লেখা গল্পটিই গল্পের মূল গল্প হয়ে ওঠে; যেখানে পরকীয়ায় আসক্ত স্ত্রীকে হত্যার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে।
‘হারিয়ে যাওয়ার আগে’ শাফিনুর রহমান ছোটন নামের এক কিশোরের আত্মকথনে বর্ণিত অসম প্রেমের গল্প। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছোটনের সঙ্গে পাশের বাড়ির মনিকা আপার স্বাভাবিক সম্পর্ক মনে হলেও শেষ পর্যন্ত ছোটন মনিকার আপার প্রেমে পড়ে আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত হয়। মনিকা আপাকে বলতে না পারা, মনিকা আপার চাকরি হয়ে যাওয়া বা মনিকা আপার বিয়ে নিয়ে কিশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করা ছোটনের মানসিক সংকট প্রকাশ পায়; যেখানে বন্ধু ফিরোজের প্রস্তাবে মনিকা আপার প্রতি ছোটনের অবচেতন মনের কুৎসিত বাসনা ফুটে ওঠে।
‘আগন্তুক’ গল্পটিতে কাশেম নামের এক বাবার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ও শহরে আগন্তুককে শক্তিমান কোনো মহাপুরুষ ভেবে আশা-ভরসা প্রকাশ পেয়েছে।
‘জল কিংবা পানি’ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আশ্রয় করা লেখা অসাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গল্প এবং গল্পটি হয়ে উঠে পাশাপাশি বসবাসরত হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও মানবিকতার আখ্যান।
এই গ্রন্থের শেষ গল্প ‘মিতালি’ মানবীয় সম্পর্কের গল্প। গল্পে দেখা যায়, প্রবাসী রবির সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত নিঃসঙ্গ চল্লিশোর্ধ্বো মিতালি নামের এক নারীর ফেইসবুকে পরিচয় হয় এবং তা থেকে বন্ধুত্ব, চ্যাটিং, শেয়ারিং ও কেয়ারিং দারুণভাবে জমে ওঠে; কিন্তু পরক্ষণেই দেখা যায় রবিকে ছেড়ে চলা যাওয়া স্ত্রী মলি ফিরে এসেছে, ফলে আবারো নিঃস্ব হয়ে ওঠে মিতালি এবং তার বারবার মনে পড়ে এক সময়ের প্রেমিক তৌহিদের কথা, যে তৌহিদ পাশের বাসার ভাবীর পোষা বিড়ালের মতো আদর পেয়ে অনেক কিছু নিয়ে পালিয়েছে। গল্পের এই পর্যায়ে বিড়ালের বিষয়টি প্রতীকী হয়ে ওঠে। গল্পটি রবি ও মিতালির আত্মকথকে বর্ণিত হলেও একবার রবির দৃষ্টিকোণ থেকে আরেকবার মিতালির দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত এটি মিতালির একার গল্প, যেখানে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে মিতালির নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব এবং একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাবার মর্মান্তিক চিত্র।
সাদিয়া সুলতানার ‘ঘুমঘরের সুখ-অসুখ’ গল্পগ্রন্থ পাঠান্তে পাঠকের কাছে মনে হবে, ‘হ্যাঁ, এতক্ষণ গল্পই পড়েছি।’ কিন্তু এই গল্প বাঙালি নিম্নবিত্তের নয় কিংবা উচ্চবিত্তের নয়; এই গল্প মধ্যবিত্তের অন্তরের গল্প, পরিবারের গল্প, সমাজের গল্প; তবে এখানে নারীদের জীবনকে প্রধান করে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ গল্পের কেন্দ্রে আছে একজন নারী; এইসব নারী কখনো শোষিত ও নির্যাতিত আবার কখনো শোষক ও উৎপীড়ক; আবার কখনো প্রেমময়ী, কখনো ছলনাময়ী; অর্থাৎ নারীকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো সত্তাকেই তুলে ধরা হয়েছে; তবে নারীর গল্প হোক কিংবা পুরুষের গল্প হোক মূল প্রেরণা কেন্দ্রচ্যুত হয় না; আর এই মূল প্রেরণা হলো মানুষ, স্পষ্ট করে বললে গল্পের অস্থি-মজ্জায় মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব ও প্রবণতার পরিবর্তন হয় না। এখানে স্মরণীয় যে বর্তমান সময়ের তরুণদের অনেকের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ করা যায় যে, তারা তাদের গল্পটা বলতে গিয়ে একটা আড়াল, একটা ধোয়াশা, একটা ঘোর তৈরি করেন, যেখান থেকে গল্পটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে, ভাষার প্রতি অধিক মনোযোগ বা কাব্যিকতার কারণে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, কিন্তু সাদিয়া সুলতানার গল্প পড়ার পরে মনে সে অতৃপ্তি থাকে না, দারুণ তৃপ্তিতে মন ভরে যায়।
বর্তমান সময়ের অনেক গল্পকারের গল্পে দুর্বোধ্যতার দোষ আছে বলে মনে করেন অনেকে, যেখানে দর্শন বা বিষয়টা মুখ্য হয়ে ওঠে; ঘটনা, চরিত্র বা গল্পের নাটকীয়তা ফুটে ওঠে না, কিন্তু সাদিয়া সুলতানার গল্প বলার সাবলীল ঢং, চমৎকার ভাষা-বিন্যাস, পরিবেশ অনুসারে অলংকার প্রয়োগ ও নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যায়। প্রায় সবগুলো গল্পে মধ্যবিত্তের আঁতের খবর, তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো প্রাধান্য পায়; ফলে গল্পগুলো হয়ে উঠে মানবিক-অমানবিক মানুষের গল্প, এদেশের মানুষের গল্প, শিক্ষিত বাঙালির গল্প, এই সময়ের গল্প, প্রবহমান মানুষের চেনা গল্প। আর এই চেনা গল্প শোনার জন্য কান পেতে বসে থাকার প্রয়োজন আছে, যে প্রয়োজন পাঠকের শিক্ষা-সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব ও মনস্তত্ত্বকে এবং বাংলা ছোটগল্পের ধারাকে দিবে ঋদ্ধি কিংবা প্রসিদ্ধি।
ঘুমঘরের সুখ অসুখ। সাদিয়া সুলতানা
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান । প্রকাশক: চৈতন্য । মূল্য: ২৫০ টাকা।