পাঠক-লেখক সম্পর্ক
মারুফ ইসলামপ্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০১৯
একটা ডিলেমা আছে। ডিলেমা হচ্ছে, লেখকরা পাঠকদের পছন্দ-অপছন্দ ও মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে লিখবেন নাকি নিজের পছন্দ-অপছন্দ-মতামত অনুযায়ী লিখবেন? এই সময়ের লেখকদের সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে এই ডিলেমায়। কারণ সোস্যাল মিডিয়ায় তাদেরকে সবসময় কানেক্টেড থাকতে হচ্ছে। নিজের লেখাজোখা পোস্ট করতে হচ্ছে। নিজের বইয়ের খবরাখবর জানান দিতে হচ্ছে। আর সেসব পোস্টের নিচে পাঠক-ভক্তরা মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মতামতের প্রতিফলন তখন গিয়ে পড়ছে লেখকের পরবর্তী লেখায়। পাঠক যেভাবে চায় সেভাবে লিখতে তখন লেখকের অবচেতন লেখককে অনুপ্রাণিত করতে থাকে।
তাই পাঠকসংলগ্ন হওয়া উচিত নাকি উচিত নয় সে নিয়েও আছে বিস্তর বিতর্ক। একদল বলছেন, পাঠকের কাছাকাছি হওয়া উচিত; তা না হলে পাঠকের মনস্তত্ত্ব কীভাবে বুঝবেন লেখক? আর লেখক যদি পাঠক মনস্তত্ত্ব না-ই বুঝতে পারেন তাহলে তার লেখা কীভাবে পাঠকের মন স্পর্শ করবে?
এই যুক্তি মেনে নিয়ে এই সময়ের তরুণ লেখকরা অনেক বেশি ইন্টার্যাকটিভ থাকছেন। তারা নানাভাবে লেখক-পাঠক সম্পর্ক তৈরি করছেন। অনলাইনে তো বটেই অফলাইনেও বিভিন্ন ইভেন্ট, আড্ডা, বক্তৃতা, আলোচনা, অটোগ্রাফ উৎসব, সেলফি উইথ বুক ওর রাইটার ইত্যাদির মাধ্যমে পাঠকের নিকটবর্তী হতে চাচ্ছেন। তারা লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে যতটা না আগ্রহী, তারচেয়ে বেশি আগ্রহী অটোগ্রাফ উৎসব কিংবা সেলফি উৎসবের মাধ্যমে পাঠকের কাছে যেতে। তাদের আগ্রহ পাঠক তৈরির চেয়ে ভক্ত তৈরির দিকেই বেশি।
কিন্তু ইতিমধ্যে যারা হাজার হাজার পাঠক কিংবা ভক্ত তৈরি করে ফেলেছেন তারা কী করবেন? তারা পাঠক-ভক্তদের চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দেবেন নাকি দেবেন না? আমরা এই ডিলেমা তথা উভয় সংকটে পড়তে দেখেছিলাম জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। কোটা আন্দোলনের সময় একটি লেখা লিখে তিনি তাঁর ভক্তকূলের ব্যাপক তোপের মুখে পড়েছিলেন। অনলাইনে তাঁর লেখার নিচে পাঠক-ভক্তরা বেশুমার মন্তব্য করেছিল—ইতি এবং নেতি উভয় রকমই। ভক্তরা ধারনা করেছিল, তাদের প্রিয় লেখক তাঁর পরবর্তী লেখায় নিশ্চয় এসব মন্তব্য আমলে নেবেন।
কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবাল তা আমলে নেননি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও তিনি ভক্তদের পছন্দের বাইরে গিয়ে লিখেছেন। তখন ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেছেন, পাঠকদের মন্তব্য তিনি কখনোই পড়েন না। ‘ভয় হয়, পাঠক মন্তব্য পড়ার পর যদি তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই লিখি!’ বলেছেন তিনি।
অনেক আগে প্রমথ চৌধুরী বলে গেছেন, ‘কারও মনোরঞ্জন করা সাহিত্যের কাজ নয়।’ সম্প্রতি এমন ধারনার প্রতিধ্বণি শোনা গেল এই সময়ের মহাজনপ্রিয় গেম অব থ্রোনসের লেখক জর্জ আর আর মার্টিনের কথায়ও। সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞেস করলেন, ভক্তদের প্রতিক্রিয়ার প্রভাব কি পড়বে গেম অব থ্রোনসের পরবর্তী সিরিজে, তখন মার্টিন উত্তর দিলেন, না পড়বে না। কারণ পাঠকদের মন্তব্য আমি কখনোই পড়ি না। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমি কখনো লিখি না। নিজের ইচ্ছানুযায়ী লিখে বই প্রকাশ করি। পাঠকদের পছন্দ হলে গ্রহণ করে, না হলে করে না। এই তো!
এঁরা দ্বিতীয় দলের। সোস্যাল মিডিয়ার চরম উৎকর্ষতার এই যুগেও এঁরা পাঠকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চান। লিখে যেতে চান নীরবে নিভৃতে। যেমনটা বলেছেন ওরহান পামুক—লেখক হতে হলে আপনাকে অবশ্যই ঘরবন্দি হতে হবে। কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখা যাবে না। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুধু লিখে যেতে হবে। যেমনটা করেছেন কাজুও ইশিগুরো—‘১৯৭০-৮০ সালের শীতের পুরোটা সময় এবং বসন্তেরও কিছুটা সময়জুড়ে মাত্র কয়েকজন মানুষ ছাড়া সত্যিকার অর্থেই আমি কারো সঙ্গে কথাই বলিনি। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের মধ্যে ছিল গ্রামের মুদি দোকানী, তার কাছ থেকে আমি সকালের নাস্তার খাবার এবং ভেড়ার কলিজা কিনতাম—ওইগুলো খেয়েই বাঁচতাম তখন; আরেকজন ছিল আমার বান্ধবী লোরনা (এখন আমার স্ত্রী)। লোরনা দু-সপ্তাহ পর পর দেখা করতে আসত। ওই জীবনটার মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য ছিল না। তবে ওই চার পাঁচ মাসের মধ্যে আমার প্রথম উপন্যাস ‘আ পেন্সিল ভিউ অব হিলস’ এর অর্ধেকটা লিখে ফেলি।’
অর্থাৎ প্রায় পাঁচ মাস ইশিগুরো ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন জনবিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব কি না, যখন সোস্যাল মিডিয়া গ্রাস করে ফেলেছে সবকিছু, যখন প্রকাশকরা কোনো দায় নেন না বইকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর, যখন এক মাস ছাড়া বছরের আর কোনো সময় দেখা যায় না বইয়ের বিজ্ঞাপন, যখন পাঠক গরজ করে খুঁজে নেয় না ভালো কোনো বই?
ডিলেমা থেকেই যাচ্ছে!