নীহার লিখনের দীর্ঘকবিতা ‘শীত’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০২০
শীত বলে না কিছুই তেমন
শূন্য সুড়ঙ্গে ন্যূব্জ করোটি আর মরে যাওয়া ভ্রুর মতো পূণ্য কোনো সম্বিত উছলানো থাকে না হৃদয়ে, থাকে না কোনো কিন্নরী জল নীরব পানসির স্রাবে
তারপরও যেন বাবলা পাতা ঝরে যাওয়ায় চেয়ে থাকে মাটি পাটাতন, মুখে চেয়ে থাকে সোডিয়াম আলোর বিতানে সব ছেড়ে যাওয়া নিশান্ত শহর, পিচ রাস্তায় থুম যেন নেভা উনুনের পাশে বাষ্পীভবনে কোনো সম্মতি নাড়ান, সম্মোহন নেই কোনো এমন নারীটার শ্রীহীন মুখ
কোনো স্ফটিক না; দূরবীক্ষণে যেমন দেখা যায় একটা বালির কণার ত্বকে নন্দন দাগের মতন কোনো কণ্ঠার হাড়, উইয়ের ঢিবির মতো—
কোনো এক অবস্থিতি স্পর্শের বাইরের ঘুঘুর উঠানে, কান্নার মতো অবেলা
নিশিন্দা পাতার মতন ভিজে যাওয়া কারো মন, যেন ভোরের আযানটা পুকুরের জলে ভেসে এসে, মৃত বন্ধুর কোনো হাসি রোমন্থনে ছুঁয়ে দিতে চায় সুফিদের মুদ্রার মতন, ঘুরন্তি পায়ের পাতায় স্তম্ভিত বল, টুপটাপ ঝরে যায় যেন মৃত্যুগামী একটা সময়, স্মরণের চৌকাঠে বিঁধে রেখে জাগতিক সব সুন্দর রোদ-বৃষ্টি ও রত্নের মতো স্বাদু জল
কারো কোনো ডাক নেই, সাড়া নেই
শব্দ ম্রিয়মানতায় বোবারাতে যেন শুধু নিশাচর সিলগালা করে আছে ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ত শরীর, লোকালয়ে পুরুষ ও শিশু যেন একভেদে খুঁজছে শালের উপদেহ আর সব উড়ালি পাতা
শীত চিরকালই তারই মতো; গলে যাওয়া যায় এরকম এক ভাবি মোমের জীবনে উষ্ণতা অভিশাপ, বিম্বিত সী-গালের পাখার মতন সুউচ্চ আকাশের ক্রমশ বিলীন রঙ থেকে মৃত মায়ের মুখের মতো ঝাপসা আদর, যেন কোনো বাঁশির বিলাপ নির্ঘুম ঘড়ির আওয়াজ চিরে ঘরে ঢুকে যায়, মধু-দিনে জাগ্রত কল্পনা বেহুই গোটার মতো লাবণ্য-বিরানের বালু, গোহালের ধোঁয়ার সাথে মিশে বাইর-বাড়িতে জমে করে ক্রন্দন, নিঃস্ব সবুজ কোনো রঙের ঝুলন; শুকনো জলার পাশে সাপের খোলসে আর বিবর্ণ বিবিধে সংসার পেতে থাকে বেদের কুটির, পেট্রার আগাছার মতো নিশ্চুপ, যাতে নিভৃতি মিশে আছে যেন ঝিঙ্গার বায়ুসখা ফুল, যেন সন্ধ্যা নামার আগে আদলে হারিয়ে ফেলে স্বীয় আস্তাবল বেনামি কোনো ঘোড়ার কেশর, ডুবে যায় ঘাস বনে ছায়ার মতন
তবু কী যেনো খুব করে ভাবতে চেয়ে প্রিয় কাউকে,
একটা বিফল কবিতার মতো মনে করি চিত্রল হরিণের খুর, মনে আসে কুয়াশায়, পাতার লাশে,
অনাহূত রোদের সটান তার সদা স্নিগ্ধ হাত ও মুখের গড়ন; দিনে দিনে যেন সে আজ হেমন্তের শুকনা নাড়া, সাকুল্য ক্ষরণ, মিশে যাওয়া দাদার পানের বরজে ভিজে যাওয়া টিয়া পাখির মতন শৈশব, ছাইরঙে স্থিত আজ যার সমস্ত প্রেম ও চুম্বন
যার নাম লিখতে চেয়েছি চিরদিন পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহের স্ফূরিত কোনো সত্যের আড়ালের সত্যটা অপসৃতির, দূর্বার গতি নিয়ে ডুবে যাওয়া চাঁদের কণার মতো যার কথা ভেসে থাকে মাঘের রাতে যেন বিকানো নিনাদ কোনো তানপুরাটার, যেন আজ সে মাটিতে দেবে যাওয়া কোনো রেললাইন;
ভিড়ের মধ্যে কোনো জানলা খুলে, যেন সোনামুখি সুইটা মাটিতে, বেরিয়ে আসে গেলে পাতা কুড়াতে
নেই বুক যার মর্মর শুকনো প্রলাপ, লুকানো প্রদীপ থেকে কোনো বিভা-কাফেলার সুর, ঘন হয়ে ঢালছে আঁধার, আমার শরীর, পিঁপড়া জড়ানো কোনো সাদা কামিনীর মরা কোটরের ডালে, মূক মুখ, ধোঁয়ার মতন
থুবড়ানো মাথাভাঙা সময়ে এসেও যাকে মনে হয় আরেকটা কুরু সমস্বরের সব কথার দোহারে,
শিরা-বিদ্যুৎ, রক্তে ছিটাচ্ছে চূড়াগামী মেঘ;
নিরন্ন মুখের রেখায় যেরকম আগুন-চোখে চেয়ে থাকে বুভুক্ষু মানুষ, তারও রয়েছে সেই ধার, শঙ্খ-করাত, বেদনাহত কোনো দুঃখ; সমাগত পুরাকাল থেকে অদ্যবধি সমস্ত নদীদের পাড়, ঝিনুক দহন, কুয়াশার সর
হাটখোলা গ্রামের দিকেই ফিরে আসি, গন্তব্য নেই এমন জীবনে, ঐশ্বর্য হারিয়ে শেষে সেখাই ফের
ফড়িংটা উড়ে আজও যেখানে আমার
বিষণ্ণ মোহটার জরি-খুলা বালুর মিনার, শিউলির ভুলে যাওয়া একলা চাতাল
তারপরও ভাবক জীবনে তেমন কোনো বিগ্রহ থাকে না, কিম্বা তেমন কোনো আরাধনার মূর্তিটা বিশেষ যেরকম কলতান পায় কোনো হিজল বা পাখি,
ভাবনায় তারপরও চিত্রিত করি আমি তাকেই
মালা অজস্র গাঁথি কোনো গন্ধে অপার,
যদিও দেখা হয় নাই প্রিয় ওষ্ঠ তোমার,
যেন ডুমুর-পরাগ,
মগজে অনন্তকাল খেলছে রেণু,
আকাঙ্ক্ষার খয়েরি ধেনু;
বিস্তারিত জানা নেই অনিন্দ্য বিরল বিভুই,
কেঁপে উঠে আঙুলেরা মৃদু,
করে ছুঁই ছুঁই
পরমকে ভাবি কোনো জড়তার নীলচে বিধুর কোনো দূরগামী পাখির পাখা, ছাইতান গাছের অসার
দেখা যায় তার ফুলকপির মতন থোকা ফুল, মাতিয়েছে বিষন্নতার সব কালান্তরের আয়োজন, চির ভাস্বর, সুতীব্র স্বাতী যেন মুছে নাই অগুনতি অবহেলা কালে
স্তম্ভিত হয়ে আছে শাপলার দেহ, সকালের খালে, হংসরা ফেলে গ্যাছে আবাসের দোহাই, রেখে গ্যাছে মন খারাপের ঢিবি স্থবির শীতল রূপা-জল
কোনো কথা বলে না তেমন;
দ্রুত নেমে আসে রাত
পৌষের অপেক্ষা তবু যেন গোলাপি দিঘল
তোমার ঠোঁটের নিচে তিলের মতো এক আকাঙ্ক্ষা জাগরুক থাকে মহিমায়, যেন এক অমৃত আমি খুঁজি শ্বাশতকাল, যদিও কিছুই না কেবল ধূসর; তারপরও মনে হয় নাড়িয়ে দেখি, ঢাকনা সরিয়ে দেখি পদ্মপাতার, শালুকের মতো করে যদি পাওয়া যায়, নির্বান্ধব সময়ের পরিতাপ ভেঙে যদি উঠে আসে পুচ্ছটা শর্বরী কুঞ্জের মোহন রানীর,
যেন সে ভীষণ এক পাঠশালাটা
যেন ডারউইন, ঝুমরি দাড়িতে রেখে ভাবিত আঙুল
বলছে গোপন সব নীতিশাস্ত্র, আর নন্দন গোপন
আমি যাকে আজোবধি চিনি নাই বলেই
সে আরও গোমড়া হয়ে নেকাব টেনে রাখে কুয়াশায়, যেনো আমারই স্বরূপ, দাহ্য হচ্ছি, আর উড়ে-ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে পিত-ছাই,
সঙ্গোপন সংবেদে রেখে, শিশিরের শিরশির গুনে গুনে পেরোচ্ছি কবে থেকে পথ, পথের দিশায় সে যে নাই, আমি আজীবন ভালোবাসি তার মতো শীত, মনে মনে ভাবি আমি ও কুয়াশা যেন সহোদর ভাই