প্রতিজীবী কবিতার গল্প

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০১৯

শিরোনামে গল্প শব্দটি থাকলে এই লেখাটি গল্প নয়। আমি বলি অটোমেটিজম চর্চা। আগে থেকে কোনো ধারণা না করে যা ইচ্ছা লিখে যাওয়া।

 

১. সম্ভব নয় জন্ম তারিখ বলা:
কারণ অসংখ্যবার জন্ম নিয়েছি ইতোমধ্যেই। আরও অনেকবার জন্মের আকাক্সক্ষা সব ইচ্ছার অধিক। এই পৌণপনিক জন্মগুলো কিন্তু পুনর্জন্ম নয়। পুনর্জন্ম পেতে হলে আগে মৃত্যুর ব্যাপার-স্যাপার আসে। মৃত্যুর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে কয়েকবার। সেই যোগাযোগ কখনো বা পৌঁছে গেছে মাখামাখির পর্যায়ে। মৃত্যু নেকাব সরিয়ে তার ছাই রঙা লোবানমাখা চেহারা দেখিয়েছে আমাকে। কিন্তু আমাকে নেয়নি। আমার সবগুলো জন্মই তাই ঈশ্বরেচ্ছায় অভেজাল আনকোরা জন্ম। ঈশ্বরের প্রসঙ্গ যখন উঠেই এলো, তখন বলি, তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।’
লাল ঝুমঝুমি, মাটির হাতি, কাঠের ঘোড়া, নলের বাঁশি, আমআঁটির ভেঁপু, রঙিন ঘুড়ি, সুতো-মাঞ্জা, স্ববীর্য স্খলনের শরানিষিদ্ধ আনন্দ। আমি বড় হয়ে গেছি! আমি বড় হয়ে গেছি! মম চিত্ত নিত্য উদ্বেল। আমি তখন কাহারে যেন খুঁজি! পেয়েও গেলাম। অগতানুগতিক ডেঁপো পূর্বজ কয়েকজন তরুণকে। বয়সিক শারীরিক এমনকি মানসিক অনুপাতেও ফারাক অনেকখানি। তাতে কী? তারাও যে বারংবার জন্মাতে শিখে নিয়েছে। আমি দীক্ষা নিলাম। তাবিজ-কবচ-কমণ্ডলু হাতে পেতেই মাথাচাঁড়া দিল বুর্জোয়াত্ব। তার মানে প্রতিযোগিতা। যেনতেনপ্রকারেণ প্রতিযোগিতা। অনুপাতের ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। ক এর অবস্থানে পৌঁছাতে হবে খ গ এবং ঘ কে পাশ কাটিয়ে। অমিত আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাল ওড়ালাম। কিন্তু ভুল ছিল যে গোড়াতেই। মনেই ছিল না যে ক শালগ্রামশিলা হয়ে এক অবস্থানে থাকবে না। আহ্নিক গতির কথাটা অন্তত মাথায় রাখা উচিত ছিল। পৌঁছে দেখলাম ক-পরিত্যক্ত চিহ্নগুলো আমাকে জব্দ করার আনন্দে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে সোল্লাসে আর ক সরে গেছে আনুপাতিক দূরত্বেরও অনেকটা সামনে।

২. যুবক পালাতে চায়:
প্রদোষ-কৈশোরে পাড়াতুতো বোনের সাথে ধরাপড়া। একান্নবর্তী পরিবারের ঊনতিরিশ জনের সামনে কী লজ্জা! সহজাত পরিচিত একটি আশ্রয় অপেক্ষা করছিল। মায়ের আঁচল। মুখ ঢাকতেই লজ্জা দূর। শঙ্কা উধাও। উষ্ণতার সর্বজয়ী আশ্রয়। পালানোর সেই শুরু।
কিন্তু আজ কোনো আশ্রয় নেই। সেই আঁচল আজ কাফনের মতো অলংঘনীয় হিমঘর। এক টুকরো নির্জনতার দুর্ভিক্ষ। চারদিকে কিলবিল করছে মানুষ আর মানুষের অমানবিক কৌতূহল। সবাই ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চায় তার একান্ত আমিত্বের গোপন কৌমার্য।
কোথায় পালাবে যুবক
তার সর্বব্যাপী ব্যর্থতার লজ্জা নিয়ে?
তার পারিবারিক কর্তব্যহীনতার দায়ভার নিয়ে
সামাজিক ছোবলের বিষজ্বালা এড়াতে?

যুবক নিজের চারদিকে দেয়াল তুলে নিজেকেই ঢাকতে চায়। পারে না।
অন্ধকার তো কোনো আশ্রয় নয়। অন্ধকারের ধর্মই তো আলোর জন্য পথ ছেড়ে দেওয়া। আলোর কাছে হেরে যাওয়ার জন্য সে সর্বসময় উন্মুখ হয়ে আছে, আর বাসরঘরের বধূর মতো জপ করছে-- আমাকে নাও! আমাকে নাও!
যুবক তখন কুয়াশা চিনল। শিখল ধোঁয়া ছড়িয়ে কুয়াশা বানানো। সেই থেকে সে ধোঁয়াতে ঢেকে রাখে নিজস্ব মুখ-ভূগোল।

৩. পৌরুষ পরম আরাধ্য। কিন্তু ঢের বেশি নিরাপদ কাপুরুষ হওয়া:
একটি খোল পেলে শামুক হওয়া যেত। কিংবা স্বশরীরকে বৃত্ত বানাতে জানলে কেন্নো। কিন্তু মানসিক কাপুরুষও কখনো কখনো হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটিয়ে হয়ে যায় সামাজিক বীর। তখন তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অহং তাকে আর বাঁকা হতে দেয় না। করে রাখে মরা সাপের মতো নিপাট সোজা।
এরকম ঘটনা যুবককে মাঝে মাঝে ন্যাংটো করে দেয়।

নানা বর্ণের মিছিল তাকে ডাকে। সাদা লাল কালো।
ঘামের লোনা গন্ধ, আফটার সেভের ঝাঁঝ, পারফিউমের যৌনগন্ধ তাকে বেসামাল দিগ্ভ্রান্ত বানায়-- মানি না মানব না! মেনে নাও মানতে হবে...
কিন্তু সে তো আসলেই কাপুরুষ। আত্মপ্রতারক। ঋজু পদক্ষেপের মিথ্যে আভিজাত্যের ঢংয়ে ঢাকতে চায় হৃৎপিণ্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত দোলাচল। কেউ জানে না হৃৎপিণ্ডে তার বাসা বেঁধেছে ঘূণপোকা। যোগাসন জগিং ডেল কার্নেগি কোয়ান্টাম মেথড সিলভা মেথড আত্মসম্মোহন-- কেউই গ্যালভানাইজ করতে পারেনি ক্ষয়িষ্ণু রট্ আয়রনকে। অন্যকে দেওয়া কথা রক্ষার জন্য জান লড়িয়ে দেয় কিন্তু নিজেকে দেওয়া কোনো কথাই রাখতে পারেনি। পারে না। আগে লজ্জিত হতো। এখন আর হয় না। বানভাসা এই ব-দ্বীপের অরক্ষিত জনপদের মতোই ধুয়ে-মুছে গেছে আত্মলজ্জার ভূ-ভাগ।
সেই বৃদ্ধের চোখ তাকে তাড়া করে ফেরে না-ঘুমানো দুপুরে ও রাতে। হাত-পা ফাটাফাটা খসখসে। গ্রন্থিল ঝুলে পড়া শিরাগুলোতে আঁকা বৃদ্ধত্বউল্কি। চোখদুটোতে কী সর্বহারা বিষণ্নতা! কী লজ্জামাখা সংকোচের দীনতা! পোষা মুরগির ডিম আনছিল কয়েক হালি শহরে বিক্রি করতে। ট্রেনের টিকেট কাটার সঙ্গতি নেই। লোকাল ট্রেনের গোটা বগিতে কারোই টিকেট ছিল না। কিন্তু একটাকার-দুইটাকার কয়েন ছিল। অপটু বৃদ্ধের সেটুকুও নাস্তি। ফলে চেকারসাহেবের গলাধাক্কা এবং ডিম ভেঙে প্লাটফর্মের নোংরা শানের মেঝে আরও নোংরা। ফ্যাকাশে-হলুদ পিচ্ছিল আবর্জনাগুলোর দিকে চেয়ে হাঁটুমুড়ে বসেছিল ঘোলাটে চোখের বৃদ্ধ। ঐ ডিমের সাথেই কি ভেঙে গেছে তার জ্বরগ্রস্ত প্রতিবন্ধী পুত্রের ওষুধের শিশি, নাতনির পুতুলের বায়না, বৃদ্ধা স্ত্রীর জর্দার প্লাস্টিকের কৌটা? কোন ব্যারোমিটারে মাপা যাবে তার পাঁজরভাঙা নিশ্বাসের অসহায়ত্ব?
ঘা-খাওয়া চোখের সেই বৃদ্ধের অনভ্যস্ত হাত যখন তার দিকে বাড়ানো, সে তখন সদ্য ঠোঁটে তুলেছে আট টাকা দামের স্বর্ণপত্র। বৃদ্ধের চেহারা আর অনভ্যস্ত হাত পাতার ভঙ্গি তার ভেতরে চালু করে দিয়েছিল অব্যক্ত কষ্ট-উৎপাদক জেনারেটর। কিন্তু পকেটে ফাঁপা শূন্যতা। সর্বশেষ মুদ্রাপত্রগুলি ব্যয়িত স্বর্ণপত্রে। কী যে ঘৃণা জন্মেছিল ধোঁয়া-বণিকের প্রতি।
কিন্তু কাপুরুষের ঘৃণা! বন্ধ্যা রমণীর মতোই নিষ্ফলা!

৪.
তার প্রিয় নারীরা ভুলেছে সততা, মেতেছে অবৈধ সঙ্গমে:
তার প্রিয় পুরুষেরা পড়েছে বিশ্বাসহন্তার পোশাক
পথ-প্রদর্শকরা মেতেছে পথ ভোলানোর ষড়যন্ত্রে!
এনামেল-রঙের এক দুপুরে বুকের ওপর সাড়ে তিন হাত কবরের সমান চাপ নিয়ে যুবক সিদ্ধান্ত নিল-- সে-ও তবে নষ্ট হবে!
রেডবুকের কয়েকটা মাত্র পাতা আত্মস্থ তার। ভুলে যাওয়া খুব কি কঠিন? মোটেই না!
স্বর্ণপত্রে কষে টান
আত্মদর্পণ খান খান!

৫. বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সংক্রামক অসুখের বৈশিষ্ট্য:
ক. এগুলোর কারণ জীবন্ত অণুজীব। সর্বদাই সনাক্তযোগ্য বিধায় প্রদাহের সূচনালগ্নেই রোগের চিহ্নিতকরণ সম্ভব। আর এরা প্রায় সবাই প্রতিজীবী বা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসাযোগ্য।
খ. এদের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা বিস্ময়কর। এতদূর যে, প্রায়শই এরা মহামারি সৃষ্টিতে সক্ষম।
গ. অনেকগুলো সংক্রমণ পূর্বাহ্নেই প্রতিহত করা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের দ্বারা।

৬. যুবক কোথায় পাবে ভ্যাকসিন?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান অশ্রুভরা বুক নিয়ে যুবক নতজানু হয় কবিতার কাছে।
নষ্ট হওয়া বড় কঠিন!