পাঠক যে বই খুঁজছে, ‘আলোয় অন্ধ শহর’ তার একটি
নাদিয়া সারওয়াতপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০
আজ থেকে দেড়শো বছর পরের ঢাকা। ঘটনার নায়ক রিমেক। মধ্যবয়সী এই মানুষটি অবশ্য আমাদের সময়েরই। মানুষ বলতে যদি তার মস্তিষ্ক বোঝায় আর কি। কেননা, রিমেকের শরীর তার নিজের নয়, ট্রাভেল নামের ভবিষ্যতের এক যুবকের। ভয়ানক এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তারা দুজনেই। দেড়শো বছর সময়ের ব্যবধানের দুটি মানুষকে অদ্ভুত এক সমীকরণে বেঁধে ফেলেছে ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট।
অচেনা শরীরের সহজাত তাড়না, জীবনযাপনের অভ্যাসের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে রিমেক। একই সাথে যাকে মেনে নিতে হচ্ছে এক নতুন বাস্তবতা। এ হলো ভবিষ্যতের ঢাকা, প্রযুক্তির কঠিন ঘেরাটোপে সাজানো। উপন্যাসের নামেই যে শহরের যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক, ‘আলোয় অন্ধ শহর’।
বলাই বাহুল্য, সালাহ উদ্দিন শুভ্র’র নতুন এই উপন্যাস একটি সায়েন্স ফিকশন। এই ধারার সাহিত্যের পাঠকদের খুশি করা বড় সহজ কাজ নয়। শুভ্র সেই কঠিন কাজটিই করেছেন, অনায়াসে কিনা তা অবশ্য বলতে পারবেন একমাত্র তিনি নিজে। তবে ‘আলোয় অন্ধ শহর’এ কল্পবিজ্ঞানের চমকের সাথে সাথে পাঠক পাবেন রহস্যোপন্যাসের শিহরণ, ক্রাইম থ্রিলারের সাসপেন্স আর সাইকোলজিক্যাল হররের স্নায়ুচাপ।
অ্যাভেঞ্জার অ্যান্ড গেম দেখতে সিনেপ্লেক্সে ভিড় করা, মুহম্মদ জাফর ইকবালের অন্ধ ভক্ত কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে, শৈশবে সত্যজিৎ-আসিমভ-বেলায়েভ পড়ে বেড়ে উঠে এখন নেটফ্লিক্সে ব্ল্যাক মিরর দেখে মুগ্ধ হওয়া ‘অতটা তরুণ নয়’ দলের পাঠক, সবারই মনের খোরাক যোগাবে শুভ্রর এই উপন্যাস। এরই মধ্যে তরুণ লেখক হিসেবে সালাহ উদ্দিন শুভ্রর প্রতিশ্রুতিশীল পরিচিতি, সায়েন্স ফিকশনের জন্য সোনায় সোহাগা— ধ্রুব এষের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ, আর উপন্যাসের কাব্যিক নাম পাঠককে অনেকটা বাধ্যই করবে বইটি হাতে তুলে নিতে।
আর প্রথম কয়েক পাতা পড়লেই আটকে যেতে হবে দুর্ধর্ষ সব ঘটনার জালে। যে জাল কেটে বেরোতে চাইলে শেষ পর্যন্ত না পড়ে আর উপায় কী! আমাদেরই পরিচিত, ক্লান্তিকর যানজটের এই একঘেয়ে ঢাকার দারুণ রূপান্তর ঘটিয়েছেন লেখক, পড়তে গেলে মনে হয় ঠিক ঠিক, এরকমই তো হওয়ার কথা ভবিষ্যতের ঢাকা। তবে ঝাঁ চকচকে প্রযুক্তি, অ্যাপসনিয়ন্ত্রিত স্বাচ্ছন্দ্য আর ভার্চুয়াল বিলাসের নানা সুযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত এই ঢাকাও এক ডিসটোপিয়া, আমাদের হতাশাময় বর্তমানের এক অনিবার্য ভবিষ্যৎ যেন। সেখানে পরস্পরের পাশে থেকেও চিরবিচ্ছিন্ন, নিশ্ছিদ্র ডিজিটাল নজরদারির জালে আটকে ছটফট করছে মানুষ।
রিমেকের কল্পবৈজ্ঞানিক সংকট তাই ইউনিক হলেও চিরন্তন, মৌলিক এবং মানবিক। ট্রাভেলের সুন্দরী স্ত্রী মায়শার সাথে সহজ এবং উপভোগ্য যৌনতাও তাকে কোনো অর্থপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক দিতে পারে না। বরং ট্রাভেলের মতোই সে তীব্র আকর্ষণ বোধ করে ধারালো সৌন্দর্য আর তীক্ষ্ণধী আইনজীবী নিওলির প্রতি। শুধু প্রেমের নয়, মানবিক সম্পর্ক নিয়েও আর মানুষের জৈবিক-জীনগত স্বভাব নিয়েও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক তার নিজস্ব বোধ দিয়ে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোয় অন্ধ শহরের সাফল্য আসলে নিখাদ সায়েন্স ফিকশন হিসেবেই।
ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টের মতো একটা জটিল বৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চকে কল্পবিজ্ঞানের মঞ্চে নিয়ে এসেছেন তিনি। এরকম একটা উপন্যাসের যে/যারা ভিলেন, তাদের চরিত্রায়নেও নায়কের মতোই গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক। এদের সবারই আছে ব্যাক স্টোরি, আছে পুরো ঘটনাটিকে তাদের চোখ দিয়ে দেখার সুযোগ, আছে তাদের অপরাধপ্রবণতার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও। এরিয়েল কি নেহাতই এক উদ্দেশ্যহীন পেটি অপরাধী? নাকি সেও কোনো বড় ষড়যন্ত্রের অংশ? দেড়শো বছর আগে রিমেক যাকে শেষবারের মতো দেখেছে সড়ক দুর্ঘটনায় মরে যাওয়ার (কিংবা মরে না যাওয়ার ) আগে, ক্রিপ্টো কি তারই বংশধর?
রহস্যময় বিজ্ঞানী বায়োর চরিত্রটিও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। যৌন কামনা নেই তার, গবেষণা করে পুরুষের শরীরে মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন নিয়ে। আর এই যে পুরো ঘটনাটিরই পটভূমিকা আমাদেরই চিরপরিচিত অথচ নতুন এক ঢাকা, এটা পাঠককে বাড়তি একটা মুগ্ধতা দেয়। এবারের বইমেলায় কেনার জন্য যে ধরনের বই খুঁজছে পাঠক, ‘আলোয় অন্ধ শহর’ নিঃসন্দেহে তার একটি।
.
বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার বৈভবের ৭১৮ নম্বর স্টলে। এবং রকমারিতে।