ন্যুট হ্যামসন
ন্যুট হ্যামসনের গল্প ‘দ্য কল অব লাইফ’
ভাষান্তর: নাহিদুল ইসলামপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০২০
লেখক পরিচিতি: নোবেল বিজয়ী লেখক ন্যুট হ্যামসন ১৮৫৯ সালে নরওয়েতে জন্মগ্রহণ করেন। ‘দ্য গ্রোথ অব দ্য সয়েল’ মহাকাব্যের জন্য তিনি ১৯২০ সালে নোবেল পুরস্কার পান। বিশ শতকের নিউ-রোমান্টিক বিদ্রোহের অগ্রপথিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। বিগত একশো বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য স্টাইলিস্টদেরর একজন ধরা হয় তাকে। তিনি ১৯৫২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ‘দ্য কল অব লাইফ’ বা ‘জীবনের ডাক’ গল্পটি নরওয়েজীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এন্ডার্স অরবেক। এখানে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
কোপেনহেগেনের অভ্যন্তরীণ পোতাশ্রয়ের নিচে ভেস্টারভোল্ড নামের একটা নব্য অথচ নির্জন প্রশস্ত রাস্তা আছে। অল্পকিছু বাড়ি দেখা যায় দু’পাশে, কিছু গ্যাস বাতিও আছে, তবে কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। এমনকি এখনও, এই গ্রীষ্মের দিনেও, কাউকে এখানে প্রমোদভ্রমণ করতে পর্যন্ত দেখা যায় না।
যাই হোক, গতদিন বিকেলে আমি এই রাস্তায় একটা বিস্ময়কর ব্যাপারের মুখোমুখি হয়েছি। পথের পাশ দিয়ে কয়েকবার এমাথা ওমাথা হাঁটছিলাম আমি। একজন নারী বিপরীত দিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। দৃষ্টিগোচরে অন্য কোনো মানুষ ছিল না। ল্যাম্পবাতিগুলো জ্বলছিল কিন্তু তবুও অন্ধকার ছিল, এতই অন্ধকার যে, আমি তার চেহারা দেখতে পাইনি। নিশিরাতের একজন সাধারণ জীব মনে করে আমি তাকে পেরিয়ে চলে এলাম। রাস্তার শেষপ্রান্তে এসে আমি আবার ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম। মহিলাটিও ফিরে হাঁটা শুরু করল, আমার সাথে আবারও তার দেখা হলো।
আমি ভাবলাম, সে হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আমার ভেতরে কৌতূহল জেগে উঠল সেটা দেখার জন্য। আবারও আমি তাকে অতিক্রম করে গেলাম। আমি তৃতীয়বার যখন তার মুখোমুখি হলাম, আমার মাথার হ্যাটটা খুলে তার সাথে কথা বললাম, শুভ বিকেল, আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?
সে চমকে উঠল, না-মানে, হ্যাঁ।
সে কারো জন্য অপেক্ষাই করছিল। সে যাকে আশা করছিল তিনি না আসা পর্যন্ত আমার সঙ্গ কি অনভিপ্রেত ছিল? না, তার অন্তত আপত্তি ছিল না। সে আমাকে ধন্যবাদ জানাল। বলল, সে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল না। সে শুধু বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ করছিল, এইখানে সেটা খুবই স্নিগ্ধ।
আমরা পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। যেসব কথাবার্তার কোনো মহৎ পরিণাম নেই, এমন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে।
না, ধন্যবাদ। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
এরকম বিহারে কোনো মজা নেই, আমি অন্ধকারে তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি সময় দেখার জন্য দেশলাই জ্বালালাম। আগুনটা সামান্য উঁচুতে ধরে আমি তার দিকেও তাকালাম। বললাম, নয়টা ত্রিশ।
ঠাণ্ডায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আমি সুযোগটা নিলাম। বললাম, আপনি জমে যাচ্ছেন। আমারা কি কোথাও গিয়ে বসে কিছু পান করতে পারি না? টিভোলিতে? অথবা ন্যাশনালে?
সে জবাব দিল, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন না এভাবে আমি কোথাও যেতে পারব না?
আমি প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলাম, সে খুব দীর্ঘ একটা অবগুণ্ঠন পরে আছে। আমি ক্ষমা চাইলাম এবং আমার ভুলের জন্য অন্ধকারকে দায়ী করলাম। যেভাবে সে আমার ক্ষমাপ্রার্থনাকে স্বীকার করে নিল তাতে মুহূর্তেই আমি বুঝে গেলাম, সে কোনো সাধারণ নিশিবিহারি নয়।
আমি পরামর্শ দিলাম, আপনি আমার হাতটা ধরবেন? এটা আপনাকে কিছুটা উষ্ণ করবে হয়তো।
সে আমার হাত ধরল। আমরা হেঁটে চললাম এবং রাস্তাটা কয়েকবার ঘুরে ঘুরে আসলাম। সে আবার আমাকে সময় দেখতে বলল।
দশটা বেজেছে। আপনি কোথায় থাকেন?
গ্যামল কঙেভে। সে বলল।
আমি তাকে থামালাম, আমি কি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি?
না না, আমি আপনাকে তা করতে দিতে পারি না, আপনি তো ব্রীজগেটের দিকে থাকেন, তাই না?
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কিভাবে জানেন?
ওহ, আমি জানি কে আপনি।
একটু থামলাম আমরা, তারপর আলোময় রাস্তায় পাশাপাশি হেঁটে চললাম। সে দ্রুত হাঁটল, পেছনে তার দীর্ঘ জামার শেষপ্রান্ত রাস্তায় ছড়িয়ে চলতে থাকল।
সে বলল, আমরা বরং দ্রুত যাই, চলুন।
গ্যামল কঙেভে তার বাসার সামনে চলে এলাম আমরা। সে আমার দিকে ফিরে তাকাল যেন তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতে চাইলো। আমি তার জন্য দরজাটা খুলে দিলাম, সে ধীরে প্রবেশ করল। আমি শান্তভাবে দরজায় হেলান দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। সে ভেতরে প্রবেশ করে আমার হাত ধরল। আমরা কেউই কোনো কথা বললাম না। দুই তলার সিঁড়ি ভেঙে তৃতীয় তলায় এসে থামলাম। সে নিজেই তার এপার্টমেন্টের দরজা খুলল, তারপর দ্বিতীয় একটা দরজা খুলে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
সম্ভবত এটা ড্রয়িং রুম, আমি দেয়ালঘড়ির টিকটিক শুনতে পেলাম। ভেতরে প্রবেশ করে সে একমুহুর্ত থামল, তারপর হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কম্পমান প্রচণ্ডতায় আমার মুখে চুমু খেল। বলল, তুমি বসবে না? এই সোফায় বসো, আমি আলো জ্বেলে আনি। তারপর সে একটা বাতি জ্বালিয়ে দিল।
আমি নিজের দিকে তাকালাম, অবাক হলাম, কৌতূহলীও। নিজেকে একটা প্রশস্ত এবং সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে আবিষ্কার করলাম, কয়েকটা ঘরের দরজা আধখোলা হয়ে ছিল। আমি ভেবে পেলাম না জীবনে আজ কোন ধরনের মানুষের সাথে আমার দেখা হলো! আমি অনন্দিত হয়ে বললাম, কি সুন্দর এই বাড়ি! তুমি কি এখানে থাকো?
হ্যাঁ, এটা আমার বাসা।
এটা তোমারই বাসা? তাহলে কি তুমি বাবা-মায়ের সাথে থাকো?
আরে নাহ, আমি একজন বয়স্ক মহিলা, তুমি দেখো। সে হেসে বলল। এবং তার শরীরে জড়িয়ে থাকা অবগুণ্ঠন খুলে ফেলল। এই দেখো, আমি কি বলেছিলাম!
সহসাই অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনায় সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বাইশ কী তেইশ বছর বয়স হবে তার, ডান হাতে একটা আঙটি পরেছিল সে। সে সম্ভবত একজন বিবাহিত নারী। আর সৌন্দর্য? না, তার মুখে সামান্য ব্রণের দাগ ছিল, ভ্রু বলতে ছিল না প্রায় কিছুই। কিন্তু তার মধ্যে একটা প্রস্ফুটিত জীবনীশক্তি ছিল এবং তার মুখটা ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর। আমি জানতে চাচ্ছিলাম কে সে, যদি থেকেই থাকে তাহলে কোথায় তার স্বামী, এবং এই বাসাটাই বা কার, কিন্ত প্রত্যেকবারই আমি কিছু বলতে গেলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল আর আমার কৌতূহলকে থামিয়ে দিল।
আমার নামঅ্যালেন। তুমি কিছু পান করবে? আমি ফোন করে আনিয়ে নেব, কেউ বিরক্ত হবে না, ততক্ষণে তুমি শোবার ঘরটা দেখতে পারো।
আমি শোবার ঘরে গেলাম। ড্রয়িং রুমের আলো আংশিকভাবে সেখানে ছায়া ফেলেছে। দুটো বিছানা দেখলাম আমি। অ্যালেন ফোন করে ওয়াইন অর্ডার করল। শুনতে পেলাম, একজন পরিচারিকা এসে ওয়াইন দিয়ে চলে গেল। একটু পরেই অ্যালেন চলে এলো শোবার ঘরে, তবে দরজার কাছেই দাঁড়ালো। আমি তার দিকে একপা এগিয়ে গেলাম। সে সামান্য কেঁদে উঠল তবে এগিয়ে আসল আমার দিকে।
এইসবই গতদিনের কথা। তারপর কি হয়েছিল? ধৈর্য ধরুন। অনেক কিছু বাকি আছে। আজ সকালে যখন আমি জেগে উঠলাম, তখন ভোরের আলো ছড়াচ্ছে। দিনের আলো ঘরের উভয় দিকের জানালা থেকেই প্রবেশ করেছিল। অ্যালেনও জেগেই ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তার বাহুযুগল ছিল ফর্সা এবং কোমল। তার বুক অস্বাভাবিক উঁচু। আমি ফিসফিস করে তাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম এবং সে তার আবেগপ্রবণ মুখ দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিল। দিনটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল।
দুই ঘণ্টা পরে আমি বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম। অ্যালেনও উঠে পড়ল, পোষাক পরে নিয়ে জুতো গলিয়ে নিল পায়ে। এবং তারপর আমি এমন কিছুর অভিজ্ঞতা পেলাম যা এমনকি এখনও আমাকে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্নের মতো আঘাত করছে। আমি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। অ্যালেন পাশের ঘরেই ছিল, কেউ একটা সংবাদ নিয়ে এসেছিল তার কাছে, সে দরজা খুলে দিল, এবং আমি ঘুরে তাকালাম। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস এসে আছড়ে পড়ল আমার ওপর, এবং এলেনের ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলে একটা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম আমি। একটা লাশ! একটা কফিনে, সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত, ধূসর দাড়ির একটা মানুষের লাশ! চাদরের নিচে ক্ষিপ্তবৎ মুষ্ঠিতে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার মতো তার অস্থিসার হাঁটু সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছিল। তার মুখ ভয়ানকভাবে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পূর্ণ আলোয় আমি সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি একটা কথাও না বলে চোখ ফেরালাম।
যখন অ্যালেন ফিরে এলো, আমি পোষাক পরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তার আলিঙ্গনে সাড়া দিতে পারছিলাম না কোনোভাবেই। সে তার অতিরিক্ত জামাকাপড় পরে নিল, নিচে রাস্তার দরজা পর্যন্ত আমার সাথে এলো, কিছুই না বলে আমি তাকে আসতে দিলাম। দরজার কাছে এসে সে দেয়ালের সাথে এমনভাবে সেঁটে গেল যেন তাকে দেখা না যায়। সে বলল, ঠিক আছে তাহলে, শুভ বিদায়।
আমি তাকে পরীক্ষা করার জন্য বললাম, আগামীকাল পর্যন্ত?
না, কাল নয়।
কেন নয় কাল?
বেশি প্রশ্ন নয়, প্রিয়। আমার একজন আত্মীয় মারা গেছেন, আমাকে তার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় যেতে হবে। তখন সেখানে... তুমি তো জানো।
কিন্তু কালকের পরেরদিন?
আচ্ছা, কালকের পরদিন, এই দরজায়। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। বিদায়।
আমি চলে আসলাম। সে কে ছিল? আর লাশটা? আড়ষ্ট মুষ্ঠিআর ক্ষয়প্রাপ্ত মুখের কোণগুলো— কী ভয়ানক প্রহসন! কালকের পরদিন সে অপেক্ষা করে থাকবে। আমি কি আবার তার সাথে দেখা করব?
আমি সোজা বার্নিয়া ক্যাফেতে চলে গেলাম এবং একটা তথ্যপঞ্জি চাইলাম। আমি গ্যামল কঙেভেতার নামটা খুঁজেই চললাম— এই তো, নামটা রয়েছে। আমি সকালের খবরের কাগজ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর দ্রুত মৃত্যুর খবরগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। এবং নিশ্চিতভাবেই আমি তারটাও খুঁজে পেলাম, লিস্টের শুরুর দিকেই, সেখানে মোটা করে লেখা— আমার স্বামী, যার বয়স পঞ্চান্ন বছর, দীর্ঘ অসুস্থতা শেষে আজ মারা গিয়েছেন।
মৃত্যুর তারিখটা ছিল গতকালের। আমি অনেকক্ষণ বসে থেকে চিন্তা করলাম। একজন মানুষ বিয়ে করে। তার স্ত্রী তার চেয়ে ত্রিশ বছরের ছোট। একটা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয়মানুষটা। তারপর এক যথাযথ দিনে মরে যায়। এবং যুবতী বিধবাটি পরিত্রাণের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।