পরিবর্তন বা প্রগতির অন্তরায় নয় ধর্ম

মো. নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০২০

কার্ল মার্কস ধর্মকে দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের প্রতিবন্ধক হিসেবে। তিনি ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘রিলিজিয়ন ইজ দ্য অপিয়েট/অপিয়াম অব দ্য পিপল’। এর মানে, ধর্ম মানুষের জন্য আফিম স্বরূপ। এই আফিম বলতে তিনি আসলে কি বুঝিয়েছেন? অনেকের ধারণা (বিশেষ করে আমাদের দেশে), আফিম খেয়ে মানুষ মাতাল হয়, মাতলামি করে; কাজেই যারা ধর্ম মানে তারাও এই মাতালদের মতো। এই ধারণা ভুল। এই ধারণা যদি কেউ পোষণ করেন, তিনি মার্কসের এই বাক্যের অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে মার্কস বুঝিয়েছেন এই যে, পেনিসিলিন নামের যে ড্রাগ (ওষুদ) আছে, তা আফিম দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ পেনিসিলিন, যা ব্যথা নিরাময় করে, তৈরিতে আফিম লাগে। সমাজে যে অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনা— এর কারণ মার্কসের মতে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, সমাজ কাঠামো (বর্তমানে পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো)।

কিন্তু ধর্ম অদৃষ্টে বিশ্বাস করতে বলে। ধর্ম বলে এগুলি মেনে নিলে তোমার জন্য পরকালে পুরস্কার আছে। এই জায়গাটায় মার্কস মনে করেন, ধর্ম এগুলি মেনে নিতে বলে এবং প্রকারন্তরে এইসব অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার মধ্যে যে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হবে এবং এই সমাজ পরিবর্তনের জন্য সে যে আন্দোলন করবে, বিপ্লব করবে, ধর্মের এই বিশ্বাস তা তাকে করতে দেয় না। তার অন্তরের ক্ষোভ ও ব্যথাকে ধর্ম প্রশমন করে দেয়। পেনিসিলিন, যা আফিম দিয়ে তৈরি, যেমন ব্যথা দূর করে, ধর্মও তেমন এই ব্যথা দূর করে। এই জন্য মার্কস আফিমের সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, মার্ক্স এখানে ধর্মকে দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের পথে বাঁধা হিসেবে। তার মতে, একমাত্র অর্থনীতি সমাজের মৌলকাঠামোয় অবস্থান করে। বাকিসব ধর্ম, রাজনীতি, আইন, সরকার, সংস্কৃতি— সব উপরিকাঠামোয় থাকে। সমাজের মৌলকাঠামোয় যাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে, উপরিকাঠামো তারাই সৃষ্টি করে, নিয়ন্ত্রণ করে।

ধর্মকে মার্কস তাই তার গুরু লুডভিগ ফুয়েরবাকের মতো মানুষের (পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোয় পুজিপতিদের) সৃষ্টি বলে মনে করেন। মার্কস নাস্তিক ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি মানুষের প্রতি এমনকি ধর্মের অনুসারীদের প্রতি অসহনশীল ছিলেন না, তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতেন না। অপর পক্ষে, ভেবার (ম্যাক্স ভেবার) মার্কসের বিপরীতে ধর্মকে দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের পথে সহায়ক হিসেবে। ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশে তিনি মনে করেন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম একমাত্র না হলেও প্রধান ভূমিকা রেখেছে। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস তথা ক্যালভিনবাদ ইউরোপের পুঁজিবাদের বিকাশ এবং অগ্রগতি অর্জনে কাজ করেছে। ‘দ্যা প্রটেস্ট্যান্ট এথিক এন্ড দ্যা স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম’ বইয়ে তিনি তাই ব্যাখ্যা করেছেন। ভেবারের এই সূত্র ধরে আরেকজন খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এন বেল্লাহ (যিনি প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্সের ছাত্র; ইন ফ্যাক্ট বেল্লাহ হার্ভার্ডে ট্যালকট পারসন্স এর অধীনে পিএইচডি করেছেন ১৯৫০`র দশকে) জাপানে পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে তকুগাওয়া ধর্মের কথা বলেছেন।

‘তকুগাওয়া রিলিজিয়ন: দ্যা ভেলুজ অব প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল জাপান’ নামে বেল্লাহর একটা বিখ্যাত বই আছে। কাজেই ধর্ম পরিবর্তন বা প্রগতির অন্তরায় নয়। মার্ক্স অন্তরায় মনে করলেও ভেবার কিংবা বেল্লাহর গবেষণা তা প্রমাণ করে না। প্রশ্ন হলো, ধর্ম বলতে কি বুঝায়, ধর্মকে মানুষ কিভাবে বুঝছে? আমেরিকার ক্লু, ক্লাক্স, ক্লান বা উগান্ডার লর্ড আর্মি; ইসরাইলের জায়োনিস্টস; ভারতের আরএসএস, বিজেপি; মায়ানমারের ৯৬৯ গোষ্ঠী বা মাবাথা; কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের আইএস নিজ নিজ ধর্ম বলতে যা বুঝছে, সেটাই কি ধর্ম? কেউ তা মনে করতে পারেন। কিন্তু আদতে এই ধর্মগুলির স্ক্রিপচার কোনোটিই মানুষের জীবন হরণের কথা বলেনি। এ ধর্মগুলি সব সো-কল্ড উন্নয়নের অন্তরায়, তা সোজাসুজি বলা যায় না। সমস্যাটা হলো, ধর্মটা ভালোভাবে বোঝা এবং মানুষকে বোঝানো। সেকুলারিজমের নামে ধর্মকে দূরে সরিয়ে রাখাটা এমনকি একটা কৌশলগত বড় ভুল। কারণ, একটা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ যা বিশ্বাস করে, তা থেকে তাদেরকে কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখা যায়? চাইলেও কি আসলে তা পারা যায়? বরং দূরে সরিয়ে না রেখে রাষ্ট্রের উচিত ধর্মটা ভালোভাবে শিক্ষা দেয়া।

রাষ্ট্র না শিখালেও কারও না কারও কাছ থেকে মানুষ শিখবে। আর সেই শিক্ষাটা যদি সঠিক শিক্ষা না হয়, এর খেসারত রাষ্ট্রকেও দেয়া লাগে। তথাকথিত সেকুলাররা এটা বুঝবেন না। একটা উদাহরণ দেই, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে লম্বা সময় ধরে সেকুলার শাসকেরাই ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু তারা মানুষের ধর্মের দিকটা ইগ্নোর করে গেছেন বা এটা নিয়ে সেকুলার হলেও মোটা দাগে রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য তারাও ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। আজকে তার ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। উগ্রপন্থী, চরমপন্থীরা হঠাৎ করে উদিত হয়নি। ধর্মের ক্ষেত্রে সেকুলার রাষ্ট্রের উদাসীনতা, অপরিপক্কতা, কৌশলগত ভুল পলিসি দিনে দিনে উগ্রপন্থা, চরমপন্থার বিকাশ ঘটিয়েছে। আমি জোড় দিয়ে বলতে পারি, ইউরোপ-আমেরিকায় যে সামাজিক সহিষ্ণুতা, সদ্ভাব, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে, তার পিছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে রাষ্ট্রের আয়োজনে ধর্ম সম্পর্কে পাঠদান। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধর্ম নিয়ে গবেষণা হয়। কেবল সামাজিক গবেষণা নয়, থিওলজিক্যাল বা ধর্মতাত্ত্বিক গবেষণাও।

হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজে ডিভিনিটি স্কুল আছে। সব ধর্মের আলোচনা সেখানে হয়। সব ধর্মের গবেষণা সেখানে হয়। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, সহিষ্ণুতা দু`ভাবে হতে পারে। টলারেন্স ইন ইগ্নরেন্স এবং টলারেন্স ইন নলেজ। প্রথমটা টেকশই হয় না, যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়টাই আসল টলারেন্স। ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ডিভিনিটি স্কুল থাকলে কোনও অসুবিধা নাই, সেখানে ধর্ম শিখালে এবং শিখলে কোনও অসুবিধা নাই, কিন্তু সব অসুবিধা এই দেশে। এখানে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আরবি বা ইসলামিক স্টাডিজ বা সংস্কৃত, পালি কিংবা হিন্দু, খ্রিস্টান ধর্ম পড়ানোটা শুরু হয়, এমন বহু মানুষ আছে যারা বলবে, বিশ্ববিদ্যালয় তো মাদ্রাসা বা রিলিজিয়াস সেমিনারি হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কি মাদ্রাসা? এইসবই হলো চিন্তার দৈন্যতা, ভাবনার দরিদ্রতা। এগুলি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ধর্মটা (আমি সব ধর্মের কথা বলছি) যদি রাষ্ট্র ঠিকমতো আমলে নিয়ে মানুষকে শিখাতে পারত, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে পারত। ভেবার এবং বেল্লাহ ধর্মের যে অবদানের কথা বলেছেন, তা এ দেশেও সম্ভব হতো।