পুরস্কার হিসেবে থালা-বাসন-ঘটি-বাটি আর কত দেবেন!

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০১৯

মানুষ বই পড়ে না, বই কেনে না; ইন্টারনেটের এই কালে বইয়ের পাঠক কমে গেছে―এসব কথা হামেশাই শোনা যায়। কথাগুলো আংশিক সত্য, পুরোপুরি নয়। এবারের বইমেলায় তো প্রায় সাড়ে চার হাজার বই প্রকাশিত হলো। প্রতিটি বইয়ের মুদ্রণসংখ্যা কম করে হলেও তিনশো। মেলা তো শেষ হলো। এত এত বই কোথায় গেল? প্রকাশকরা কি এসব বই বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিল? না, তা দেয়নি। তথ্য মতে, এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। কম-বেশি হতে পারে। একুশে গ্রন্থমেলার কথা থাক। টানা এক মাসের এত বিশাল মেলা, আশি কোটি টাকা বিক্রি খুব বেশি নয়। বরং বলি ঢাকার বাইরের কয়েকটি বইমেলার কথা।

বইকে যদি পাঠকের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া যায়, পাঠক বই কেনে, বই পড়ে। জামালপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় চার দিনের বইমেলা। জামালপুরের এডিসি ও প্রাবন্ধিক রাজিব সরকারের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, এ বইমেলায় ছয় লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। বাগেরহাটের চিতলমারি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মার্চে অনুষ্ঠিত হয় দশ দিনের বইমেলা। শেষ হয়েছে আজ। কথা হলো কথাসাহিত্যিক ও চিতলমারির ইউএনও সাঈদ আজাদের সঙ্গে। জানালেন, চিতলামরি বইমেলায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ফেনী থেকে ‘ভাটিয়াল’ সম্পাদক আলমগীর মাসুদ জানালেন, এবারের বইমেলায় বিক্রি হয়েছে ২০ লাখ টাকার বই। অপরদিকে পত্রিকায় দেখলাম, খুলনার মাসব্যাপী বইমেলায় বিক্রি হয়েছে প্রায় দেড় কাটি টাকার বই। চট্টগ্রামে এবার কুড়ি দিনের সমন্বিত বইমেলায় ১৪ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সাতক্ষীরাসহ আরো একাধিক জেলা-উপজেলায় বইমেলা হয়েছে। সেসব মেলায় কত টাকার বই বিক্রি হয়েছে জানি না। নিশ্চয়ই গড়ে তিন লাখের কম নয়।

জামালপুরের রাজিব সরকার জানালেন, বইমেলার শুরুতে তিনি জেলার স্কুলগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছেন, যাতে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের বইমেলায় নিয়ে আসে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে স্কুলগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে সাধারণত দেয়া হয় ক্রেস্ট বা ক্রোকারিজ সামগ্রী। এবার জামালপুরের অনেক স্কুল ক্রেস্ট-ক্রোকারিজের পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে দিয়েছে বই।

জামালপুর, চিতলমারি, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, ফেনী―এগুলো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এভাবে প্রত্যেক জেলা উপজেলায় বইমেলার আয়োজন করা যেতে পারে। আয়োজন করতে হবে জেলা-উপজেলা প্রশাসনকেই। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা এটা করবে না। কারণ বইমেলায় দু-পয়সা কামাইয়ের সুযোগ নেই। এসব মেলা হতে পারে ফেব্রুয়ারিতে বা মার্চে বা বাংলা নববর্ষে। জামালপুরের স্কুলগুলোর মতো দেশের অন্যান্য স্কুল কর্তৃপক্ষও যদি ক্রেস্ট বা ক্রোকারিজের বদলে ছাত্র-ছাত্রীদের বই উপহার দেয়, তাহলে ভাবুন, সারা দেশে কত টাকার বই বিক্রি হবে? পুরস্কার হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের থালা-বাসন-ঘটি-বাটি আর কত দেবেন? এবার একটু বইয়ের দিকে নজর দিন। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতে বই তুলে দিন।

জেলা-উপজেলায় বা গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলার কথা বলা হয়। কেউ গড়ে তোলে না। এই কাজ রাজনীতিবিদদের হলেও তারা এটা করবে না। ভোটের রাজনীতিতে পাঠাগারের বদলে মসজিদ-মন্দির গড়ায় বেশি লাভ। যেটায় বেশি লাভ তারা সেটাই করবে। সুতরাং উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। দেশ তো উন্নত হচ্ছে। রাস্তাঘাট উন্নত হচ্ছে। হোক। রাস্তাঘাটের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্ক। যোগাযোগের সঙ্গে অথনীতির সম্পর্ক। কিন্তু শুধু রাস্তাঘাট উন্নয়নের প্রতি জোর দিলে তো হবে না, মানুষের আত্মিক উন্নয়নের প্রতিও জোর দিতে হবে। তবেই উন্নয়ন হবে টেকসই।

আগামি দিনে দেশের প্রতি জেলা-উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন করা যায় কিনা, এই ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ভেবে দেখতে পারে। বেশি কিছু দরকার নেই, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে একটা চিঠি দিলেই হবে, স্থানীয় প্রশাসনই সুচারুভাবে মেলার আয়োজন করতে পারবে। যেমন করা হয়েছে জামালপুরে, চিতলমারিতে, ফেনীতে, সাতক্ষীরায়, খুলনা ও চট্টগ্রামে। অগ্রিম টাকা দিয়ে বই কিনতে হবে না। প্রকাশকরাও নিশ্চিয়ই এই ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন যদি প্রকাশকদের সহযোগিতা চায়, প্রকাশকরা টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে বই পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। প্রয়োজেন নিজেরা মেলায় হাজির থাকবেন। আমাদের প্রকাশকরা এই ব্যাপারে ইতিবাচক, আন্তরিক । দরকার সরকারি উদ্যোগ।

টুকে রাখা কথামালা
১২.০৩.২০১৯