প্রত্যাশার চাপ, এরপর আত্মহত্যা

সানোয়ার রাসেল

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০২৩

সদ্য গোঁফ গজানো বালখিল্য কোনো কিশোর বা তরুণের জন্য এই লেখা নয়। এরই মধ্যে যারা সেই বয়সটা পেরিয়ে বাবা-মা হয়েছেন কিংবা হবেন, লেখাটি আপনাদের পড়তে অনুরোধ করছি।

 

প্রত্যয় বড়ুয়া নামের একজন স্টুডেন্ট বুয়েটে চান্স না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই শিরোনামে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। এইচএসসি পাশ করা একটা স্টুডেন্ট, যার জীবন মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে, যে নিজ পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে সবে বাইরের দুনিয়া তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ পরিসরে পা রাখতে চলেছে, তার মধ্যে কী এমন চাপ তৈরি হয় যা সে সহ্য করতে পারে না? কারা তৈরি করে এই মারাত্মক অসহনীয় প্রত্যাশার চাপ? যেই চাপ সহ্য করতে না পেরে একটা কিশোর দুনিয়া দেখার আগেই দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়?

 

জানতে পারলাম, প্রত্যয় বড়ুয়ার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে বুয়েটে পড়বে। সেখানে চান্স না পাওয়ায় বাবা নাকি ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন না! জরুরি কথা কাগজে লিখে দিতেন। ছেলে বুয়েটে না হোক, বুটেক্সে চান্স পেয়ে কিন্তু ঠিকই তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিল। তবুও তার মা নাকি বলেছিল, বুটেক্সের মেধাতালিকায় এত পিছনের দিকে সে নাকি ডিজার্ভ করে না! পরিবারের সকলের চোখ তাকে ব্যর্থ আর হেরে যাওয়া একটা মানুষ হিসাবে প্রমাণ করেছেন আপনারা, প্রত্যয়ের বাবা এবং মায়েরা। জানি না এসব সংবাদ সত্য কিনা। সত্য হলে এর চেয়ে ভয়ানক দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।

 

আমার নিজের কথা একটু বলি। আমরা ছিলাম গ্রেডিং সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ, যেই ব্যাচে সারা বাংলাদেশে মাত্র ৭৬ জন এ প্লাস পেয়েছিল। সেই ব্যাচে ৪.৭৫ পাওয়া মানেও বিরাট রেজাল্ট। তো, ভালো স্কুল থেকে ভালো রেজাল্ট করে পাশ করায় আমার যখন পাঙ্খা গজিয়েছিল, তখন গোঁ ধরেছিলাম ঢাকার কোনও কলেজে এইচএসসি পড়বো। বাবা-মায়ের শত কষ্ট হলেও ঢাকায় রেখে কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছিলেন।

 

না। তাদের ও আমার নিজের আশা অনুযায়ী নটরডেমে চান্স পাইনি। তাই বলে আমার বাবা-মা খোটা দিয়ে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন বলে ফিরিয়ে আনেননি। আমার ঢাকায় পড়ার ইচ্ছাকে পূরণ করতে সাপোর্ট দিয়েছেন। আব্বাকে ময়মনসিংহে রেখে আম্মা আমার সঙ্গে থাকার জন্য ঢাকায় চলে এসেছিলেন।

 

কি ভাবছেন? এই সাপোর্ট পেয়ে আমি বাংলা সিনেমার হিরোর মতো হেব্বি লেখাপড়া করে ইন্টারে বিরাট রেজাল্ট করে ফেলেছি? না, ঢাকার লাল নীল বাত্তি দেখে দেখে জীবনের মূল্যবান দুইটা বছর হেলাফেলা করে ইন্টারের রেজাল্ট এসএসসির চেয়ে বরং খারাপ করেছি। আমার ইচ্ছা ছিল, এইচএসসি পাশের পর বুয়েট কিংবা অন্য কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে আর্কিটেকচারে পড়বো। আব্বার ইচ্ছা ছিল মেডিকেল। আমার ইচ্ছা অনুযায়ী বুয়েট ভর্তি কোচিং-এই ভর্তি করিয়েছিলেন আমার বাবা-মা। কিন্তু রেজাল্ট আউট হবার পর দেখা গেল, আমি বুয়েটে পরীক্ষাই দিতে পারি না!

 

কি মনে হয়? আব্বা-আম্মার মন খারাপ হয়নি? নিশ্চয় হয়েছিল। কিন্তু আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য তারা তাদের মন খারাপকে প্রশ্রয় দেননি। বুয়েটে পরীক্ষা দিতে পারবো না, সো হোয়াট! আমার জন্য তারা ঢাবি, বাকৃবি, রাবি, কুয়েট আর মেডিকেলের ফর্ম কিনে এনেছিলেন। আমি বাকৃবিতে চান্স পেয়ে যাওয়ায় আর কোন ভার্সিটিতে পরীক্ষাই দিতে যাইনি। আর আব্বার ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু আমার সেখানে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না।

 

সেই সব পিছিয়ে পড়ার দিনে যদি আমার আব্বা-আম্মা আমার পিঠে হাত না রাখতেন, আমার হাতটা ধরে একটু এগিয়ে না দিতেন, তাহলে আমি আজকে যেখানে আছি, সেই অবস্থানে থাকতে পারতাম না। কখনই না। আর তারা যদি এই প্রত্যয়ের বাবা-মায়ের মতো নিজেদের প্রত্যাশার বিশাল চাপ আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ব্যর্থতার পর মুখ ফিরিয়ে নিতেন, তাহলে কে জানে, হয়তো আমার জীবনও অনেক আগেই প্রত্যয়ের মতোই ঝরে যেত! বিসিএস ক্যাডার হওয়া লাগতো না।

 

আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, আমার মতো পদে পদে হোঁচট খাওয়া সন্তানের জন্য আমার আব্বা-আম্মার মতো সাপোর্টিভ বাবা মা দুনিয়াতে আগেই পাঠিয়েছিলেন। হে প্রত্যয়ের আব্বা-আম্মার মতো বাবা মায়েরা, আপনাদের পাহাড়সম প্রত্যাশা আপনাদের সন্তানেরা আজকে পূরণ করতে না পারলে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না। তাদের পিঠে ভরসার হাত রাখুন, একটু সাপোর্ট দিয়েন। কে বলতে পারে, খারাপ সময়টা আপনাদের সাপোর্টে পার হয়ে গেলে হয়তো আপনার সন্তান একদিন আপনার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারে।

 

আর না হয় না-ই বা হলো, তাতেই বা কি এসে যায়? আপনার সন্তান আপনার চোখের সামনে লাশ না হয়ে বেচেবর্তে আছে, এটাই কি আপনার জন্য যথেষ্ট আনন্দের বিষয় না? একটু রহম কইরেন হে উচ্চাভিলাষী মাতা-পিতাগণ!