কাজী জহিরুল ইসলাম
পাঠ্যপুস্তকে ‘সিঁথি’, বাংলা কবিতাকে চরম অপমান
কাজী জহিরুল ইসলামপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০২, ২০২৫
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের (বাংলা বই) শেষ পৃষ্ঠায় ইউনূস সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ একটি ছড়া ছেপেছেন, ছড়াটির নাম ‘সিঁথি’। এটি অতি নিম্নমানের ছড়া। এই ছড়াটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার অযোগ্যতাই শুধু নয়, চরম দেউলিয়াপনা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা কবিতার হাজার বছরের একটি ইতিহাস আছে, দীর্ঘ কালপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য। চর্যাগীতি থেকে আজকের কবিতায় আসতে যে লম্বা পথ বাংলা কবিতা পাড়ি দিয়েছে সেই পথে ছড়ানো আছে শুদ্ধতার ক্রমবিবর্তন।
এই দীর্ঘ পথ নির্মাণ করেছেন লুই পা, কাহ্ন পা, কুক্কুরি পা থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাস, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর, আব্দুল হাকিম, আধুনিক যুগের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদদীন এবং ত্রিশোত্তর ঔপনিবেশিকাধুনিক কালের বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ, আতাহার খান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, খন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ।
ইতোপূর্বে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কোনো কোনো আমলা কবি-লেখক পাঠ্যপুস্তকে তাদের লেখা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সেইসব রচনা সম্পর্কে দলীয় স্তুতি ও চাটুকারিতার অভিযোগ থাকলেও শুদ্ধতার নিরিখে মানের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অভিযোগ ছিল না। এবারই প্রথম একেবারে মানহীন একটি ছড়া পাঠপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে, আরো সুনির্দিষ্ট করে যদি বলি কাব্যসাহিত্যকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তক-তালিকায় যে গ্রন্থগুলো থাকে তার প্রতিটি গ্রন্থেরই একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। বাংলা গ্রন্থের লক্ষ্য কী? স্কুল পর্যায়ে আমরা এই গ্রন্থটি পড়ানোর মধ্য দিয়ে শিশুদের কী শেখাতে চাই? আমরা শিশুদের মধ্যে কল্পনা শক্তি তৈরি করতে চাই, শুদ্ধ বানান ও উচ্চারণ শেখাতে চাই, শুদ্ধ বাক্য গঠন শেখাতে চাই, বাংলা ব্যাকরণ শেখাতে চাই, কবিতা পড়ানোর মধ্য দিয়ে ছন্দ শেখাতে চাই এবং এই ছন্দ শেখার মধ্য দিয়ে তারা যেন তাদের জীবনের ছন্দটাও ঠিক করে নিতে পারে।
বাংলা সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে শিশুরা শুদ্ধ বাংলা ভাষা শেখে, যাতে তারা বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশির সঙ্গে এবং আনুষ্ঠানিক পরিবেশে শুদ্ধ উচ্চারণে সঠিক শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারে, লিখতে পারে।
এবার আসুন দেখি এই কবিতায় যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে কী ধরনের বানান ও ভাষা শেখাবে। এই ছড়ায় ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ: দাঁড়ায়া, পোলা, মাইয়া, খুইলা, রাখছে, বইনে, আইছে, ফিরা, পুতরে, পোলারে, অহন, কাডের, শ্যাষ, কান্দে, দ্যাশ, বাইন্ধা, হারাইল, কাঁইপা, শুইনা, বাপের, ছার, ডুইবা, ছাইয়া।
এই শব্দগুলো আমরা অপ্রমিত উচ্চারণে কথ্যভাষায় অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করে থাকি। এগুলোও বাংলা ভাষাই, বাংলা ভাষার কথ্যরূপ। কিন্তু আমরা তো সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এই ভাষা শেখাবো না। `দ্যাশ` এবং `শ্যাষ` এই বানান শিশুদের বিভ্রান্ত করবে ভাষা শেখার শুরুতেই। ছড়াটিতে যদি খেটে খাওয়া কোনো শ্রমিকের সংলাপ হিসেবে দুয়েক লাইনে এমন শব্দ আসত তাহলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনো এক যুক্তিতে মেনে নেয়া যেত। হয়ত শিক্ষক পড়াবার সময় বলতেন, এই শব্দগুলো একজন অশিক্ষিত শ্রমিকের, তোমরা কিছুতেই এই ভাষাটি শিখবে না। এর অর্থ এই না যে সেই শ্রমিককে অশ্রদ্ধা করা। শেখার সময়ে তো শুদ্ধটাই শিখতে হবে।
কবিতায় অনেক নিরীক্ষা হয়, অনেক অপ্রমিত শব্দের ব্যবহার হয়, গালির ব্যবহার হয়, কিন্তু সেগুলো আমরা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করবো না। কারণ পাঠ্যপুস্তকের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। কবি আবিদ আজাদ এক কবিতায় ‘গোয়ামারা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সেটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার বইয়ে ছাপা হয়েছে। কিন্তু সেই কবিতা কি আমরা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করবো? এমন কী রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাও আমরা পাঠ্যপুস্তকের জন্য সুপারিশ করবো না। পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষামূলক, সব দিক থেকে শুদ্ধ কবিতাই কেবল স্থান পাবে।
আসুন এবার দেখি এই ছড়ার ছন্দ। ছড়া সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়। স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্ব হয় চার মাত্রায়, পঙক্তির শেষে অপূর্ণ পর্ব থাকতে পারে, এতে দোষের কিছু নেই। এই ছড়াটিও অশুদ্ধ স্বরবৃত্ত ছন্দেই লেখা হয়েছে।
ছড়াটির প্রথম লাইনে মাত্রা ঠিক নেই, এক পর্ব কম আছে [ভাই মরল (৩)+ রংপুরে সেই (৪)]। দ্বিতীয় লাইনের শেষে এবং চতুর্থ লাইনের শেষে ৩ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ঠিক আছে। দ্বিতীয় প্যারার প্রথম লাইনেও মাত্রা ঠিক নেই [কওমি তরুণ (৪)+ দাঁড়ায়া ছিল (৫)]। এই লাইনে ছন্দটা মারাত্মকভাবে হোঁচট খায়। তৃতীয় প্যারার তৃতীয় লাইনে ছন্দ ঠিক নেই [ভাই বইনে (৩)+ আইছে ফিরা (৪)], এখানেও মারাত্মকভাবে ছন্দটা হোচট খায়। চতুর্থ প্যারার দ্বিতীয় লাইনের ছন্দে ভুল [মা ফিরছে (৩)+ অটোতে (৩)]। ষষ্ঠ প্যারার দ্বিতীয় লাইনে ছন্দ ঠিক নেই [পুত মিছিলে (৪)+ হারাইল প্রাণ (৪)]। প্রতি দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনের শেষে ৩ মাত্রার অপূর্ণ পর্বে অন্ত্যানুপ্রাস দেয়া হয়েছে কিন্তু ষষ্ঠ প্যারায় গিয়ে ৩ মাত্রার বদলে ৪ মাত্রা থাকায় সাংঘাতিকভাবে ছন্দটা ভেঙে পড়েছে। একই প্যারার তৃতীয় লাইনেও ভুল আছে [ঘাস কান্দে (৩)+ গাছ কান্দে (৩)]। দুটি পর্বেই এক মাত্রা করে কম আছে।
এই ছোট্ট একটি ছড়ায় যদি এত্তগুলো ভুল থাকে তাহলে বুঝতে হবে এই ছড়াকার শুধু নবিশ ছড়াকারই নয়, নবিশদের মধ্যেও তার অবস্থান একেবারে প্রাথমিক স্তরে।
এবার আসি বিষয়বস্তু ও ভাষার অসঙ্গতি প্রসঙ্গে। ‘নুসরাতেরা আগুন দিলো/ দোযখ যেন ছড়ায় কেশ’ এই কথার মধ্য দিয়ে বিপ্লবীদের নেতিবাচক হিসেবে দেখানো হয়েছে। মনে হচ্ছে নুসরাতেরা দেশকে দোযখ বানিয়ে ফেলেছে। আসলে এটি অতি দুর্বল ছড়াকারের অদক্ষতার কারণেই হয়েছে। শুধু অন্তমিল দেবার জন্য তার মাথায় যা এসেছে তাই লিখে দিয়েছে, বুঝে লেখেনি বলেই মনে হচ্ছে। ‘কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল/ কারবালারই ফোরাতে’ এই শব্দগুচ্ছ সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর কল্পনায় বাংলাদেশের কোনো দৃশ্যকে তুলে ধরবে না। তাকে বিভ্রান্ত করবে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও আন্দোলনের রাজপথ চেনাতে।
‘সারা আকাশ ছাইয়া আছে/ কোন শহীদের গায়ের শাল’ এই শব্দগুচ্ছে `শাল` শব্দটি তিনি শুধুমাত্র আগের লাইলের `লাল` এর সাথে মেলানোর জন্য লিখেছেন। এটিও শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করবে চব্বিশের জুলাই মাসের অভ্যুত্থানের চিত্র আঁকার ক্ষেত্রে। জুলাই-আগস্ট প্রচণ্ড গরমের সময়, তখন শাল গায়ে দিয়ে কেউ আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হননি। কবি, লেখকদের স্থান-কাল সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার এবং সচেতন হওয়া দরকার। আমি শীতকালের কবিতায় যদি লিখি ‘সারা গাঁয়ে পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণ’, তাহলে হবে না।
কয়েকটি কারণে আমি ছড়াকারের নাম উল্লেখ করলাম না। আলোচনাটি যেন ছড়ার হয়, ছড়াকারের নয়। নৈর্ব্যক্তিক থেকে আলোচনাটি করাই ভালো হবে বলে আমি মনে করেছি। নাম উল্লেখ করলে সবাই তার ক্ষমতার খুঁটি খুঁজবেন, ব্যক্তি আক্রমণ করবেন, একজন তরুণ ছড়াকারকে ব্যক্তি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার একটা দায় আমি অনুভব করেছি। আমাদের দেশে সকল কিছুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়, স্তুতি, নিন্দা সব। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে আলোচনাটিকে নৈর্ব্যক্তিক করা যায় কিনা দেখা যাক।
বাংলা সাহিত্যকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে এবং সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুরোধ করবো, বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটি, যেখানে এই অখাদ্য ছড়াটি ছাপা হয়েছে, ছিঁড়ে ফেলে দিন। শিক্ষা বিভাগের প্রতি অনুরোধ, পরের সংস্করণে এই পৃষ্ঠাটি যেন আর না থাকে।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও জাতিসংঘের কর্মকর্তা
লিসউড, নিউইয়র্ক। ১ জানুয়ারি ২০২৫