পাঠ্যবইতে ইতিহাস নয়, লেখকদের বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে
মিজানুর রহমানপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০২৩
‘বখতিয়ার খলজী অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন’ এরকম অনেক অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লেখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবই। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদন করে না। মনে হয়েছে, ইতিহাস নয় বরং লেখকদের কারো কারো নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়।
পাক-ভারত-বাংলাদেশ এক সময়ে ছিলে বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেই বৌদ্ধরা কিভাবে এদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গেল, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। তবে তার কোনোটাতেই বখতিয়ার খলজীকে অনেকগুলো বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় নাই। কয়েকজন নালন্দা (বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়) ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খলজীকে দায়ী করলেও সেটাকে আবার অধিকাংশ ঐতিহাসিক নাকচ করে দিয়েছেন due to prejudice rather than fact.(দেখুন;Truschke,A. 2018. THE POWER OF THE ISLAMIC SWORD IN NARRATING THE DEATH OF INDIAN BUDDHISM, Journal of the history of religion, Chicago University press. Vol. 57(4), P.406-435)।
রাধাকৃঞ্চ চেীধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ওপর ভিত্তি করে Decline of the University of Vikramasila প্রবন্ধ লিখে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন, বখতিয়ার খলজীর বাংলা অভিযানের সাথে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই ছিল না।
রাধাকৃঞ্চ চেীধুরী লিপিতাত্ত্বিক Epigraphic ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নালন্দা ধ্বংসের সাথে বিজয় সেনের যুক্ততা ছিল। যিনি সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত সেনের ছেলে ছিলেন। তাদের বসবাস ছিল বর্তমান রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার দেওপাড়ায়। দেওপাড়াতে পাওয়া একটি লিপিস্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন (দেখুন:Chaudhary, R. 1978. Decline of the University of Vikramasila, Journal of the Indian History, Vol. LVI, Part II)।
এ বিষয়গুলো অনেক জটিল এবং পুরো রহস্য অনুদঘাটিত। তদুপরি এগুলোর সাথে আছে উপমহাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির নানা জটিল হিসেব-নিকেশ। এরকম বিষয়গুলো উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য বিবেচনা করা উচিত, স্কুলের জন্য তা মোটেও উপযুক্ত নয়।
বইটিতে আরো অনেক অসংগতি রয়েছে। বিশেষ করে বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসকে খারাপভাবে উপস্থাপনে নানা চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। একই সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যার মাধ্যমে বাংলার কৃষকদেরকে ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, সেটাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে! আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে জমিদারির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, আজ আমাদেরকে তা ভুলিয়ে দিয়ে তাদের মাহাত্ম্য আর গুণগান শেখানো হচ্ছে।
এনসিটিবিটি কিসের ওপর ভিত্তি করে লেখক আর কন্টেন্ট নির্ধারণ করে, বুঝতে পারলাম না।
লেখক: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত স্কলার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক