পাপিয়া জেরীনের গল্প ‘স্বামী’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০১৯
আরে, আপনে এইখানে কী করেন? যান কইতাছি!
বউ, তুমি যেইদিকে যাইবা, আমি সেইদিকেই আসবো... এইটাই নিয়ম।
আরে আরে কী করেন আপনে, ছাড়েন কইতাছি। ছিহ্, পায়ে হাত দেন কেন? ছাড়েন না!
তুমি তো জানো বউ, আমি পাও থিকা আদর-সোহাগ শুরু করি। প্রথমে পায়ের তলায় চুমা, এরপর আঙুলে একটা একটা কইরা...
ইশ্, লাজলজ্জা কিছু নাই! ছাড়েন না গো...
আইচ্ছা ছাইড়া দিমু, তয় একটা ধাঁধার উত্তর দেও, তোমার তো অনেক বুদ্ধি—
সোনার নোলক না দিয়াম
না দিয়াম চুড়ি,
বড়ই ফুলের নথ লইয়া
উঠলো বিয়ার ছেড়ি।
আমি পারুম না। যান কইতেছি!
`সোনাবউ`... ওহ্ পারলা না। তইলে শাস্তি একটা দিমুই, আসো!
ওহ্ ছাড়েন। আ...
উঠানে বইসা জমিলার বুক চিলিক দিয়া উঠে। বাড়িতে কেউ নাই, রান্ধনঘরে পরী কার লগে চিল্লায়া উঠলো!
পরী, কী হইছে রে!
আম্মা, কিছু না... বিলাইডা...
ওই আমি কিন্তু সব শুনতে আছি। তুই বিলাইরে আবার কবে থিকা আপনে কইয়া ডাকছ? হুমম্? ডাইল-ভাত নামায়া পোলারে ধর আমি তরকারি রান্ধি।
জ্বি আইচ্ছা।
জমিলার মন আন্ধার হইয়া আসে। একমাত্র পোলা সামছুর লিগা বাপ-মা মরা এই এতিম মাইয়ারে পছন্দ হইছিল তার। আট বছর আগের কথা, পরীর মতো সুন্দর আবার নামও পরী। কেন যে রূপ দেইখা চোখ ঝলসায়ে গেল আল্লায়ই জানে। পরে দেহা গেল, এই মাইয়ার বাচ্চা হয় না, শেষে কত ডাক্তর কবিরাজ দেখাইয়া এই নাতি। এখন আবার ছেড়ি নতুন ভং ধরছে, সামছু বাড়িতে আইলে সে নতুন বউয়ের মতো বিরাট এক ঘুমটা টাইনা বসে। রাইতে আইসা পাও ধইরা কান্দে আর কয়, আম্মা, আপনের লগে আমি শুমু, হেয় আমার সোয়ামি না। আপনে বাঁচান আমারে।
প্রতি শুক্কুর-শনিবার এই নাটক। বাকি দিনগুলিতে ভালো, আর সামছু যেইদিন বাড়িতে সেইদিন এইসব। নাতি ঘুমাইলে পোলা আইসা পরীর চুলের মুঠি ধইরা টাইনা নিয়া যায়... তারপর চিক্কুরের পর চিক্কুর। শেষে মাইরা আধামরা কইরা পরীরে বারিন্দায় ফালায়া রাখে। আর ঘাউড়া ছেড়ির মুখে ওই এক কথা, `আপনে ধরবেন না আমারে, আপনে আমার স্বামী না।`
তারপর সামছু খালি কুইদা আসে, তর সব দোষ। তুই এই পাগল বিয়া করাইছস আমারে। দেখ খোঁজ নিয়া অন্য কোনো বেডার লগে...
নারে বেডা, ও সারডা দিন এই ঘর, উডান আর ঘাটলা, আমার চউখের সামনে।
জমিলা কান্তে থাকে। পোলারে ধৈর্য ধরতে কয়।
আবার পোলা গঞ্জে গেলে পরী ঘোমটা ফালায়া নাচে গানে অস্থির। কী গানের গলা মাইয়াডার! আহ চাউল ঝাড়তে ঝাড়তে আইজ সকালেই কি গানটা জানি গায়া উঠলো—
পাখিরে তোর কুহুকুহু গান
শুনিয়া জুড়াইতাম আমার প্রাণ
এখন আমি তোমায় ছাড়া কেমনে একা থাকি
ও পরী, তোর পোলারে দুধ দে। ঘুমায়া পড়লো তো। তোর ভাত ডাইল হইতে হইতে তো সন্ধ্যা লাইগা যাইবো।
পরী পোলারে বুকে টাইনা ঘরে ঢুকে আর পেছন ফিরা তাকায়া দেখে সেও আসতেছে। জমিলার দিকে তাকায়া চোখ ইশারায় বারণ করে তারে। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
বউ, তোমার আমার সন্তান হইলে কিন্তু আমি নাম রাখবো। মাইয়া হইবো নিশ্চিত ইনশাহ্আল্লাহ। নাম হবে জোনাকি।
আপনে আগে আমারে এইখান থিকা নিয়া যান। শুনছেন? হাসেন কেন? কন না!
বউ গো, হাসি কেন জানো? আরেকটা ধাঁধা...
তোমার ঝিলে ভাসতে থাকে
আমার মাছের ছায়া
পিঞ্জরে তোমার ছটফটায়
আমার মনের কায়া।
পারমু না। আমি এত কঠিন কথা বুঝি না।
না পারলে তো শাস্তি, এবার চুলে দিয়া শুরু। কাছে আসো।
পরী অবাক হইয়া লোকটার দিকে তাকায়া থাকে। কী সুন্দর যে মানুষটা, সারক্ষণ কত গান কত কিচ্ছা দিয়া তারে ভুলায়া রাখে। দিন তারিখ মনে নাই কবে এ মানুষটার সাথে তার প্রথম দেখা। তবে এইটুক মনে আছে, সেইদিন সামছু মিয়া তারে মাইরা আধামরা বানায়া ফেলছিল। পরী সহ্য করতে না পাইরা কইলো, আর একবার যদি মারেন, তইলে আমি আপনার ইস্তিরি না... আর আপনে আমার স্বামী না। আল্লার কছম লাগে।
কিন্তু সামছু থামে নাই। ঠিক সেইদিন বিকালে বাড়ির ঘাটলায় এই মানুষটা আইসা উপস্থিত। গায়ে ছাইরঙা ফতুয়া আর চেক লুঙ্গি। তারে দেইখাই পরী ডরে পা পিছলায়া পুকুরে। তারপর লোকটা কাছে আগাইতে থাকলো আর পরী পিছাইতে। বুক সমান পানিতে পরী দাঁড়ায়া। ঘাটলার হিজল গাছ থিকা ফুল পইড়া পানিতে ভাসতে আছে, কয়েকটা ফুল আইসা চুলের জালে আটকায়া রইলো। লোকটা পরীর দিকে তাকায়া কইলো, ও পরী তোমার তো অনেক বুদ্ধি, এই ধাঁধার
একটা সমাধান দাও—
ভাদ্র মাসের তাল
লোকে বলে লাল,
বাড়িতে নাই বউ
সিকায় তুইলা থোউ!
পরী এই শোল্লক এর উত্তর জানে, সে কইলো, `ভালোবাসি।` লোকটা মায়াকাড়া হাসি দিয়া কইলো, তুমি পারছো। না পারলে তো আইজ পানির ভিত্রে নিয়া তোমারে চুমাইতাম। তুমি মরতে মরতে বাঁইচা উঠতা!
সেই থিকা শুরু... লোকটা ছায়ার মতো তার পিছু পিছু, খালি সামছু মিয়া আসলে একটু আড়াল হয়।
পরীর চোখ লাইগা আসছিল, সামছু মিয়ার গলার আওয়াজে ধড়মড়াইয়া ওঠে।
কীরে ঘোমটা দেস কেন? আয়, আইজ তোরে পাইছি।
আপনে দরজার খিলি লাগান কেন?
তরে শেষবারের মতো একটু লইয়া লই, আমি আরেকটা বিয়া করছি। সামনের মাসে এই ঘরে বউ তুলুম। আর তুই তোর লাঙের লগে গিয়া ঘর করিস।
আপনে ছাড়েন আমারে। পোলা কানতাছে। আমি আর এক মিনিটও এই বাড়িতে থাকমু না, পোলারে লইয়া...
ওই মাগী, পোলা কি তো একলার গাঙ্গে ভাইসা আইছে? অখনি তুই যাবি। এক কাপড়ে যাবি। হ, হাতের চুড়ি লইয়া কই যাস্? তোর বাপে গড়ায়া দিছে?
জমিলা বিবি এশার নামাজে বইসা। পরী একবার তার দিকে চাইয়া আস্তে হাঁটা দেয়। মানুষটা গেল কই আজকা! ওই তো কড়ই গাছের নীচে হাত ইশারা করতেছে। পরী লোকটার পিছে হাঁটতে হাঁটতে গাঙপাড়ে।
চলো, আইজ সেই দিন আইসা গেল তাইলে। উই যে নৌকা।
কী কন? নৌকাতো পড়ায় মাঝনদীতে। এতদূর সাঁতরায়ে যামু নাকি!
না, তুমি সাঁতরাইবা কেন? তুমি আমার বুকে ভর দিয়া থাকবা আর আমি উল্টা সাঁতার দিমু। আসো বউ!
পরী স্বামীর হাত ধইরা নদীর জলে ডুবতে থাকে। উথাল পাথাল জোছনায় তার মনে হয়... তাগো পয়লা মেয়্যা আবুটার নাম `চাঁদনী` হইলে ভালো হয়। কিন্তু সে কোন মুখে তার স্বামীরে এই কথা বলবে, তার বুঝি শরম করে না! তাছাড়া `জোনাকি` নামটা খারাপ কীসে!