অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম
পুঁজিবাদ: শিশুদের লাশের স্তূপ
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে চারদিকে যখন পুঁজিবাদের এত সুনাম, যখন মার্ক্সবাদকে একটা ইউটোপিয়ান চিন্তা বলে উড়িয়ে দেয়া হয়, ঠিক তখনই সিরিয়া ইস্যু আরও একটা বড় আঘাত পুঁজিবাদী চিন্তার ওপর। এই কেএফসি, ডেল, অ্যাপেলের যুগে ইয়েমেন কিংবা সিরিয়া অথবা আফ্রিকা বা ফিলিস্তিনে লাখ লাখ শিশু স্রেফ না খেয়ে মরছে।
একটা ছবিতে দেখলাম, তিন বছরের ফুটফুটে এক সিরিয়ান বাচ্চা মরার আগে অভিমান করে বলেছে, ‘ওপরে গিয়ে ঈশ্বরকে সব বলে দেব।’ এমন ভয়ানক কথা শুনে স্রেফ আত্মহত্যা করার ইচ্ছা আরো তীব্রতর হয়! বাঁচার সব ইচ্ছা শেষ হয়ে যায়। প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, কান্না আসে। এক্কেবারে অবুঝ জানোয়ারদের কথা বাদ দিলে, অন্তত যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করে, তারা এখন শুধু প্রতিশোধেরই রাস্তা দ্যাখে। সেটাই তো হওয়া উচিত।
এ পরিস্থিতির পিছে ওবামা-ট্রাম-পুতিন-এদোয়ান বা শক্তিশালী রাষ্ট্র নায়কেরা যত না দায়ি, তারচেয়েও বেশি দায়ি পুঁজিবাদী অর্থনীতি। ধনীদেশ আর গরিবদেশের মধ্যকার পার্থক্য এখন আর শুধু বিনোদনে আটকে নাই, এখন শিশুদের লাশের জরিপও বদলেছে। ফাস্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে শিশুরা পিজার ফ্লেভার নিয়ে বায়না করে। আর থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে শিশুরা কান্না করে ভাতের জন্য। না খেয়ে মরে। এরচেয়ে বড় জরিপ আর কি আছে?
আমার এক বন্ধুর সাথে বছর ছয় আগে পুঁজিবাদ নিয়ে যখন প্রথম আলাপ হয়, তখন আমি মাত্র কম্যুনিস্ট মেনুফেস্টো পড়তে শুরু করেছি। আমাদের তর্কটা শুরু হয়েছিল পুঁজিবাদের ভালো-মন্দ নিয়ে। বন্ধুর দাবি ছিল, পুঁজিবাদ বিজ্ঞান-দর্শন-সমাজকে একটা গতি দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং উৎপাদন সবই এত দ্রুত বদলেছে যে, এর আগের তিন হাজার বছরে সেটা সম্ভব হয়নি। অতএব পুঁজিবাদ দোষ-গুণ মিলেই একটা ভালো ব্যবস্থা।
আমিও একমত ছিলাম যে, পুঁজিবাদ এক অদ্ভুত ব্যবস্থা। যেখানে কেউ স্বাধীন না, কিন্তু সবারই মনে হয় তারা স্বাধীন। একটা সিনেমা আছে, নাম ‘দে লিভ’। সিনেমায় দেখানো হয়, মানুষ আসলে এই আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীন। কিন্তু তাদের এই ‘আমরা স্বাধীন’ চিন্তাটা তাদের মধ্যে ইনপুট করা হয়েছে। তাই সিনেমার প্রধান চরিত্র যখন বিশেষ চশমা দিয়ে সংবাদমাধ্যমের বিলবোর্ড দ্যাখে, তখন সে বিলবোর্ডের পেছনের গোপন তথ্যটা ধরতে পারে। আর সেটা হলো, ওবে বা বিলভ অর্থাৎ মেনে চলো বা এটা বিশ্বাস করো।
পুঁজিবাদ আমাদের যুদ্ধ উপহার দিয়েছে। দেশে দেশে যুদ্ধ। মৃত শিশুদের স্তূপ। একদিকে ফাস্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি আর অন্যদিকে আফ্রিকা বা আরব দেশগুলোর মতো ধ্বংস হওয়া দেশ, আর তার মধ্যে পড়ে থাকা লাখ লাখ শিশুর হাড়গোড়। যারা সিরিয়ার পক্ষে নানা মাধ্যমে নানাভাবে কথা বলছে, যারা ওই শিশুদের জন্য আওয়াজ তুলছে, সেটা হোক ফেসবুক বা রাস্তায়, তারা যদি এই পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় তাহলেই এসব বন্ধ সম্ভব। না-হলে দ্রুত এক সিরিয়া শেষ হলে আরেক সিরিয়া শুরু হবে। আজ দূরে হচ্ছে, কাল নিজের ঘরে হবে। যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাচ্চাদের খাবার নিশ্চিত করতে পারে না, যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে আর আমার হাতে এ্যাপেলের প্রোডাক্ট তুলে দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, সে ব্যবস্থাকে আমি ঘৃণা করি। আমার লজ্জা লাগে...
লেখক: কলামিস্ট, কার্টুনিস্ট ও বিশ্বাভারতীর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী